'সারফারোশ' এর মত কপ থ্রিলার আবার কবে বানাবে বলিউড?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

রোহিত শেঠির 'কপ ইউনিভার্স' কিংবা 'দাবাং' এর চুলবুল পান্ডে- বলিউডি রিসেন্ট 'কপ ড্রামা'গুলোয় গল্পের চেয়েও যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হয় প্রোটাগনিস্টের পেশিবহুল দেহ, ক্রিস্পি ডায়লগ আর আকাশে উড়ন্ত গাড়ি! অথচ, গল্পনির্ভর 'কপ ড্রামা' যে কতটা অসাধারণ হতে পারে, তা দেখিয়েছিলো 'সারফারোশ।' যে সিনেমার মুগ্ধতা নিয়ে কথা হয় আজও। অজস্র দাবাং-সিংঘাম আসবে, কপ ইউনিভার্স বানানো হবে, কিন্তু আরেকটা সারফারোশ কি দর্শক কখনও পাবে?
ইদানীংকালে যখন কোনো বলিউডি সিনেমা দেখতে বসি, তখন অবধারিতভাবেই খানিকটা তটস্থ থাকতে হয়। তটস্থ হওয়ার প্রধান কারন- গল্পের মাত্রাহীনতা। অবাক হয়েই লক্ষ্য করি, যত সময় যায়, ততই কেন যেন পাল্লা দিয়ে সিনেমাগুলোর গল্পের গভীরতা কমে। গল্পের জায়গায় ক্রমশই জুড়ে বসে চটকদার মালমশলা। যৌনতা, অ্যাকশন, টেকনোলজি, সিজিআই... যুক্ত হয় নানা কুশীলবও। ফলশ্রুতিতে, যে গল্পকে বলা হয় নির্মাণের মেরুদণ্ড, সেটিই ক্রমশ হয় কমজোরি, অসহায়। রোমান্টিক সিনেমাই বলি কিংবা সোশ্যাল ড্রামা, মোটামুটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এ কথা। তবে, এরমধ্যেও এককাঠি সরেস, বলিউডি 'কপ ড্রামা।' রোহিত শেঠির 'কপ ইউনিভার্স' কিংবা 'দাবাং' এর চুলবুল পান্ডে... বলিউডি রিসেন্ট 'কপ ড্রামা'গুলোয় গল্পের চেয়েও যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হয়- প্রোটাগনিস্টের পেশিবহুল দেহ, ক্রিস্পি ডায়লগ আর অ্যাকশনের দক্ষযজ্ঞে আকাশে উড়ন্ত গাড়ি!

অথচ, যদি টাইম মেশিনে চেপে যাওয়া যেতো বেশ কিছু বছর আগে, তাহলেও বলিউডি এমন সব 'কপ ড্রামা' ফিল্ম পাওয়া যেতো, যেসব সিনেমায় মূখ্য ছিলো গল্পই। পাশাপাশি, সেসব সিনেমার নায়কেরাও ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ। তারা সুপারহিরো ছিলেন না। হওয়ার বাসনাও ছিলোনা। মহামানব হওয়ারও ভেক ধরতেন না তারা। সাধ্যের মধ্যে থেকেই তারা পালন করতেন যাবতীয় দায়িত্ব, যাপিত আয়োজন। এরকম সিনেমার মধ্যে এইমুহুর্তে যেমন মনে পড়ছে- খাকি, শূল, যশবন্ত, জাঞ্জিরের কথা। তবে, এদেরও আগে মনে পড়ছে আরেকটি সিনেমার কথা। যে সিনেমা বুঝিয়েছিলো- 'কপ ড্রামা' আসলে কেমন হওয়া উচিত, এই জঁরার সিনেমার গল্প কেমন হওয়া উচিত, গল্পের নায়ক কেমন হওয়া উচিত। সে সিনেমার নাম- সারফারোশ। সে সিনেমা নিয়েই আজকের কথাবার্তা।
'সারফারোশ' মোটাদাগে এক পুলিশ অফিসারের আখ্যান। যে পুলিশ অফিসারের নাম- অজয় সিং রাথোড়। মেডিকেল স্টুডেন্ট 'অজয়' পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেশ সুখের একটা সময়ই পার করছিলো। কিন্তু আচমকাই উগ্রপন্থীদের হামলা ও নির্যাতনে তার পুলিশ বাবা 'প্যারালাইজড' হয়ে যান। এখানেই শেষ না। উগ্রপন্থীদের হামলায় অজয়ের বড়ভাইও মারা যান তার চোখের সামনে। এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এই একটি ঘটনাই অজয়ের জীবন পালটে দেয় পুরোপুরি। সে মেডিকেল কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। যোগ দেয় পুলিশ বাহিনীতে। প্রতিজ্ঞা করে- এই উগ্রপন্থীদের শেষ দেখে ছাড়বে সে!
পুরো সিনেমাজুড়েই 'অজয় রাথোড়' একজন 'নো-ননসেন্স' পুলিশ অফিসার। এসিপি। সিনেমার শুরুতেই তার পারিবারিক ক্রাইসিস জানার ফলে দর্শকও সিনেমার একেবারে প্রথমাংশ থেকেই ভালোভাবে হুকড হয় সিনেমার সাথে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই যে ক্রাইসিসের বিষয়টা, এটা খুব নিষ্পৃহভাবেই দেখানো হয়। কেন এই বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলছি, সেটা বোঝানোর জন্যে এখানে একটা বিষয় আলাদাভাবে জানানো দরকার। সেটি হচ্ছে- 'সারফারোশ' মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯৯ সালে। আর কেই বা না জানে, নাইন্টিজের সিনেমাগুলোর 'ওভার ড্রামাটিক' অত্যাচার কতটা মারাত্মক ছিলো! কিন্তু, তবুও, এই টাইমফ্রেম বিবেচনায়, 'সারফারোশ' এর ন্যারেশন-স্টাইল যে অনেকটাই এগিয়ে ছিলো, তা সিনেমার এই প্রাথমিক নির্মেদ গল্পবয়ান বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করে। সিনেমার মুগ্ধতাও শুরু হয় তখন থেকেই।

এবার, লেখার এ পর্যায়ে এসে যদি 'সারফারোশ' এর সাথে বর্তমানের কোনো 'কপ ড্রামা'র তুলনা করি, সেখানে বেশ বড়সড় এক তফাত তৈরী হবে। সেটি ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের তফাত। 'এসিপি অজয় সিং রাথোড়' এর ফ্যামিলি ক্রাইসিস দেখিয়ে যেভাবে 'সারফারোশ' এর প্রধান চরিত্রকে স্টাবলিশ করা হয়েছিলো এই গল্পে, এরকম প্রপার ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট ইদানিংকালের কয়টা 'কপ ড্রামা'তে পাওয়া যাবে? সূর্যবংশীই বলি কিংবা সিম্বা... তাদের কোনো প্রোটাগনিস্টের গল্পই কি এরকম ওয়েল ডেভেলপড... প্রশ্ন থাকে। থেকেই যায়।
যাই হোক 'সারফারোশ' এ ফিরি আবার। সিনেমা এগোতে থাকে। এসিপি অজয় সিং রাথোরেরও গল্প এগোয়। 'পুলিশ অফিসার' ছাড়াও অজয় সিং এর অন্যান্য যে পরিচয়, সেসবও ক্রমে ক্রমে পাওয়া যায়। জানা যায়, সে গজলের একনিষ্ঠ ভক্ত। এবং এই গজলের বরাতেই বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী গুলফাম হাসান (নাসিরুদ্দিন শাহ) এর সাথে তার সম্পর্কও ক্রমশ গাঢ় হয়। পাশাপাশি, অজয় সিং এর সাথে সীমার যে মিষ্টি প্রেম... সে অংশও অন্য এক অজয়ের পরিচয় দেয়। এখানে উল্লেখ্য, 'সীমা' চরিত্রে সোনালী বেন্দ্রের যে অভিনয়, সে অভিনয়েরও আলাদা ব্যাপ্তি পুরো সিনেমাজুড়েই প্রকট। বর্তমানের 'কপ ড্রামা'গুলোতে নায়িকার অবস্থান যেরকম আলঙ্কারিক, 'শো-পিস' হিসেবে খানিকটা শোভাবর্ধন করা ছাড়া যাদের অন্য কোনো ভূমিকা নেই, ঠিক সে অবস্থানে দাঁড়িয়ে 'সারফারোশ' এর 'সীমা' চরিত্রের যে বিকাশ, তা আলাদা দ্যোতনাই দেয়। এবং তার সাথে অজয়ের যে রসায়ন, সেটাও সিনেমাকে বেশ স্বকীয় এক সাবপ্লটের দিকেই নিয়ে যায়।
তবে ভুললে চলবে না, অজয়ের গজল-প্রীতি কিংবা সীমার সাথে তার প্রণয়-আখ্যান এ সিনেমার উপজীব্য না। এ সিনেমার উপজীব্য এক পুলিশ অফিসার এবং সে পুলিশ অফিসারের অন্যায়ের সাথে সংগ্রাম। এবং সিনেমা সেভাবেই, সাবপ্লটগুলোকে হালকাচালে অ্যাড্রেস করে ক্রমশই মূল পথে শুরু করে যাত্রা। তবে, মাথায় রাখা লাগবে এটিও, এই যে সাবপ্লট, এসবের সাথেও সিনেমার ক্লাইম্যাক্সেরও এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, চাইলেও তাই এই সাবপ্লটগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না।
এবং এভাবেই 'সারফারোশ' ক্রমশ ভাঁজ খোলে, আনন্দ দেখায়। যে ভাঁজের এক অংশে থাকে কাঁটাতারও। অর্থাৎ, ভারত-পাকিস্তান। অর্থাৎ, চলে আসে ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম। কিন্তু সাম্প্রতিককালের 'কপ ড্রামা'তে আমরা যেরকম লাউড প্যাট্রিওটিজম দেখি, সেখান থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অবয়বে 'সারফারোশ' এ 'অজয়' এর দেশপ্রেম হয়ে থাকে আড়ম্বরহীন, রিলেটেবল দেশপ্রেম। এবং এই 'দেশপ্রেম'কে যেভাবে আমির খান 'এসিপি অজয়' চরিত্রে পোর্ট্রে করেন, সেটাও হয়ে থাকে দুর্দান্ত এক এক্সাম্পল।
অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে যদি কোনো সিনেমা ডিল করে তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, কতটুকু ঠিকঠাকভাবে করা হলো সব। কোনো ইস্যু এসে আরেকটিকে ওভারল্যাপ করলো কী না। এবং, 'সারফারোশ' এর মূল চমৎকারিত্ব পাওয়া যায় মূলত সেখানেই। এ সিনেমায় দেশপ্রেম, অ্যাকশন, সাসপেন্স, রোমান্স, ট্রাজেডি, ড্রামা... আছে সবই। কিন্তু প্রতিটি উপাদানই এমনভাবে পাশাপাশি বজায় থাকে, আশ্চর্য সহাবস্থানই মনে হয়। পাশাপাশি, 'টিপিক্যাল বলিউডি মাসালা ফিল্ম' এর যে অর্থোডক্স ক্যামিও, সেগুলোকেও এ সিনেমা এমনভাবে ইগনোর করে যায়, যা মুগ্ধ করে। চটকদার কোনো কিছুকে ফোকাস না করে এ সিনেমা যেভাবে মূল প্রসঙ্গকে উপজীব্য করে এগোতে থাকে সামনে, সেটাও চমৎকৃত করে ক্ষণেক্ষণে।
যেকোনো সিনেমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব থাকে, দর্শককে কনভিন্স করা। 'সারফারোশ' সে দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন তো করেই, পাশাপাশি, এই সিনেমায় 'অজয় সিং রাথোড়' চরিত্রে আমির খানের অভিনয়ও দাগ কেটে যায় ভেতরে। আবার, তাকে চ্যালেঞ্জ চালানোর জন্যে অ্যান্টাগনিস্ট 'গুলফাম হাসান' চরিত্রে নাসিরুদ্দিন শাহও করেন দুর্দান্ত অভিনয়। 'ডার্ক' এই ক্যারেক্টারের ন্যুয়ান্স তিনি যেভাবে সামলান, চমৎকারিত্বের বিষয় হয়ে যায় সেটাও। পাশাপাশি, এ সিনেমায় বাদবাকি যারা কাস্ট, সহশিল্পীদের কারো অভিনয়েই বলার মত কিছু থাকে না। নিজ নিজ জায়গা থেকে দুর্দান্ত অভিনয়ই করে যান তারা।

এবং ঠিক সে কারণেই, দ্ব্যর্থকন্ঠে এটা বলাই যায়, 'কপ ড্রামা' অনেক হয়েছে, হয়তো সামনেও হবে। 'কপ ইউনিভার্স' হয়েছে, সামনে হয়তো 'কপ মাল্টিভার্স'ও হবে। কিন্তু এক 'সারফারোশ' এর পর্যায়ের সিনেমা বানাতে হলে শুধু টেকনোলজি ও মশলার উপরে ভরসা রাখলে হবেনা, প্রধান মনোযোগ রাখতে হবে গল্পে, গল্পে এবং শুধুমাত্র গল্পেই। মূলত, মোদ্দাকথা এটাই। এবার, এটাও বলার, গল্প না থাকলে যে সিনেমা হবেনা, তা না। সিনেমা হবে। সে সিনেমা হয়তো হাততালিও পাবে। কিন্তু, তেইশ বছর পরে এসেও সে সিনেমা নিয়ে কথা বলা, যেটা 'সারফারোশ' এর ক্ষেত্রে হয়, সেটাই আর সেসব সিনেমার ভাগ্যে জুটবেনা। তবে, 'সিনেমা-সংশ্লিষ্ট'রা কি এরকম অমরত্ব চান, নাকি চান হালফিল জনপ্রিয়তা... তা একান্তই তাদের বিবেচনা। সেসব নিয়ে আলাদাভাবে কিছু না বলাই তাই সমীচীন।