রোহিত শেঠির 'অল দ্য বেস্ট' সিনেমা দিয়ে তিনি আবার ধাবার রুটি-অমলেটের জীবন ছেড়ে বলিউডে ফেরেন। এই সিনেমায় যে অভিনয় তিনি করলেন, তাতে বিস্তর মানুষ হেসেছে। কিন্তু এই অভিনেতা প্রতিদিনের শুটিং শেষে ভ্যানিটি ভ্যানে গিয়ে কাঁদতেন। নিজের সদ্যপ্রয়াত বাবাকে মনে পড়তো তার। পর্দার হাসিমুখ আড়ালে ক্রমশ হারিয়ে যেতো ভীষণ ব্যক্তিগত বেদনায়৷ সে গল্প আমরা জানতাম না কেউই...

বেশ ক'মাস আগে 'কামিয়াব' নামে এক হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমার কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। একজন বয়স্ক আর্টিস্ট এখন পর্যন্ত ৪৯৯টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার ইচ্ছে, জীবনে আর একটি মাত্র সিনেমায় তিনি অভিনয় করবেন। এবং ৫০০তম এই সিনেমায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্রে অভিনয় করবেন। যাতে করে এই সিনেমায় তার অভিনয় দিয়ে লোকে তাকে মনে রাখে। এই লক্ষ্যের বাস্তবায়নে সেই অভিনেতা নেমে পড়েন ভালো একটি সিনেমার খোঁজে। এই যাত্রাপথে ক্রমশই যুক্ত হয় একাধিক মানুষ, বহুবিধ অনুষঙ্গ। গল্প এগোতে থাকে সামনে। 

সিনেমার সারসংক্ষেপ পড়েই বুঝতে পারার কথা, 'কামিয়াব' এর মূল গল্প এমন এক আর্টিস্টকে ঘিরে, যিনি তার ক্যারিয়ারে ৪৯৯টি সিনেমায় অভিনয় করলেও মনে রাখার মতন চরিত্র একটিও নেই সেখানে। কখনো ভিলেনের চ্যালা, কখনো আহত পথচারী কিংবা কখনো পুলিশের কনস্টেবল... এরকম চরিত্রে অভিনয় করা মানুষকে কেই বা মনে রাখে? 'কামিয়াব' এর প্রোটাগনিস্ট তাই জীবনের শেষ সিনেমায় ফ্রন্টরোলে থেকে অভিনয় করতে চান। সবাইকে দেখাতে চান, তিনি সাইড আর্টিস্ট না। তিনি মেইন আর্টিস্ট। তিনি প্রমাণ করতে চান, অভিনয়টা তিনিও পারেন। 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,  'কামিয়াব' সিনেমায় এই বয়স্ক আর্টিস্ট অর্থাৎ 'সুধীর' চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই অভিনেতাও বাস্তব জীবনে বহুবার অজস্র সিনেমায় অভিনয় করলেও সুখ্যাতি তিনি সেভাবে আজও পাননি। 'কামিয়াব' এর মূখ্য চরিত্রটির 'জনপ্রিয়' হওয়ার পাগলপন সংগ্রাম যেন এই অভিনেতাকে ভেবেই লেখা। যে অভিনেতার নাম সঞ্জয় মিশ্র। যাকে আমরা অনেকেই চিনি। আবার অনেকেই চিনি না। 

'কামিয়াব' সিনেমায় সেই পরিচিত সঞ্জয় মিশ্র! 

এখন পর্যন্ত তিনি কম সিনেমা, নাটকে অভিনয় করেন নি। 'হিপ হিপ হুররে'র চন্দ্রগুপ্ত স্যার কিংবা 'অফিস অফিস' এর শুক্লা স্যার হয়ে কখনো তিনি হাসিয়েছেন, আবার কখনো বিষাদে ভারী করেছেন হৃদয়। 'বিগ বি' অমিতাভ বচ্চনের সাথে কমার্শিয়ালে অভিনয় করেছেন। 'সত্য' কিংবা 'দিল সে'র মতন কালজয়ী সিনেমাতেও  যুক্ত ছিলেন তিনি। এসব নির্মাণে অভিনয়ের বরাতে তিনি হতে পারতেন প্রবল জনপ্রিয়। থাকতে পারতেন দুধেভাতে। কিন্তু কোনোকিছুই ঠিকঠাক ব্যাটে-বলে মেলেনি। 'সুখে থাকা'র সেই ভাগ্যটিই তাই আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি এই অভিনেতার। 

অথচ সঞ্জয় মিশ্র ভারতের গুরুত্বপূর্ণ 'ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা' থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন!  অভিনয় তিনি কী আর কতটুকু পারেন, তার স্বপক্ষে আলাদা কিছু না বলে প্রমাণ হিসেবে তার অভিনীত সিনেমাগুলোকেই রাখা যায় সামনে। কিন্তু এত দক্ষতা থাকা সত্বেও জীবনের গল্পটা মসৃণ হয় নি, 'জীবন' নামক ময়দানবকে আয়ত্বে আনা হয়নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সঞ্জয় 'এনএসডি' থেকে বের হওয়ার পরে অভিনয়ের মূলস্রোতে ঢোকার জন্যে করেছেন বহুকিছু৷ অভিনয়, পরিচালনা, ক্যামেরাওয়ার্ক, লাইটিং, ফটোগ্রাফি...যুক্ত হয়েছেন বহুকিছুর সাথে। পাগলের মত একেক ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছেন। কিন্তু এরপরেও কেন যেন অচ্ছ্যুতই থেকে গেছেন বহুদিন। কেউ ডাকেনি। না অভিনয়ে। না অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টে।

'গোলমাল' এ অন্য অবতারে তিনি! 

এরপর একসময়ে মুক্তি পেয়েছে তার প্রথম সিনেমা 'ওহ ডার্লিং! ইয়ে হ্যায় ইন্ডিয়া।' এখান থেকেই শুরু। এরপর ২৫ বছর ধরে অজস্র সিনেমার সাথে যুক্ত থেকেছেন। যদিও 'কমেডি অ্যাক্টর' হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়তা তার, কিন্তু সিরিয়াস সব প্রজেক্টেও তিনি কাজ করেছেন বিস্তর। একের পর এক কাজ করে গিয়েছেন। পেটের তাগিদে। পকেটের তাগিদে। যদিও কী কমেডি, কী সিরিয়াস...মাঝখানের এক সময়ে কোনো চরিত্রেরই ডাক পাচ্ছিলেন না। অর্থাভাবে এই অভিনেতা তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সে সময়েরই এক গল্প বলা যাক। 

'অফিস অফিস' সিনেমার শুটিং চলছে তখন। পাকস্থলীতে আচমকা সমস্যা দেখা দেয় তার। তিনি তৎক্ষনাৎ ডাক্তারের দ্বারস্থ হলেন। ডাক্তার জানালেন- পাকস্থলীর ইনফেকশন হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করা হলো। পাকস্থলী থেকে ১৫ লিটার পুঁজ বের হলো। পনেরো দিন পরে তিনি যখন হাসপাতাল থেকে খানিকটা সুস্থ হয়ে বের হবেন, তখন জানতে পারেন- তার বাবা মারা গিয়েছেন। ভেঙ্গে পড়লেন সঞ্জয়। মুম্বাই ফেরার কথা ছিলো। তিনি আর ফিরলেন না। পকেটের সঞ্চয়ও তখন গড়ের মাঠ। সঞ্জয় পথ বাড়ালেন নিরুদ্দেশের পথে। 

ঘুরতে ঘুরতে চলে যান ঋষিকেশ। সেখানের এক ধাবায় ১৫০ টাকা বেতনে কাজ করা শুরু করেন। ততদিনে 'গোলমাল' এ অভিনয় করে বেশ খানিকটা জনপ্রিয় মুখ তিনি। অনেকেই এই ধাবায় খেতে এসে চিনতে পারতেন তাকে। তার সাথে ছবি তোলার আবদার করতেন। ধাবার যে মালিক, তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখতেন এই ঘটনা। পরে তিনি জানতে পারেন, সঞ্জয় মিশ্র একজন অভিনেতা। শুনে প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছিলেন এই ধাবা-মালিক। 

রোহিত শেঠির 'অল দ্য বেস্ট' সিনেমা দিয়ে তিনি আবার ধাবার রুটি-অমলেটের জীবন ছেড়ে বলিউডে ফেরেন। এই সিনেমায় যে অভিনয় তিনি করলেন, তাতে বিস্তর মানুষ হেসেছে। কিন্তু এই অভিনেতা প্রতিদিনের শুটিং শেষে ভ্যানিটি ভ্যানে গিয়ে কাঁদতেন। নিজের বাবাকে মনে পড়তো তার। পর্দায় আমরা যে হাসিমুখ দেখতাম বা যে মুখ 'ঢন্ডু, জাস্ট চিল' বলে হাসাতো, সে হাসিমুখই পর্দার আড়ালে ক্রমশ হারিয়ে যেতো ভীষণ ব্যক্তিগত বেদনায়৷ সে গল্প আমরা জানতাম না কেউই।

সঞ্জয় মিশ্রের পঁচিশ বছরের এই দীর্ঘ ফিল্ম-ক্যারিয়ারে একাধিক  মনে রাখার মতন চরিত্র। রাজা কাপুরের 'আঁখো দেখি'তে বাউজি' চরিত্রে অভিনয় করে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। 'সারে জাহান সে মেহঙ্গা'তেও ছিলেন লিড রোলে। ভুতনাথ রিটার্নস, গোলমাল ফ্রাঞ্চাইজি, কিক, দম লাগা কে হেইসা, নিউটনের মতন জনপ্রিয় সিনেমাগুলোতেও ছিলেন ছোটখাটো রোলে। কাজ করেছেন বিস্তর, তা আগেই লেখা হয়েছে। কিন্তু সাফল্য? সব প্রশ্ন কেন যেন নিয়মিতই অপ্রস্তুত হয়েছে এই এক চোরাস্রোতের মুখোমুখি এসে। 

হাসির আড়ালে লুকোনো বিষাদ! 

সাফল্য বাদই রইলো, জনপ্রিয়তাও ততটুকু পান নি, যতটুকু প্রাপ্য ছিলো তার। তবুও পর্দায় এই মানুষটি এলেই মুখ ভরে ওঠে হাসিতে, মস্তিষ্ক এই ভেবে নির্ভার হয়- এখন হয়তো মজার কিছু হবে, হয়তো এটাই সঞ্জয় মিশ্র'র সবচেয়ে বড় কারিশমা। যিনি এই প্রচণ্ড টালমাটাল সময়েও মানুষকে হাসানোর দুরূহ কাজটি করেন। যিনি নিজের ব্যক্তিগত বিপর্যয় সামলে মানুষের সামনে ঠিক ততটুকুই আনেন, যতটুকু মানুষকে সামান্য হলেও যাপিত ক্ষত পূরণের রসদ দেয়। তবুও এতসবের ভীড়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, একটা নির্মাণের প্রোটাগনিস্ট আর্টিস্টদের জন্যে এত সব আয়োজন যেখানে, সেখানে সঞ্জয় মিশ্রদের জন্যে ছিঁটেফোঁটাও নেই কেন? কেন পেটের তাগিদে অভিনয় ছেড়ে এই অভিনেতাদের চলে যেতে হয় বারবার? কেন এই অভিনেতাদের জন্যে আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের? কেন সিনেমার মতন বাস্তবেও এরা সাইড ক্যারেক্টার হিসেবেই থেকে যান যাবজ্জীবন!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা