সাহানা বাজপেয়ী: যার কণ্ঠে মনের খোরাক মেটে, হৃদয় শান্ত হয়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

জীবিকা অর্জনের তাগিদে একটা সময় লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের সিমও বিক্রি করেছেন। জীবনের যুদ্ধকালীন সময়টাতে ভেঙে না পড়ে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেছেন, আত্মবিশ্বাস আর সামর্থ্যের ওপর ভরসা করে, শোককে তিনি সত্যিই বানিয়েছেন শক্তি...
ছোটবেলায় সাহানা বাজপেয়ী যখন কাঁদতেন, তখন কান্না থামানোর জন্য বাবা কিংবা মা'কে গান গাইতে হতো। অন্যকিছুতেই কাজ হতো না, শুধুমাত্র গান শুনলেই তার কান্না থেমে যেত, একদম শান্ত হয়ে গান শুনতেন।
সাহানার দাদাবাড়ি ছিল ময়নসিংহে, কিন্তু জলপাইগুড়ির চা বাগানে চাকরী করার সুবাদে সেখানেই থিতু হয়েছিলেন দাদা। সাহানার জন্মও হয় জলপাইগুড়ির সে বাড়িতে, যেখানে বাবা-মা, দাদা-দাদুকে নিয়ে তাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। সাহানার বাবা-মা দুজনই পেশায় অধ্যাপক হলেও, গানটা বেশ ভালই গাইতেন তারা। গানের পরিবেশে বড় হয়ে তিন বছর বয়স থেকে বাবা বিমল বাজপেয়ীর কাছে গান শেখা শুরু সাহানার।
তবে মেয়ের ওপর নিজেদের অপূর্ণ কোনো স্বপ্ন বাবা-মা চাপিয়ে দিতে চাননি, নিজের আগ্রহের জায়গাটা যাতে সে খুঁজে নিতে পারে, সেই পরিবেশটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন দুজনেই। বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তাই ছয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন শান্তিনিকেতনে, ভর্তি করে দেন পাঠ্যভবনে। মা অধ্যাপনার চাকরির কারণে থেকে যান জলপাইগুড়িতেই, ছুটিছাটায় স্বামী আর মেয়ের কাছে আসতেন।

শান্তিনিকেতনে এসে প্রথমবারের মতো বাবা ছাড়া অন্য কারও কাছে গান শেখার সুযোগ পান সাহানা। শুধু গান নয়, নাচ এবং কবিতা আবৃত্তিও শেখেন সেখানে। কিন্তু সেগুলো শুধুই ভালোবাসা থেকে করা, কোনোটাকেই তিনি ক্যারিয়ার বানাতে চাননি। পড়াশোনাও করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। তবে গানের প্রতি তাঁর অন্যরকম এক টান সৃষ্টি হলো। হয়তো তা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাহানা বলেন,
'আমার বাবা প্রফেশনাল কোনো গায়ক ছিলেন না। কিন্তু যখনই তিনি গান গাইতেন, হৃদয় দিয়ে গাইতেন। একারণে ছোটবেলা থেকে যখনই আমি গান গাই, সেটা হৃদয় দিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করি। এ চেষ্টাটুকু আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া।'
গান গাওয়ার পাশাপাশি লিখতেও ভালবাসতেন তিনি, বন্ধু অর্ণবের (বাংলাদেশের গায়ক শায়ান চৌধুরী অর্ণব) সাথে সম্পর্কটা জোরালো হলো সেই সূত্র ধরেই। একই ক্লাসে পড়তেন তারা। সাহানার লেখা গানে সুর বাঁধতেন অর্ণব, চমৎকার একটা কেমিস্ট্রি ছিল গানের ক্ষেত্রে তাদের বোঝাপড়ায়। 'একটা ছেলে', 'হারিয়ে গিয়েছি', 'সে যে বসে আছে', ‘হোক কলরব’ এর মতো বিখ্যাত গানগুলো সাহানারই লেখা।
অর্ণব তো ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় প্রথম দেখাতেই বলে বসেছিলেন বড় হয়ে সাহানাকে বিয়ে করবেন। সাহানার ক্ষেত্রে এমন কিছু না ঘটলেও, বন্ধুত্ব, গান আর বোঝাপড়াটা যে অর্ণবের সাথেই তার সবচেয়ে বেশি ভালো হতো, তা বুঝতেন তিনি। অতঃপর বন্ধুত্ব, প্রণয় গড়িয়ে ২০০০ সালে অর্ণবকে বিয়ে করে বাংলাদেশে আসেন তিনি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ পড়াশোনার বিষয় ইংরেজি সাহিত্যেই লেকচারার হিসেবে জয়েন করে ক্যারিয়ার শুরু করলেন।

এতকিছুর পাশাপাশি গানটাকে কিন্ত ভোলেননি সাহানা। শিক্ষকতার পাশাপাশি গানটাও করতেন শখের জায়গা থেকে, অর্ণবের জন্য গান লিখতেন। ২০০৭ সালে সাহানার বাবা মারা যান। প্রচন্ড ভেঙে পড়েন তিনি। বাবার জন্য কিছু করার তাড়না থেকেই বাবার পছন্দের রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অর্ণবের কম্পোজিশনে সাহানার প্রথম সলো অ্যালবাম 'নতুন করে পাবো বলে' প্রকাশিত হলো।
এই অ্যলবামটা সাহানার কাছে খুব স্পেশাল, তিনি বলছিলেন- ''গান আমার কাছে সবসময়ই প্যাশনের জায়গা। কিন্তু যদি 'গানের ক্যারিয়ার' শুরু কোথায় সে ব্যাপারে বলতে যাই, তাহলে অবশ্যই সে উত্তর হবে 'নতুন করে পাবো বলে'। এই অ্যালবামটি আমি আমার বাবার জন্য করি, কিন্তু রিলিজের পর শ্রোতাদের প্রচুর ভালবাসা পাই, আর হঠাৎ করেই নিজেকে গায়িকা হিসেবে আবিষ্কার করি।"
গানের ক্ষেত্রে রসায়ন যতটা মজবুত ছিল, বিয়ের পর বাস্তব জীবনের রসায়নটা তেমন মজবুত থাকেনি সাহানা-অর্ণবের। ফলাফল- বিবাহ বিচ্ছেদ। এত বছরের সম্পর্কের এমন পরিণতির পর নিজেকে সময় দিতেই লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি, পুরনো অধ্যায় ফেলে নতুন করে সবকিছু শুরুর চেষ্টা করেন।
আর্থিকভাবে-মানসিকভাবে যুদ্ধ করে সেখানে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করেন সাহানা, পুরোনো ক্ষত ভুলে নতুন সংসার পাতেন লন্ডন নিবাসী রিচার্ড হ্যারেটের সাথে।
গানের জগত থেকে দূরে থাকতে চাইলেও অবশেষে তা পারেননি সাহানা। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে, ২০১৫ সালে আবার শ্রোতাদের সামনে হাজির হলেন তাঁর দ্বিতীয় অ্যালবাম 'যা বলো তাই বলো' নিয়ে। পুনরায় মুগ্ধতা ছড়ালেন গান দিয়ে, হারিয়ে ফেলা নিজেকে যেন আবার পুনরুদ্ধার করলেন এই অ্যালবামের মাধ্যমেই। দর্শকও ফিরে পেলো সাহানা বাজপেয়ী নামের মুগ্ধতাকে। পরের বছরই ফোকসঙ্গীত নিয়ে অ্যালবাম বের করেন, নাম- 'মন বাঁধিবি কেমনে'।
অনেকেরই প্রশ্ন, গান করার ক্ষেত্রে কেন তিনি বরাবর রবীন্দ্রসংগীত বা ফোককেই বেছে নেন? সাহানার কাছে জবাবটা রেডি থাকে- 'রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ফোক আমার কাছে অনেক স্পেশাল, কারণ আমি বেড়ে উঠেছি রবীন্দ্র আর বাংলা ফোক শুনে। আমাদের বাসায় একটা রেকর্ডার ছিল, যেটায় সারাদিন বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত চলতো। এরপর যখন শান্তিনিকেতনে চলে এলাম, সেখানে তো সবকিছু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই হতো। এছাড়া শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি, পরিবেশ, বাউল দাদারা- প্রত্যেকেরই প্রভাব রয়েছে আমার ওপর। আমাকে সাহানা বাজপেয়ী বানিয়েছেই শান্তিনিকেতন। তাই সেখানকার সংস্কৃতির ছাপ তো আমার গানে পড়বেই'।
সিনেমায় সাহানার প্লেব্যাক গান গাওয়ার শুরু 'হাওয়া বদল' সিনেমায় গান গাওয়ার মাধ্যমে। এরপর 'এক যে ছিল রাজা' এবং 'কণ্ঠ' সিনেমাতেও গান গেয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে অর্ণবের কম্পোজিশনে বাংলাদেশী সিনেমা 'আন্ডার কন্সট্রাকশন' এও গান গেয়েছেন। বেশ কিছু সিনেমাতে গান গাইলেও নিজেকে 'ইন্ডেপেন্ডেন্ট সিঙ্গার'ই বলেন তিনি। এখনও গানটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে নারাজ, প্যাশন হিসেবেই দেখতে পছন্দ করেন।
তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে মানেন বাবা বিমল বাজপেয়ীকে। কারণ হিসেবে সাহানা বলে চলেন- 'গায়িকা' হওয়ার দীক্ষা তিনি আমাকে না দিয়ে গানকে পূজা করতে শিখিয়েছেন তিনি। গানকে ভালোবেসে হৃদয় দিয়ে কীভাবে গাইতে হয়, গানকে কীভাবে পার্ফমিং আর্ট হিসেবে দেখতে হয়, সেসবই তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। তাই আজ আমি যা, সবটুকুই আমার বাবার জন্য'
পড়াশোনা আর সঙ্গীতের এতসব অর্জন নামের পাশে যোগ করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি সাহানাকে। ব্যক্তিজীবনে প্রচন্ড ঝড় সামলেছেন, বাবাকে হারিয়েছেন, পরিবার থেকে হাজার মাইল দূরে থাকতে হয়েছে। জীবিকা অর্জনের তাগিদে একটা সময় লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের সিমও বিক্রি করেছেন। জীবনের যুদ্ধকালীন সময়টাতে ভেঙে না পড়ে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেছেন, নিজের আত্মবিশ্বাস আর সামর্থ্যের ওপর ভরসা করে, শোককে তিনি সত্যিই বানিয়েছেন শক্তি। নিজের ওপর ভরসা করাটা যে কত সঠিক ছিল, তার প্রমাণ তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ইংল্যান্ড থেকে মোট তিনটি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। ব্যান্ড মেম্বার সমান্তক সিনহাকে সাথে নিয়ে একের পর এক গান এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শ্রোতাদের হৃদয় জুড়াচ্ছেন। সবশেষ তার গাওয়া 'শূন্য খাতার গান'ও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে।
সাহানা বাজপেয়ী এমন একজন, যার কণ্ঠ শুনে মনের খোরাক মেটে মানুষের, হৃদয় ঠান্ডা হয়ে যায়। তার কন্ঠে 'সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে শুনে' যেন সত্যিই মঙ্গলবারতা পায় সবাই। 'কার যেন এ মনের বেদন' শুনে বিষাদগ্রস্ত হয় মন, হাহাকার করে ওঠে ভেতরটা। তবে চিরকিশোরী কন্ঠের সাহানা বাজপেয়ী আমাদের মতো নব্বই প্রজন্মের কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার 'একটা ছেলে'র মাধ্যমে। কেননা মনের আঙিনাতে এক্কাদোক্কা খেলা, আমাদের ছুঁয়ে ফেলা কাউকে আমরা প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করেছিলাম এই গান শুনতে শুনতেই।
শুভ জন্মদিন সাহানা বাজপেয়ী, হৃদয়ের অন্তঃপুর থেকে ভালোবাসা নেবেন...