
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা ভিএফএক্সের টুডি-থ্রিডি সিনেমা দেখে মুগ্ধ হই। সত্যজিৎ রায় সেই সময়ে মিউজিক, কতোগুলো লোহার পাত আর আলোর নানা রকমের ব্যবহার দিয়ে যা অ্যানিমেশন করেছেন, সেই আবেদনের কাছে হার মানবে এখনকার জটিল প্রযুক্তি...
তিনি সিনেমা বানানোর আগে যে বাংলা ভাষায় ভালো সিনেমা হয়নি তা একদমই নয়। তবে খুব সহজ আর সাবলীলভাবে সত্যজিৎ রায় হঠাৎ করেই সেলুলয়েডে হাজির করলেন এক অন্যরকম ডাইমেনশন। তার সিনেমা যেনো শুধু সিনেমা না দর্শকদের কাছে একটা নতুন জার্নি। নিজেকে, সমাজকে, দেশকে ভিন্নভাবে দেখার এবং অনুভব করার একটা মন্ত্র। আজ এই মহান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের ১০১ তম জন্মবার্ষিকী। এই বিশেষ দিনে তাকে নিয়ে এই বিশেষ ফিচার।
ভারতীয় কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়, তারিখটা ছিলো ১৯২১ সালের ২রা মে। তবে তাঁর পৈত্রিক নিবাস তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে। বিখ্যাত লেখক, চিত্রকর ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর নাতি এবং বাংলা সাহিত্যের জনক সুকুমার রায়ের ছেলে। সেই হিসেবে শুধু লেখক হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিলেও বেশ হতো ব্যাপারটা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাটা হয়তো অন্যকিছু ছিলো। বাংলাভাষার সিনেমার এক ভিন্ন অর্থ সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীর সামনে সেটা তুলে ধরার দায়িত্ব সত্যজিৎ রায় নিয়ে নিবেন তা মনে তার কাছের মানুষ তো পরের কথা তিনি নিজেও জানতেন না।
ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১০০ বছরে পা দিয়েছেন বিখ্যাত লেখক, পরিচালক সত্যজিৎ রায়। করোনা পরিস্থিতির আবির্ভাব না ঘটলে যে ঘটা করে আজকের দিনটি দুই বাংলায় তথা বিশ্বের সিনেমাপ্রেমী মানুষ পালন করতো আজ সেটি হয়নি তবে সিনেপ্রেমীদের মনে তিনি চিরকালই একটি বিশাল অংশ দখল করে রাখবেন একথা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। সারাবিশ্বের কাছে সত্যজিৎ রায় হিসেবে পরিচিত হলেও তৎকালীন কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা কাছের মানুষদের কাছে তিনি 'মানিক' নামেই পরিচিত। সিনেমাজগতে সবার কাছে প্রিয় 'মানিকদা'।
সত্যজিৎ রায়ের শুরুটা একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় ৮০ টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে। সেখানে একজন ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, এখনকার সময়ে যাকে আমরা গ্রাফিক ডিজাইনার বলি। এই কাজের সাথে সাথেই একটি প্রকাশনা সংস্থার জন্য বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করা শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'র ছোটদের জন্য সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু'র প্রচ্ছদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। পরে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, এই প্রচ্ছদের কাজ করার সময়ই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, সুযোগ পেলে এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবেন। কারন সেই সময়টায় কাজের ফাকে ফাকে বিশ্ব-সিনেমার চর্চা শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। ভিন্ন ধারায় ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সত্যজিৎ। সেই স্বপ্ন থেকেই চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে সত্যজিৎ খুলে ফেলেন 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি'। বহু বিদেশি সিনেমার স্ক্রিনিং করালেন। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। চারিদিকে উত্তাল পরিস্থিতি। এরই মাঝে সত্যজিৎ ঠিক করলেন তাঁকে নিজের মতো করে কিছু গল্প বলতে হবে। যে গল্পগুলো শুধু বইয়ের পাতায় নয়, সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরতে হবে।
সেই সময় কাজের সুবাদে তার কোম্পানি তাকে লন্ডনে পাঠায়। হঠাৎ করেই পাওয়া এই সুযোগের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের রাস্তা যেন পরিষ্কার দেখতে পান সত্যজিৎ। সিনেমা বানানোর মুন্সিয়ানা শেখার জন্য পাগলের মত সিনেমা দেখতে থাকেন, পড়তে শুরু করেন সেই সময়ের আলোচিত নির্মাতাদের লেখা নানা ফিচার। কিছু স্টুডিও ঘুরে ঘুরে সিনেমা বানানোর বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের মেধা আর কাজের প্রতি ডেডিকেশন নিয়ে দেশে ফিরে এসেই শুরু করলেন 'পথের পাঁচালী' বানানোর কাজ। কিন্তু অর্থের অভাবে বহু বছর ধরে চলে 'পথের পাঁচালি' মনের মতো নির্মান করার প্রক্রিয়া। নিজের বাড়ির দলিল, স্ত্রীর গয়না সব বন্ধক রেখেই একটা সময় শেষ হয় 'পথের পাঁচালি'। তবে সকল কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে সত্যজিৎ রায় যে, সিনেমা নয় ইতিহাস বানাচ্ছেন তা মনে হয় নিজেও জানতেন না। সিনেমা বক্স অফিসে খুব একটা ভালো ফলাফল আনেনি। কারন তখনো ভারতবর্ষে এই ধরনের সিনেমা বোঝার দর্শক খুব বেশি তৈরী হয়নি। তবে বিশ্ব দরবারে হইচই ফেলে দেন সত্যজিৎ রায় তার প্রথম সিনেমা দিয়েই। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে 'সেরা ডকুমেন্টারি'র পুরস্কার পেয়ে যান তিনি।
এরপরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ সত্যজিৎ পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭টি সিনেমা। ৩৭ বছরের কর্মজীবনে তিনি নির্মাণ করেন পথের পাঁচালি, অপুর সংসার, পরশপাথর, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারুলতা, দেবী, মহানগর, অভিযান, কাপুরুষ, মহাপুরুষ, গুপী গাইন বাঘা বাইন, প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জনারণ্য, হীরক রাজার দেশ, গণশত্রু, আগন্তুক, শাখা-প্রশাখা, সোনার কেল্লা, জয়বাবা ফেলুনাথ এর মতো কালজয়ী অনেক সিনেমা।
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে কি নেই সেটা একভাবে দেখতে গেলে তর্কের বিষয়। তবে সিনেমার বিষয়বস্তু বা বৈচিত্র্য নিয়ে কারোই কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। অপু ট্রিলজি, চারুলতা, প্রতিদ্বন্দ্বী, অশনি সংকেত, গুপী গাইন বাঘা বাইন, সোনার কেল্লা, ফেলুদা সবকটা সিনেমাই একে অপরের থেকে ভিন্ন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা সফল হওয়ার অন্যতম মূল চাবিকাঠি হচ্ছে তার অনবদ্য কাস্টিং। তিনি নিজেই বলেছিলেন - 'পথের পাঁচালী' র অপু, 'ফেলুদা'র লালমোহন বাবু, চিত্রনাট্য লেখার সময় তিনি যেন তাঁর চরিত্র গুলোকে দেখতে পেতেন। তিনি কখনোই ভাল অভিনেতা খুঁজেতেন না। তাঁর শব্দ দিয়ে আঁকা স্কেচ-এর সঙ্গে, কার শরীরী ভাষা, মুখের মিল সবচেয়ে বেশি, সেটাই দেখতেন। কারন তিনি জানতেম অভিনয় করিয়ে নেওয়ার মুন্সিয়ানা তাঁর জানা ছিল। উত্তম কুমার, মাধবী, অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তপন চ্যাটার্জি বারবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ' মানিকদা যেটা করে দেখাতেন তাঁর ৫০ শতাংশ যদি পর্দায় করা যায়, তবে সেটাকে নিখুঁত সিন বলা যেতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য কাস্টিং তার সিনেমাগুলোকে সফল করার মূল অন্তরায়।
সত্যজিৎ রায়ের কথা বলতে গেলেই উঠে আসে, আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। সৌমিত্রর প্রতি সত্যজিৎ রায়ের একটি বিশেষ ভাললাগা ছিল। সেটা এক হিসেবে খুব ভুল না আবার এক হিসেবে পুরোপুরি সত্য না। বলা যায় দুজনেই দুজনের সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং একটা অবস্থায় ছিলেন। সত্যজিৎ রায় যে বাজেটে সিনেমা বানাতেন তাতে কাউকেই তেমন একটা পারিশ্রমিক দেওয়া সম্ভব নয়। উত্তম কুমার তো অনেক দুরের বিষয় সেই সময়ে প্রথম সারির অন্যকোনও নায়ককে নিয়ে সিনেমা করা তার পক্ষে মুশকিল ছিল। অন্য দিক থেকে ভাবলে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে মানের সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায়, তা তিনি অন্য কারও সঙ্গে করতে পারতেন না সেই সময়ে। আর সত্যজিৎ রায়ের চিন্তাভাবনা, রুচিবোধ, অনেক কিছুর সঙ্গেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মিল ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালোবাসতেন অনেক। সত্যজিৎ রায় সিনেমার গল্পের সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি।
'গুপি গাইন বাঘা বাইন' বানানোর সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই সিনেমাতে কাজ করার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। সত্যজিৎ রাজি হননি। পরিচালক মনে করেছেন, সৌমিত্রর চেহারার মধ্যে যে শহুরে ভাব রয়েছে তা এই সিনেমার জন্য একেবারেই বেমানান। তিনি নিয়েছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়কে। আবার 'মহানগর' বা 'পোস্টমাস্টার' করার সময় তিনি নিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়কে। 'প্রতিদ্বন্দ্বী' তে তিনি নিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে। সেই সময় ধৃতিমানের মতো ইংরেজি খুব কম অভিনেতা বলতে পারতেন। একজন অবশ্যই ছিলেন, উৎপল দত্ত। কিন্তু সত্যজিতের প্রয়োজন কম বয়সি কাউকে। কর্পোরেট, শহুরে বিষয়বস্তুর সঙ্গে ধৃতিমান-এর অসম্ভব মিল। চরিত্রটা যেন তাঁকে মাথায় রেখে লেখা।
আবার 'জন অরণ্য'তে তিনি নিলেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে। একজন মানুষ যিনি পেট চালানোর জন্য মহিলা পাচার করেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন ব্যক্তির হাবেভাবে কোনও জটিলতা থাকবে না। কিন্তু তখনকার দিনে এই কাজ করাটা পাপ। এটা জেনেও আত্মদহন, মনের মধ্যে সংশয়, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন, নানা রকম অনুভূতি নিয়েই কাজটা করা ব্যক্তি কনফিডেন্ট একজন মানুষ হতে পারেন না। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের চেহারার মধ্যেও তেমন আত্মবিশ্বাসের ছাপ নেই। তাই সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় চরিত্রের ছাঁচে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে ফেললেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায় এবং ফলাফল সবার জানা।
এই খোজাখুজি এবং পারফেক্ট কাস্টিং এর ব্যাপারে খুতখুতে ছিলেন প্রথম সিনেমা থেকেই। বিভূতিভূষন লিখে গিয়েছিলেন, ‘পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে...’ নবীন পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ঠিক এমনটাই একজন দরকার। অনেক খোজাখুজির পর অবশেষে কলকাতার পতিতাপল্লীর ভাঙা দাওয়ায় খোঁজ মিলল তেমন একজনের। সত্যজিৎ রায়ের ইন্দির ঠাকুরণ হয়ে উঠলেন অশিতিপর চুনীবালা দেবী । সেই চুনীবালাই এক সিনেমা দিয়ে হয়ে উঠলেন দিগ্বিজয়ী সিনেমার ইতিহাস তৈরি করা চরিত্র ।
আবার সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার অভিনেতা উত্তম কুমারের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা শোনা যেতো। সত্যজিৎ রায় অধিকাংশ সময় নতুনদের নিয়ে কাজ করেছেন। তার সিনেমায় চিত্রনাট্যই নায়ক। সিনেমা সফল হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য, সংলাপ, নির্মানের মুন্সিয়ানা এবং পারফেক্ট কাস্টিং এর জন্য। উত্তম কুমারের মতো স্টারকে পারিশ্রমিক দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তাঁর, সেটা সত্যি কথা। অন্যদিকে উত্তম কুমারের স্টারডমকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা বানানো কঠিন ছিল সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে। তবে 'নায়ক' বানানোর সময় তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উত্তমকুমারের কাছে। কারণ এই সিনেমার জন্য তাঁর একজন সুপারস্টারএর প্রয়োজন। উত্তম কুমার ছাড়া সেই সিনেমা বানানো তখনকার দিনে সম্ভব ছিল না। 'নায়ক' যে কাল্ট হওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন উত্তম কুমারও। তাই তো বিনা মেকআপে ক্যামেরার সামনে নিজেকে উজাড় করে দিতে পিছপা হননি তিনি।
'চিড়িয়াখানা'র বাণিজ্যিক সাফল্যের অনেকটা কৃতিত্বই স্টার উত্তম কুমারের, তা কখনো অস্বীকার করেননি সত্যজিৎ রায় নিজেও। আবার চিত্রনাট্য অনুযায়ী কাউকে পছন্দ করার পরে তাকে পাওয়া যায়নি বলে সেই সিনেমা আর বানাননি সত্যজিৎ রায়। সেই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে বড় সুপারষ্টার যিনি পারিশ্রমিক বা স্টার পাওয়ারে উত্তম কুমারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই মহানায়িকা সুচিত্রা সেন কে নিয়ে বানাতে চেয়েছিলেন 'দেবী চৌধুরানী'। রাজি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় তারকা 'মিসেস সেন'। কিন্তু সত্যজিৎ রায় চাইলেন লম্বা শিডিউল সাথে ওই সময়ে অন্য কোন সিনেমায় কাজ না করার শর্ত। ইন্ডাস্ট্রির আপোষহীন তারকা সুচিত্রা সেন পারিশ্রমিক না নিয়ে কাজ করতে রাজি ছিলেন কিন্তু অন্য সিনেমার জন্য শিডিউল দেয়া ছিল তাই সেইসব প্রডিউসার বা পরিচালকদের কথা মাথায় রেখে না করে দেন সত্যজিৎ রায়কে। অবস্থাটা বুঝেছিলেন সত্যজিৎ তবে যেহুতু সুচিত্রাকে পাওয়া যায়নি তাই 'দেবী চৌধুরানী' সিনেমাটি আর বানাননি তিনি।
সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিয়ারের আরেকটি সোনার পালক হচ্ছে ফ্যান্টাসি ঘরানার 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'। এই সিরিজটি তাঁর দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়ের প্রতি তার ট্রিবিউট ছিল। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর মতো এতো সহজ সিনেমা কিন্তু পাওয়া যায়না। আর এখন তো এরকম সিনেমা এক্ববারেই হয় না। ছোটদের জন্য বানানো হলেও এর মধ্যে ছিল অনেকগুলো ইউনিভার্সাল অ্যাপ্রোচ। অন্যভাবে দেখতে গেলে এটার মতো করে ফ্যান্টাসির সাথে পলিটিক্যাল ঘরানার সিনেমাও পাওয়া যাবেনা। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা ভিএফএক্সের টুডি, থ্রিডি সিনেমা দেখে মুগ্ধ হই। সত্যজিৎ রায় সেই সময়ে মিউজিক, কতোগুলো লোহার পাত আর আলোর নানা রকমের ব্যবহার দিয়ে যা অ্যানিমেশন করেছেন, সেই আবেদনের কাছে হার মানবে এখনকার জটিল প্রযুক্তি।
সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লেখা কোন ফিচারই সম্পূর্ণ না যতক্ষন ফেলুদা উল্লেখ করা না হয়। বাঙালির কাছে ফেলুদা মানেই একটা ভিন্ন ফ্যান্টাসি। অনেকের কাছে কৈশোরের নস্টালজিয়া। বলা হয়, সিনেমা বানানোর আগে সত্যজিৎ রায় যখন লিখতেন, তখন বোধহয় চরিত্রগুলো তাঁর সামনে ভেসে উঠতো, কথা বলতো।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে কি তিনি প্রথম থেকেই ফেলুদা হিসেবে ভিসুয়ালাইজ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা থাকতেই পারে। কারন গল্পের মতো অবিকল সেই লম্বা সুঠাম চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি, ধারালো চিবুক। এই সমস্ত কিছুই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। আবার'ফেলুদা' অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি এর গল্পগুলো ট্র্যাভেল অ্যানালগ বললেও ভুল বলা হয়না। তার লেখনি এতটাই পিকটোরিয়াল যে, যদি কেউ কোনও দিন দার্জিলিং বা গ্যাংটক না যান, তাও তাঁর চোখের সামনে দার্জিলিং ম্যাল, গান্ধি রোড ফুটে উঠবে ৷ এটা তার মতো একজন ফিল্ম মেকারই পারেন। সৌমিত্র চট্রোপ্যাধায় একবার মজা করে বলেছিলেন যে, গ্যাংটকে গন্ডগোল, দার্জিলিং জমজমাট-এ যত নিখুঁতভাবে গ্যাংটক কিংবা দার্জিলিংয়ের বর্ণনা দেওয়া আছে, তা বোধহয় সিকিম ট্যুরিজমের কিংবা এই রাজ্যের ওয়েবসাইটেও নাই।
নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রমান করার পর অর্পনা সেন তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- মানিকদার শর্ট টেকিং-এর মধ্যে ছিল একটা স্বাতন্ত্রতা। এক্সপেরিমেন্ট করতেন তিনি। বিষয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, টাইট ফ্রেম পছন্দ করতেন তিনি। তাই তো হীরক রাজার দেশে হোক বা শাখা প্রশাখা, কাপুরুষ মহাপুরুষ বা জয় বাবা ফেলুনাথ, পথের পাঁচালি বা আগন্তুক। সব ছবিই যেন টাইট ফ্রেম করে বাঙালির মননে ধরে রেখেছে কেউ। যার ফোকাস কখনও সফট হয় না। গল্প বলার এমন জাদু, ফ্রেমে ধুলো জমতে দেয় না কিছুতেই।
ভারতের আরেক জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর তার লেখা একটি বইতে উল্লেখ করেছেন যে- সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনার ব্যাপারটি আসলে শিল্পীদের প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করত। যেমন উৎপল দত্তের মত শক্তিশালী অভিনেতাদের তেমন কোন নির্দেশনাই তিনি দেননি, অন্যদিকে অপু চরিত্রে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিংবা একেবারে নতুন হিসেবে অপর্ণা চরিত্রে আমাকে(শর্মিলা ঠাকুরকে) তিনি অনেকটা 'পুতুলের' মত ব্যবহার করেছেন। তবে আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে অভিনয়টা হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছিলেন।
ক্যারিয়ারে ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় ‘বিবিসির শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ (১৩তম) উপাধি লাভ করেন। এছাড়া পদ্মভূষণ ও ভারতরত্ন পুরস্কারেও সম্মানিত হন তিনি। ১৯৮৩ সালে ঘরে বাইরে সিনেমায় কাজ করার সময় সত্যজিৎ রায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। এরপর থেকে তার কাজের গতি ধীর হতে থাকে। ১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সত্যজিৎ রায় হাসপাতালে ভর্তি হন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাটে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই মহান চলচ্চিত্রকার মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। সেবার মাতৃভাষা দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রন রক্ষা করতে নিজের আদি নিবাস যে দেশটিতে সেখানে এসে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন এই বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিটি। পল্টন ময়দানের অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্য রাখতে যেয়ে অনেক কথার মাঝে তিনি বলেছিলেন-
'এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি। এবার আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছে আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে ফিরে আসব, এই দেশটাকে ভাল করে দেখব। এদেশের মানুষের সঙ্গে এমন ভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি মুখোমুখি বসে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করব।গত বিশ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানা ভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহিদ দিবসের পূণ্যতিথিতেই আমি বলতে পারি, আজকে যে সম্মান সেই সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনও পাইনি। আর আমার মনে হয় না আর কখনও পাব। জয় বাংলা।'
বেচে থাকলে গতবছরেই শততম বর্ষে পা দিতেন তিনি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এই সময়ে কাজ করতেন না। তবু মাথার উপর বটগাছ থাকা বলে একটা কথা আছে। বাংলাভাষী সিনেমাপ্রেমীদের কাছে তাই হয়ে থাকতেন। তিনি আজ নেই, তবে চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি বেঁচে থাকবেন তার লেখা বইয়ের চরিত্রে এবং নির্মান করা কালজয়ী সব সিনেমার মধ্য দিয়ে। ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় তিনি রয়ে যাবেন অনন্তকাল।