সিনেমার টেকনিক্যাল দিকগুলো আরও ভালো হতে পারতো, মাঝখানে এসে চিত্রনাট্যও গতি হারিয়েছে খানিকটা, কিন্তু তা সত্বেও যে বয়ানকে উপজীব্য করে এ নির্মাণ, সেটাই যেন বাকিসব ক্ষতে প্রলেপ হয়ে পড়েছে ঠিকঠাক। মূলত, সেখানে এসেই এই সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার যৌক্তিকতা বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। এবং, সেখানে এসেই 'সাহস' রূপান্তরিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক সিনেমায়...
সিলেটে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা হচ্ছে। সিলেটের মানুষ এ মুহুর্তে প্রচণ্ড শক্তিশালী এই বন্যার সাথে লড়ছেও। কিন্তু লড়াইটা শুধু যদি বন্যার সাথে হতো, তাহলেও হয়তো ভালো ছিলো। কিন্তু, এই অসহায় মানুষদেরকে লড়তে হচ্ছে কিছু শ্বাপদের সাথেও। যারা 'মানুষ' এর প্রতিবিম্বেই তাদের আশেপাশে ছিলো। যখন সংকট তৈরী হয়েছে, তারাও ফিরে এসেছে তাদের প্রকৃত চরিত্রে। কেউ 'আটশো' টাকার নৌকাভাড়া 'পঞ্চাশ হাজার' এ হেঁকে তাদের স্বরূপ দেখাচ্ছে। কেউ এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগ এর মধ্যেও নেমেছে লুটপাটে। সাধারণ মানুষদের সর্বস্ব লুটে নেয়ার জন্যে এই অসহায় মুহুর্তকেই বেছে নিয়েছে এই শ্বাপদেরা।
এরকম শ্বাপদ কম নেই বাংলাদেশে। বলা ভালো, গোটা দেশেই গিজগিজ করছে তারা। সুযোগের অভাবে ভালো থাকছে। আর সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এবং ঠিক এরকম এক অবস্থান থেকেই সাজ্জাদ খান নামের নবীন এক পরিচালক ভেবেছেন এক গল্প। যে গল্পকে অবলম্বন করে তিনি বানিয়েছেন সিনেমা। 'সাহস।' যে 'সাহস' অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্সের অভিযোগে বহুদিন সেন্সরে আটকে থাকার পড়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে স্ট্রিমিং সাইট 'চরকি'তে।
'সাহস' এর গল্প খুবই সোজাসাপ্টা। বাগেরহাটের কোনো এক মফস্বল এলাকায় গল্পের বিস্তার। যেখানে এক বিবাহিত নারীকে এক সন্ধ্যায় ধর্ষণ করে স্থানীয় শ্বাপদেরা৷ ধর্ষণের শিকার হবার পরে নানারকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একসময়ে নারীটি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আদালতে যাবেন। মামলা লড়বেন। যেখানে অধিকাংশ নারীই এরকম পরিস্থিতিতে আত্মহনন কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপনকে বেছে নেন... সেখানে এই নারীর 'সাহস' করে সামনে এগিয়ে আসাই হয়ে যায় গল্পের 'এক্স ফ্যাক্টর।' কিন্তু, এরপর কি হয়? এই শ্বাপদেরা কি মেনে নেয় এই নারীর সাহস? নাকি, তারাও শ্বদন্ত নিয়ে হয় আগ্রাসী? সেসব নিয়েই 'সাহস' এর শাখাপ্রশাখা।
যেটা প্রথমেই বলেছি, 'সাহস' এর গল্প সর্পিল না। খুবই ফ্ল্যাট টোনের গল্প। অভিনয়ে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান আর নাজিয়া হক অর্ষা ছাড়া বাকিরাও তেমন ধোপদুরস্ত না। কাহিনীর গতিও মসৃণ না। যারা অভিনয় করেছেন, তাদের অধিকাংশই বাগেরহাটের মানু্ষ, তাই অনেকেরই অভিনয়ের জড়তাটুকু কাটেনি। ডায়লগেও ক্লিশে কিছু কথাবার্তা বেশ কানে বেজেছে। টেকনিক্যাল বিষয়েও সমস্যা ছিলো বেশ। যে গালিগালাজ ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাও কিছুক্ষেত্রে অতিরিক্ত লেগেছে। কিন্তু, এত খুঁত থাকা সত্বেও, 'সাহস' সিনেমাটা কেন যেন যথেষ্টই ভালো লেগেছে।
ভালো লাগার কারণ, বিষয়বস্তু। একটা দেশের সিনেমায় থ্রিলার যেমন আসবে, রোমান্স-অ্যাকশন যেমন আসবে, তেমন আসা উচিত সোশ্যাল প্যারাডক্সের নানাবিধ রূপায়ণও। যেটা আসে 'সাহস' এ। এ সিনেমা এমন এক ইস্যু নিয়েই কথা বলে, যে ইস্যুতে বাংলাদেশে এখনো নেই সঠিক পরিকল্পনা। সঠিক প্রতিকার। এ দেশে এখনও ধর্ষণের বিচার না পেয়ে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দেয় মেয়ে-বাবা। এ দেশে এখনও ধর্ষণের পরে দোষী করা হয় মেয়েটিকেই। এমন এক দেশে এরকম এক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার যে প্রাসঙ্গিকতা... সেটা যে প্রতিদিনই বেড়ে যায় সমানুপাতিক হারে, তাতে যদি-কিন্তুর সুযোগ নেই মোটেও। যদিও টেকনিক্যাল দিকগুলো ভালো হয়নি, স্ক্রিনপ্লে মাঝখানে এসে গতি হারিয়েছে, কিন্তু তা সত্বেও যে বয়ানকে উপজীব্য করে এ নির্মাণ, সেটাই যেন বাকিসব ক্ষতে প্রলেপ হয়ে পড়েছে ঠিকঠাক। মূলত, সেখানে এসেই এরকম সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার যৌক্তিকতা বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ প্রসঙ্গে জানাই। এ সিনেমা যে প্রথমে সেন্সর বোর্ডের 'ক্লিয়ারেন্স' পায়নি, সেটা আমরা জানি। কিন্তু, যেটা আমরা জানিনা, তা হচ্ছে- পরবর্তীতে, সিনেমার কিছু দৃশ্য এডিট করে আবার সিনেমাটিকে সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়। এবং, সেন্সর বোর্ডের অনুমোদনও সিনেমাটি পায়। অর্থাৎ, সিনেমাটিকে চাইলে তখন তারা সিনেমাহলেও মুক্তি দিতে পারতো। কিন্তু, তারা তা দেয়নি। কারণ, তাদের মনে হয়েছিলো, যেসব দৃশ্য বাদ দেয়া হয়েছে, এসব না থাকলে, গল্পটা দর্শকের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছাবে না। ফলে তারা সিনেমাহলে মুক্তি না দিয়ে সিনেমাটিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দেয়। এই যে, গল্পের প্রয়োজনে মাধ্যমের পরিবর্তন... এই বিষয়টি যখন জানলাম, বেশ ইতিবাচকই লেগেছিলো।
সবমিলিয়ে তাই, এটুকুই বলার, নানারকম মিশ্র অনুভূতির মুখোমুখিই করেছে এ সিনেমা। তবে যেহেতু ভালো লাগার দিকই বেশি, তাই প্রত্যাশা থাকবে, এবার থেকে সিনেমার আনুষঙ্গিক দিকগুলোর দিকেও নজর রাখবেন সংশ্লিষ্টরা। সিনেমার কারিগরি দিক সামলানো, স্ক্রিনপ্লে'র ভারসাম্য বজায় রাখা, চরিত্রদের কাছ থেকে ভালো অভিনয় বের করে আনা, গল্পটাকে ঠিকঠাক স্টাবলিশ করা... এসব বার্ডেন যারা ঠিকঠাক নিতে পারে, তাদের গল্পই কিন্তু ঠিকঠাক দাঁড়ায়, জনপ্রিয় হয়। সে কারণেই তাই আশা থাকবে, পরবর্তী নির্মাণে এই বিষয়গুলোতে সচেতন হবেন নির্মাতা৷ পাশাপাশি, সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলার যে 'সাহস' তিনি দেখিয়েছেন এ নির্মাণে, আশা করি, সামনেও এটি বজায় রাখবেন তিনি। ফুল-পাখি-লতাপাতার বাইরের অস্বস্তির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার মানুষ আমাদের বরাবরই কম। প্রত্যাশা থাকবে, এ নির্মাতার বরাতে সে ঘাটতি খানিকটা হলেও পূরণ হবে।