ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন বহুদিন। স্টার প্লাসের জনপ্রিয় সব সিরিয়ালেরও ছিলেন নিয়মিত মুখ। হিট সব সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু তাও সেভাবে স্বীকৃতির মূল্য পাননি কোনোদিনই। মানুষটির নাম- সাক্ষী তানোয়ার। বলিউডের এক গুণী শিল্পী, এক অবহেলিত রত্ন!

'স্ক্যাম ১৯৯২'খ্যাত প্রতীক গান্ধীর একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম। যেখানে তিনি বেশ আক্ষেপ নিয়েই জানাচ্ছিলেন- 

চৌদ্দ বছর ধরে আছি বলিউডে। অভিনয়ের জন্যে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে যাইনি৷ পদে পদে ঠেকেছি। ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছি। তবু থামিনি। অভিনয় করেই গিয়েছি। 'স্ক্যাম ১৯৯২' এ অভিনয়ের সুবাদে এই যে জনপ্রিয়তা, তা হয়তো দেখতে খুব সহজ মনে হচ্ছে, কিন্তু এই জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্যেই আমার কেটে গিয়েছে চৌদ্দটি বছর।

এটা তো ঠিক, মহামারীর স্তব্ধ সময়ে যখন 'ওটিটি' নামক আশ্চর্য প্রদীপ ঝলসে উঠেছিলো, তখন নানা ক্ষেত্রেই এসেছিলো চমৎকারিত্ব। গল্পে বৈচিত্র‍্যে এসেছে, গল্পবয়ানে স্বকীয়তা এসেছে। মানুষ 'গল্প-নির্ভর' কাজে আগ্রহী হয়েছে। এসবের পাশাপাশি হয়েছে আরো বড় একটি পরিবর্তন। বহু শিল্পীর পুনর্জন্ম হয়েছে। ওটিটি'র সুবাদে প্রতীক গান্ধীকে যেমন মানুষ চিনেছে, নতুন করে লাইমলাইটে এসেছে আফজাল হোসেন, ইন্তেখাব দিনারের মত গুণী অভিনেতারাও। যদি 'ওটিটি' এত সর্বগ্রাসী হয়ে প্রকট না হতো, যদি কাজের এত বৈচিত্র‍্য না থাকতো, যদি টিপিক্যাল চ্যানেলেই এগোতো সবকিছু, তাহলে এই শিল্পীদের আমরা আর দেখতে পেতাম কী না, বা, দেখলেও, এভাবে খোলস ছেড়ে তারা বের হতে পারতেন কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। সে হিসেবে, 'ওটিটি' আলাদা এক ধন্যবাদই পাবে।  

তবে যেহেতু 'ওটিটি'র গুনকীর্তণ করতে বসিনি। তাই খানিকটা ভিন্ন প্রসঙ্গে একটু কথা বলি।  বাংলাদেশের ওটিটি কন্টেন্টে গুণী ও পুরোনো অভিনেতারা সুযোগ পাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে সত্যি৷ কিন্তু পাশাপাশি এও সত্যি, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে সে সুযোগ আরো বহুগুণে বেশি৷ কিছুদিন আগেই রাভিনা টেন্ডনকে প্রোটাগনিস্ট করে 'আরণ্যক' বানানো হলো, সুস্মিতা সেন এলেন 'আরিয়া'য়, মাধুরী দীক্ষিত 'দ্য ফেম গেম' এ দারুণ অভিনয় করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই অভিনেত্রীরা প্রত্যেকেই জনপ্রিয় ছিলেন। মাঝের কিছু সময়ে তারা খানিকটা বিস্মৃত হলেও ওটিটির সুবাদে তারা আবার লাইমলাইট পেয়েছেন৷ এবার, ঠিক এই পর্যায় থেকেই এমন একজন অভিনেত্রীর প্রসঙ্গ আনবো, যিনি সুস্মিতা, মাধুরী কিংবা রাভিনার মত জনপ্রিয় ছিলেননা কখনোই। যদিও অভিনয় করছেন বহু বছর ধরেই, কিন্তু স্বীকৃতি? শুনে আসা যাক মান্না দে'র গানের সে লাইনটাই-

পেলো না সে প্রতিভার দামটা! 

এই অভিনেত্রীর নাম সাক্ষী তানোয়ার। যারা 'স্টার প্লাস' এর পাঁড় দর্শক, তাদের কাছে 'কাহানী ঘর ঘর কি' সিরিয়ালের 'পার্বতী আগারওয়াল' খুবই পরিচিত এক মুখ। এবং বিশেষ এ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সাক্ষী। করেছিলেনও বেশ দারুণ অভিনয়। যৌথ পরিবারের যাপিত টানাপোড়েন যেভাবে উঠে এসেছিলো তার অভিনয়ে, তা যেমন মুগ্ধ করেছিলো বিস্তর, তেমনি বেশ রিলেটেবলও ছিলো তা। পরবর্তীতে তিনি অভিনয় করেন 'বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়' সিরিয়ালে। সেখানে রাম কাপুরের বিপরীতে 'প্রিয়া শর্মা কাপুর' চরিত্রে অভিনয়ে ছাড়িয়ে যান তিনি অতীতকেও। এই সিরিয়ালটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। 

পরবর্তীতে তিনি আরো বেশ কিছু কাজ করেছেন। 'কৌন বানেগা ক্রোড়পতি'র সাথে যুক্ত ছিলেন। 'দঙ্গল' সিনেমায় আমির খানের (মহাবীর সিং ফোগাট) এর স্ত্রী 'দয়া কউর' চরিত্রেও প্রাসঙ্গিক অভিনয় করেছেন। মনোজ বাজপেয়ী, নীনা গুপ্তার সাথে 'ডায়াল ১০০' সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। তবে সবই পার্শ্বচরিত্রে। মূলচরিত্রের সঙ্গত হিসেবে৷ তাই আক্ষেপ খানিকটা ছিলো। এত ভালো অভিনেত্রী, এতদিন ধরে আছেন ইন্ডাস্ট্রিতে... নির্মাতার 'ওপেনিং ব্যাটসম্যান' কি তিনি কোনোদিনই হতে পারবেন না?

ডায়াল হান্ড্রেড'ও আছেন তিনি 

বহুদিনের সে আক্ষেপ ঘুচেছে 'মাই' দেখার পরেই। নেটফ্লিক্সের রিসেন্ট এই রিভেঞ্জ ড্রামার প্রোটাগনিস্ট রোলেই ছিলেন তিনি। যদিও 'রিভেঞ্জ ড্রামা'র সে আবেদন এখন আর নেই। এত এত কাজ হয়েছে এই জঁরায়, আলাদা করে নতুন কিছু বলাও বেশ কঠিন। 'মাই'ও নতুন করে কিছুই বলেনি। গল্পবয়ানেও খুব বেশি নতুনত্ব আনেনি। সবমিলিয়ে, খুব একটা জমেনি কিছুই। কিন্তু, তা সত্বেও আলাদা করে মনে গেঁথে রইলেন সাক্ষী৷ একজন লড়াকু মা, বাকশক্তিহীন মেয়ের সাথে তার মিথস্ক্রিয়া, সে মেয়ে যখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তখন মায়ের আক্রোষ... বেশকিছু লেয়ার ছিলো তার অভিনয়ের। এবং প্রতিটি লেয়ারেই খুব দারুণভাবে সপ্রতিভ ছিলেন সাক্ষী। বহু বছর আগে এরকমই এক রিভেঞ্জ ড্রামা 'মম' এ শ্রীদেবীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুগ্ধ করলেন সাক্ষীও। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণত তাকে যেসব চরিত্রে দেখি, সেসব থেকে অনেকটাই আলাদা অবয়বে এসে, নির্মাণের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পারফর্ম করে তিনি ঠিক এটাই বোঝালেন- কেন তাকে নিয়ে কথা হওয়া উচিত। কেন তাকে আরো বেশি সুযোগ দেয়া উচিত।  

'মাই' এ দুর্দান্ত অভিনয়ই করেছেন সাক্ষী 

'মাই' এ যে অভিনয় সাক্ষীর, সেটার সাপেক্ষে তাই  প্রত্যাশা বেড়ে গেলো বহুগুণ। যদি বৈচিত্র‍্যের নানা চরিত্রে অভিনয়ের ডাক তিনি পান, তাহলে তিনি যে হতাশ করবেন না মোটেও, সে তো নিশ্চিত। সে কারণেই তাই আশা, এরকম চ্যালেঞ্জিং রোলে অভিনয়ের সুযোগ নিয়মিত পাবেন তিনি। সিরিয়ালের মিঠেকড়া গৃহবধূ কিংবা সুপারস্টারের সাথে ছিটেফোঁটা সঙ্গত দেয়া চরিত্র তো অনেক হলো, এসব টাইপকাস্ট চরিত্রকে ব্যাকফুটে ঠেলে 'মাই' এর 'শীল চৌধুরী'র মত লেয়ারড চরিত্রে তিনি ক্ষণেক্ষণে প্রকাশিত হবেন, দর্শককে মুগ্ধ করবেন, এখন মূলত আপ্ত-প্রত্যাশা সেটিই। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা