ভিত্তোরিও দি সিকার 'দ্য বাইসাইকেল থিভস' দেখে অনুপ্রেরণা পেয়ে সিনেমাজগতে এসে যে তোলপাড় তিনি করলেন, এরকমটা আর কেউ কোনোদিন করতে পারবে কী না, তা হয়তো মহাকাল তার খেরোখাতায় তুলে রেখেছে। এই পলিম্যাথকে নিয়ে তাই যতই বলা হোক না কেন, আঁশ মিটবে না...

পিছিয়ে যাই কয়েক যুগ আগে। নিভে যাওয়ার পূর্বমুখে বাঙ্গালী-সংস্কৃতির পিদিম তখন দপ করে জ্বলে উঠলো। কী লেখালেখি, কী সিনেমা, কী গান...সবখানেই বাংলার নাবিকদের তুমুল হৈ-হল্লা, দারুণ আধিপত্য। উত্তাল সংস্কৃতি-সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে শক্ত করে মাস্তুল ধরে আছেন বাংলার রথি-মহারথিরা। তাদের শিল্পকর্ম ছড়িয়ে যাচ্ছে নানা দিকে। বানের জলের মতন। দ্রুতবেগে। 

এই নাবিকদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। যার লেখার গভীরতা, বিষয়বস্তুর সৌকর্য, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হয় আজও। সেই মানিকের নামে মিল রেখে, তাঁর জন্মের তেরো বছর পরে জন্মালেন আরেকজন 'মানিক', যিনি লিখতেন, আঁকতেন, সিনেমা বানাতেন। সমসাময়িক সব বাঙ্গালী নাবিক যখন তাদের নৌকা নিয়ে চেনাগণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, এই 'মানিক' তার জাহাজকে নিয়ে পাড়ি দিলেন পরিচিত ভূগোল ছেড়ে আরো দূরে। আস্তে আস্তে তিনি হয়ে উঠলেন 'সত্যজিৎ রায়।'

মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের স্মৃতিচারণমূলক এক বইতে একবার পড়েছিলাম, খুব ছোটবেলায় তাদের বাসায়  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের পুরো সেট  কেনা হয়। কেনার পরে বই বাসায় নিয়ে আসার সাথে সাথেই ঘরের সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে বইগুলোর উপর। এর পরের একমাস, যারাই বিভিন্ন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের বাসায় গিয়েছে, দেখেছে এক বিশেষ দৃশ্য- ঘরের সদস্যরা ঘরের বিভিন্ন অংশে বসে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একেকটা বই পড়ছে অখণ্ড মনোযোগে। 

এই গল্পের সাথে আমার গল্পও খানিকটা মেলে। আমি তখন সদ্য সদ্য 'সিনেমা' নামক মাধ্যমটিকে বুঝতে শুরু করেছি। আমাদের বাসায় একদিন নিয়ে আসা হয় 'মানিক' অথবা 'সত্যজিং রায়' এর সবগুলো সিনেমার ডিভিডি। মলাটে ভারী ফ্রেমের চশমা আর হাসিমুখে সত্যজিৎ রায়। এরপরের কয়েকদিন কাটে চোখের পলকে। নাওয়াখাওয়া ভুলে সিনেমাগুলোতে বুঁদ হয়ে থেকে। 

সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যেক সিনেমা নিয়েই বিস্তর আলোচনা হয়েছে। প্রশংসায় জর্জরিত হয়েছে। সমালোচনাতেও বিদ্ধ হয়েছে। অনেকের  মতে, 'পথের পাঁচালী' তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন 'চারুলতা'কে তিনি এগিয়ে রাখেন 'পথের পাঁচালী'র চেয়ে। সত্যজিৎ এর সিনেমার তাই ক্রমবিন্যাস করা ভারী শক্ত। কোন সিনেমা একটু বেশি ভালো, কোনটি একটু কম ভালো, সে হিসেবনিকেশ করতে গেলে গলদঘর্ম হতে হবে। তবুও তাঁর নির্মিত যে পাঁচটি সিনেমা সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, যেগুলো সময়ে-অসময়ে এখনও দেখি, সেগুলো নিয়েই আজকের কথাবার্তা।

১. পথের পাঁচালী (১৯৫৫) 

এই সিনেমা দেখার আগেই সিনেমাটি নিয়ে এত গল্প, এত প্রশংসা শুনেছিলাম, আগ্রহ ছিলো আকাশচুম্বী। সত্যজিৎ রায়ের 'একেই বলে শুটিং' আর বিজয়া রায়ের 'আমাদের কথা'র অনেকটা অংশ জুড়েই 'পথের পাঁচালী'র গল্প। এরপর বিভূতিভূষণের 'আম আঁটির ভেঁপু' পড়লাম। সব হোমওয়ার্ক শেষে সিনেমা দেখতে বসা। 

পথের পাঁচালী

হরিহর, সর্বজয়া, অপু, দূর্গার জীবন গল্প দেখতে এসে যেটা বুঝলাম, বইয়ের অনেক কিছুই পালটে ফেলেছেন পরিচালক। প্রচুর মেটাফোর, রবিশংকরের সেতার আর আনকোরা শিল্পীদের হৃদয় নিঙ্গড়ে দেওয়া অভিনয়...সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রটিকে এত অনুষঙ্গে জড়িয়ে রেখেও ভোলেননি বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেমকে। ছিপছিপে কাশবন, রেললাইন, কয়লার ধোঁয়ার ট্রেন, অপু-দূর্গার দৌড়ে যাওয়া... চোখ বুজলে সেই দৃশ্য ডুবে যাওয়া ডুবুরির মত ভেসে আসে সামনে।  'মাস্টারপিস' কাকে বলে, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। কিন্তু এই সিনেমার টুকরো টুকরো দৃশ্য 'ইনার পিস' বা 'অন্তরের শান্তি' বাড়ায়। অদ্ভুত আবেশে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ভেতরে। 

২. অপরাজিত (১৯৫৬)

'পথের পাঁচালী'র পরে 'অপরাজিত' নিয়ে কথা না বললে অন্যায় হবে। যদিও এ সিনেমা নিয়ে বাঙ্গালী-মহলের বেশ ক্ষোভ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এ সিনেমায় প্রোটাগনিস্ট 'অপু'কে অনেকটাই মায়া-মমতাহীন করে দেখিয়েছেন পরিচালক। বইয়ের 'অপু' অনেকটাই মানবিক।  আর সেলুলয়েডের 'অপু' অমানবিক। বাংলার আবেগী দর্শক ক্ষিপ্ত হবে নাও বা কেন? 

অপরাজিত

সত্যজিৎ এর চমৎকারিত্ব বোঝা যায় এখানে।  বাংলার সিনেমা মানেই যেখানে একগাদা আবেগের বিস্ফোরণ, সেখানে এই 'অপরাজিত' সিনেমায় আমরা দেখতে পাই এমন এক সন্তানকে, যে মায়ের আঁচলের তলায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে।যে সন্তান এতটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছে, মায়ের মৃত্যুতেও সে আর শোক অনুভব করে না। বরং মায়ের আঁচলের তলায় আর থাকতে হবে না, এই ভেবে সে খানিকটা স্বস্তিও পায়! 

বাংলার মানুষ এরকম 'রূঢ় বাস্তবতা' মেনে নেবে না, সেটা সত্যজিৎ রায়ও জানতেন। তবুও তিনি এমন এক নির্মেদ গল্প বলে গেলেন ক্যামেরার বয়ানে, মুগ্ধ হলাম। হয়ে থাকতেও হবে বরাবর। 

৩. অপুর সংসার (১৯৫৯)

এ জীবনে 'অপুর সংসার' যে কতবার দেখলাম, গুনে শেষ করা যাবে না৷ ভবঘুরে অপু, যাপিত জীবনের কষাঘাতে যে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত, হুট করেই তার জীবনে আসে প্রেম। এ প্রেম আসে দুর্ঘটনার 'বিয়ে'র মোড়কে। সে প্রেম এমনই সর্বগ্রাসী, অপু-অপর্ণার আবেশ এতটাই স্নিগ্ধ-পবিত্র, বাদবাকি পার্থিব-অপার্থিব  সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে যায় তাদের কাছে এসে। 

অপুর সংসার

যদি কেউ 'রোমান্টিসিজম' নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে চায়, 'অপুর সংসার' দেখা উচিত। উথাল-পাতাল প্রেম নেই, জবজবে সংলাপ নেই। আছে আলতো করে জীবনকে ছুঁয়ে দেখা। সৌমিত্র-শর্মিলার অসাধারণ অভিনয়, অসাধারণ ন্যারেশন আর বুকপকেটে জিইয়ে রাখা শুন্যতাকে টের পাওয়ার জন্যে 'অপুর সংসার' এর চেয়ে ভালো কোনো বাছাই আছে কী না, আমার জানা নেই। 

৪. পরশপাথর 

এ সিনেমাটা দেখে ভালো লাগার পেছনে গল্প তো একটা বড় কারণ অবশ্যই৷ 'রাজশেখর বসু'র এই গল্পটাকে সত্যজিৎ রায় যেভাবে ভেঙ্গেছেন, সেটা অসাধারণ। সেজন্যে তিনি ধন্যবাদ অবশ্যই পাবেন। তবে আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি 'তুলসী চক্রবর্তী' নামক মানুষটিকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা অনবদ্য। একটা মানুষের পুরো চোখ-নাক-মুখ কথা বলছে, এটা আসলে বিরল একটি বিষয়। সব অভিনেতার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য নেই। তুলসী চক্রবর্তীর মধ্যে ছিলো। তাছাড়া কেউ যদি এই অভিনেতার জীবন নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন, দেখবেন, কৌতুক-অভিনেতা হওয়ার কারণে তিনি জীবনে ভালো কোনো সিনেমায় ভালো কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান নি। বেশ দুর্দশাতেই জীবন কেটেছে তাঁর। সত্যজিৎ এর 'তুলসী' আবিষ্কার তাই অনেকটা গল্পের সেই ভদ্রলোকের পরশপাথর পাওয়ার মতনই আরেক ঘটনা। 

পরশপাথর

এক মধ্যবয়স্ক অল্প বেতনের চাকুরে একদিন খুঁজে পান একটুকরো পরশপাথর। সেটা নিয়ে যাপিত জীবনে তার যে বিপত্তি, মূল গল্প এটাই। সাথে সত্যজিৎ রায়ের ডিরেকশন আর তুলসী চক্রবর্তীর অনবদ্য অভিনয়... এ সিনেমা হিউমার, ট্রাজেডি, কমেডি'র এক অনবদ্য মিশেল। 

একটাই আফসোস, সত্যজিৎ রায় 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়' কে নিয়ে কোনোদিন কোনো সিনেমা করলেন না! যে আফসোস ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও করেছেন সময়ে অসময়ে। 

৫. গুপি গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯)

লেখার এই পর্যায়ে এসে থমকে যেতে বাধ্য হলাম। আমি সত্যজিৎ এর আরো প্রায় ১০-১২ টা সিনেমার নাম বলে যেতে পারবো, যেগুলো আমার প্রিয়, নিয়মিত দেখি আর প্রতিবার মুগ্ধ হই৷ কিন্তু তাও শুধুমাত্র একটি সিনেমা নিয়েই এখানে বলতে হবে। বেছে নিলাম শৈশবের 'গুপি গাইন বাঘা বাইন'কে।

এ সিনেমার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। কমপক্ষে দুইশোবার দেখেছি গুগাবাবা। বেসুরো গুপি আর বেতাল বাঘা পাকেচক্রে পেয়ে যায় ভূতের রাজার বর, হাতে হাতে তালি, পায়ের জুতো...সবমিলিয়ে 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' ছিলো শৈশবের ডিজনিল্যান্ড!  

শিশুতোষ সিনেমা হলেও বড়দের চিন্তাউদ্রেগকারী বিষয়ও তো ছিলো। গানের মধ্যে-

ওরে হাল্লা রাজার সেনা
তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল।
মিথ্যে অস্ত্রশস্ত্র ধরে
প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে
রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্ব-অমঙ্গল
তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল। 

এই লাইনগুলো যেমন যুদ্ধবিরোধী বার্তা দেয়, মণ্ডা-মিঠাই এর হাঁড়ি নামিয়ে যুদ্ধ ভেস্তে দেওয়া, খারাপের উপরে ভালোকে প্রতিষ্ঠিত করা, সে সাথে অদ্ভুত সুন্দর এক রূপকথা...দ্বন্দ্বমুখর এ সময়ে সংঘাতের বিপরীতে থাকার শিক্ষাটাও তো খুবই দরকার।

গুপি গাইন বাঘা বাইন

গুগাবাবা আরেকটু বেশি ভালো লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের টেকনিক্যাল কাজগুলো দেখে। ক্যামেরার কারসাজিতে 'ভূতের নাচ' এর সেই বিখ্যাত চার মিনিটের দৃশ্য, হাতে হাতে তালি দিলে অদৃশ্য হওয়ার ক্যামেরার কারসাজি... সেই সময়ে ক্যামেরার এরকম ব্যবহার শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের পক্ষেই ভাবা সম্ভব ছিলো। সাথে তপন, রবি, সন্তোষ, হরীন্দ্রনাথ এর অসাধারণ অভিনয় তো রইলোই।

ঠিক ১০০ বছর আগে জোব চার্নকের কলকাতায় জন্ম মানুষটির। এরপর যাবজ্জীবন নানামুখী অবতারে এমন সব ইন্দ্রজালের মাকড়সা জাল ছড়িয়ে রাখলেন আশেপাশে, শত বছর পরে এসেও আষ্টেপৃষ্টে আটকে থাকি আমরা, ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনা৷ এখনো তার নির্মানগুলো নিয়ে লিখতে গেলে জ্ঞানশূন্য হয়ে যেতে হয়। হয়তো এটাই  হওয়ার কথা। ভিত্তোরিও দি সিকার 'দ্য বাইসাইকেল থিভস' দেখে অনুপ্রেরণা পেয়ে  সিনেমাজগতে যে তোলপাড় তিনি করলেন, এরকমটা আর কেউ কোনোদিন করতে পারবে কী না, তা হয়তো মহাকাল তার খেরোখাতায় তুলে রেখেছে। তাই এই পলিম্যাথকে নিয়ে যত বলা হোক না কেন, আঁশ মিটবে না। মেটা উচিতও না। তাই এখানেই ইতি। চোখের তারায় যতটুকু আকাশ আঁটলো, সেটুকুই স্বস্তি৷ 

এটুকুই নৈবেদ্য রইলো। প্রণাম নেবেন৷


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা