একটা সিনেমার গল্প, ন্যারেশন স্টাইল, অ্যাক্টিং, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেম্যাটোগ্রাফি, এডিটিং, ডিরেকশন- সবগুলো বিভাগ যদি এমন টপ নচ হয়, তাহলে সেই বিশেষ চলচ্চিত্র নিজেও যে অনবদ্য হবে, দারুণ মুগ্ধতা ছড়াবে, তা হয়তো আলাদা করে আর বলতে হয় না...

মধ্য-সত্তরের তামিলনাড়ু। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কোনো সংস্রব নেই তামিলনাড়ু সরকারের । কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে পুরোপুরি স্বতন্ত্র হয়ে আছেন তারা। পুরো দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। সবখানে অস্থিরতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্দল, ঠোকাঠুকি নিয়মিতই বাড়ছে। এরকমই এক থমথমে, অস্বস্তিকর সময়ে 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর গল্প শুরু। 

তামিলনাড়ুর ছোটখাটো এক জনপদের বক্সিং এর দুটি দলের মধ্যে বেশ ক'বছর ধরে প্রবল রেষারেষি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের একটির নাম- সারপাট্টা পারাম্বারাই। আরেক দলের নাম- ইডিয়াপ্পা পারাম্বারাই। 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর বক্সারদের একসময় প্রবল পরাক্রম থাকলেও আজ তারা পরাজয়ের ভারে লীন। তাদের কোচ রঙ্গন চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন নি, কিন্তু তবুও শেষে এসে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অধরাই থেকে গিয়েছে বরাবর। প্রতিদ্বন্দ্বী ইডিয়াপ্পা পারাম্বারাই এর কাছে নিয়মিত হার হয়েছে অমোঘ নিয়তি। 'কোচ রঙ্গন' স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় কমরেডও। তার দলকে শিরোপা জিতিয়ে ফ্রন্টলাইনে আনার জন্যে নিয়মিত চাপ সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে পেলেও কোচ রঙ্গনের ভাগ্যে শিকেই যেন আর ছিঁড়ছেনা।

এরকমই এক সময়ে, নেহায়েত ঘটনাক্রমে 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এ ঢুকে পড়ে কাবিলান নামে স্থানীয় এক তরুণ, যার বাবা বক্সিং এর জেরে মারা গেছেন বহুকাল আগে, যার মা চান না, ছেলেরও বাবার মতন একই পরিণতি হোক, তাই বক্সিং থেকে ছেলেকে দূরে রেখেছেন বহুদিন, এদিকে কোচ রঙ্গনও চান না, এই ছেলে বক্সিং এ আসুক। কারণ, ছেলেটার আর যাই থাকুক, বক্সিং এর প্রাথমিক জ্ঞান নেই। তবুও নানামুখী বিরুদ্ধস্রোত উপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত কাবিলান 'বক্সিং রিং' এ ঢোকে। নানা ঘটনার সূত্রে একপর্যায়ে এসে 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর আশাভরসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায় এই তরুণ৷ প্রত্যাশার ভার ক্রমশই যখন বাড়ছিলো, তখনই আচমকা ছন্দপতন। এবং মূল গল্প তখন থেকেই শুরু। 

বক্সিং নিয়ে যে সিনেমাই বানানো হোক না কেন, হলিউডের ক্লাসিক সিনেমাগুলোর তুলনা চলেই আসে। রকি, সিনড্রেলা ম্যান, দ্য রিং, রেজিং বুল, দ্য বয় ফ্রম ব্রুকলিন...অজস্র সব কালজয়ী নির্মাণ। এখনকার নির্মাতারা 'বক্সিং' নিয়ে যদি কোনো সিনেমা বানাতে চান, তারা যতই সচেতন থাকুক না কেন, না চাইতেও ক্লাসিক এসব সিনেমার সাথে মূল প্রেরণার জায়গায় সাদৃশ্য চলেই আসবে। সেটা অনুপস্থিত না 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর ক্ষেত্রেও। পরিচালক তা যেন মেনেও নিয়েছেন। তিনি তাই চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন অন্যদিকে। যে চমৎকারিত্ব, বক্সিং এর সাথে তৎকালীন রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজের দুর্দান্ত মিশ্রণে! 

পা. রাঞ্জিত চমক দেখিয়েছেন গল্পের বিন্যাসে! 

'খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না' নামক প্রচণ্ড খেলো ও ফাঁপা কথাটি অনেক বুজুর্গ ব্যক্তিই মাঝেমধ্যেই বলার চেষ্টা করেন। নির্জলা এই অসত্য আহ্বান কে থোড়াই কেয়ার করেন নির্মাতা পা. রাঞ্জিত। এই নির্মাণে তিনি ক্রমশই দেখান, খেলার সাথে রাজনীতির সমানুপাতিক সম্পর্কের ক্রমবিন্যাস। তিনি জানতেন, বক্সিং নিয়ে যে সিনেমাই হোক না কেন, সেটা  নিয়ে তুলনা হবে, সমালোচনা হবে। তাই তিনি বক্সিং এর সাথে সত্য ইতিহাস মিশিয়ে এমন এক দুর্দান্ত পিরিয়ড ড্রামা তৈরী করলেন, এত এত গল্পকে এক সুতোয় এনে গাঁথলেন...যেন তিনি বলতে চাইলেন, চাইলে চেনা-পরিচিত গল্প দিয়েও মুগ্ধতা ছড়ানো যায়! 

সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম গল্পের নিখুঁত বর্ণনায়। বক্সিং কে কেন্দ্র করে অগুনতি সব আবেগ, রাজনীতি, হিংস্রতা, বন্যতা, দ্বন্দ্ব, দ্বৈরথ, ঘাম-রক্ত-বিষাদের সমীকরণকে যেভাবে একনাগাড়ে দেখিয়ে গেলেন নির্মাতা, চোখের পলক বা নড়ার সুযোগও রইলো না। সিনেমার দৈর্ঘ্য প্রায় তিন ঘন্টা, অথচ বিরক্তি বা উশখুশ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই...এহেন বিরল অভিজ্ঞতা সম্প্রতি দেখা মালায়ালাম 'মালিক' এর পরে এই দ্বিতীয়বার। পা.রঞ্জিত ঠিক এখানেই বাজিমাত করেছেন। ক্যানভাস টা তিনি নিয়েছেন জটিল, কিন্তু প্রকাশ করেছেন একেবারে নিখুঁত সারল্যে।

কেউ যদি বক্সিং-সম্পর্কিত সিনেমাগুলোর পাঁড়ভক্ত হয়ে থাকেন, বুঝতে পারবেন, এই জনরার সিনেমাগুলোর নকশা মোটামুটি একরকমই। সে হলিউডই বলি, বলিউডই বলি বা অন্য কোথাও। কিন্তু সেরকমই এক প্রেডেক্টিবল স্ট্রাকচার এর নির্মাণে এরকম চমকে যেতে হবে, তা দূরতম চিন্তারও বাইরে। সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমাগুলোর স্টোরিটেলিং আলাদা মাত্রার অনবদ্য হয়, সেটা নতুন কিছু না। কিন্তু প্রত্যেকটা চরিত্র ধরে ধরে এভাবে এগোনো, তাদের ব্যাকস্টোরি প্রপারলি ডেভেলপ করা, প্রত্যেক ক্যারেক্টারকে জাস্টিস করা, ক্যারেক্টারগুলোর সাটল সব আর্ক বের করে প্রচ্ছন্নভাবে সেগুলোকে মূল গল্পের সাথে মিশিয়ে দেয়া...'সারপাট্টা পারাম্বারাই' টেকনিক্যালি কতটা যে সাউন্ড, তা নিয়ে চাইলে গবেষণা হতেই পারে। 

প্রোটাগনিস্ট 'কাবিলান' চরিত্রে আরিয়া এবং 'রাঙ্গান ভাটিয়ার' চরিত্রে পশুপতি রীতিমতো কাঁপিয়েছেন। আরিয়া'র বডি স্ট্রাকচার এমনিতেই বক্সারদের মতন, তাই আলাদা এক সুবিধে পেয়ে পুরো সিনেমাজুড়ে যেভাবে হাত, পা, মাথা, চোখের অভিনয় করেছেন, তার জন্যে প্রশংসাও কম হয়ে যাবে। তবে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন পশুপতি। উপরে শক্ত আবরণের আড়ালে নরম হৃদয়ের এক তিতিবিরক্ত বক্সিং কোচ চরিত্রে একেবারে প্রথম সিন থেকে যে অভিনয় করলেন, সে অভিনয়ের রাশ ছাড়েন নি শেষে এসেও। তিনি যে তামিল ইন্ডাস্ট্রির দুঁদে অভিনেতা, তা চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন আরেকবার। বাকি কুশীলবদেরও বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। অ্যান্টাগনিস্ট 'ভেম্বুলি' চরিত্রে জন কোক্কেন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান 'ড্যাডি' চরিত্রে জন বিজয়, 'ড্যান্সিং রোজ' চরিত্রে শাবির কাল্লারকাল...সবাই অনবদ্য। এমন কী, দুই তিন মিনিটের রানটাইমও যারা পেয়েছেন তারাও ছাড়েননি। মাটি-কাঁপানো অভিনয় করে গিয়েছেন।

কোচ রাঞ্জান, ড্যাডি, কাবিলান...তিন রত্ন! 

আসি নেপথ্যের কুশীলবদের প্রসঙ্গে। শেষ বোধহয় টিভি সিরিজ 'স্ক্যাম ১৯৯২' এর বিজিএম শুনে চমকেছিলাম। 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর বিজিএম শুনে আরেক দফা চমকালাম। 'মিউজিক ডিরেক্টর' সন্তোষ নারায়ণ যেন অন্তর্যামী, দর্শক হৃদয়ের ওঠানামা বুঝে একেবারে ঠিকঠাক টাইমিং এ কলজে-কাঁপানো সব ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দিয়ে গেলেন সিনেমার পুরো সময়ে। কুর্নিশ! সিনেম্যাটোগ্রাফিও আরেক দর্শনীয় বস্তু এ সিনেমার। সত্তরের বক্সিং সেটের নিখুঁত ডিজাইন থেকে থেকে শুরু করে প্রোটাগনিস্টের ইমোশনের সাথে সাথে ফ্রেম, লাইট, কালারের তারতম্য... বিস্মিত হলাম। সিনেম্যাটোগ্রাফার 'মুরালি জি' এমনিই বিখ্যাত। এই সিনেমার দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি তাকে আরেক দফা বিখ্যাত করলে বিস্মিত হবো না।

সিনেমার এডিটিং এ ছিলেন 'সেলভা আর কে।' তার উপর দায়িত্ব ছিলো, পুরো সিনেমাজুড়ে যত গল্পই আসুক না কেন, কখনোই মূল গল্প অর্থাৎ 'বক্সিং' থেকে সরে যেতে পারবে না দর্শকের চোখ।  এডিটিং হতে হবে সেরকম, দর্শকের মনস্তত্ব বুঝে। এ কাজটাই সবচেয়ে কষ্টের। লেয়ারড ফিল্মের মেইন লেয়ারকে ফোকাসে রেখে অজস্র সব সাইড-লেয়ার এনেও ব্যালেন্স রাখতে যে মিতব্যয়ী এডিটর হওয়া দরকার, সেলভা আর কে সেটাই যেন দেখালেন। একটা নির্মাণের গল্প, ন্যারেশন স্টাইল, অ্যাক্টিং, বিজিএম, সিনেম্যাটোগ্রাফি, এডিটিং, ডিরেকশন- সব যদি এমন টপ নচ হয়, তাহলে নির্মাণ যে অনবদ্য হবে, তা আলাদা করে না বলাই সম্ভবত প্রাসঙ্গিক।

সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন সন্তোষ নারায়ণ! 

খুব সম্প্রতি বক্সিং নিয়ে নির্মিত রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা'র 'তুফান' দেখলাম। ক্লিশে গল্প, বিরক্তিকর এক্সিকিউশন এবং জোরপূর্বক আবেগের মোচ্ছব খুলে বসেছিলো যেন সবাই সেখানে। সেই বিরক্তি কাটানোর জন্যেই যেন আশীর্বাদের মতন মুক্তি পায় 'সারপাট্টা পারাম্বারাই!' জটিল এক বিস্তীর্ণ ক্যানভাস নিয়ে এরকম টানটান নির্মাণ; মনে থাকবে অনেকদিন। এখানে উল্লেখ্য, পরিচালক পা. রানজিৎ ক্যারিয়ারের শুরুতেই দুর্দান্ত কিছু সিনেমা বানিয়ে 'সম্ভাবনাময় পরিচালক' হিসেবে লাইমলাইট পেয়েছিলেম। কিন্তু তা সত্বেও মাঝখানে গতানুগতিক কিছু সিনেমার পরিচালক হয়ে ব্যাকফুটে চলে যান একসময়ে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এই দারুণ নির্মাণ যেন অপোনেন্টের চোয়ালে দুর্দান্ত এক আপারকাট! যেন 'সারপাট্টা পারাম্বারাই' এর মূল গল্প মেটাফোরিক্যালি হয়ে গেলো পা.রাঞ্জিৎ এর জীবন-গল্পই। 

পুরো সিনেমায় দাপিয়ে অভিনয় করেছেন 'কাবিলান' ওরফে আরিয়া! 

বক্সিং-কেন্দ্রিক উপমহাদেশের সিনেমাগুলোর মধ্যে আলাদা এক বেঞ্চমার্কেই উঠে গিয়েছে সারপাট্টা পারাম্বারাই।  আফসোস একটাই, এ সিনেমা বড়পর্দায় দেখতে পারলেন না স্থানীয়রা। ল্যাপটপের স্ক্রিনেই এ সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য গায়ে যেভাবে কাঁটা ধরিয়েছে, প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় এ সিনেমা কী দাবানল ছড়াতো, তা ভাবনারও অতীত! এটুকুই যা আক্ষেপ, বাকিসব বিমুগ্ধ প্রশংসা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা