ই-কমার্স সাইট 'ইভ্যালি' এবং 'ইভ্যালি'র সিইও রাসেলের যে চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ড, তা নিয়ে চাইলেই দুর্দান্ত ওয়েব সিরিজ বানানো যায়। 'ডেসটিনি গ্রুপ' এর চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে চাইলে একাধিক সিনেমা-সিরিজ হতে পারে। দুর্দান্ত নির্মান হতে পারে 'যুবক' নিয়েও, যে প্রতিষ্ঠান দেড় দশক আগে এদেশের বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করে চলে গিয়েছিলো আচমকা...

ঋত্বিক ঘটক বিশ্বাস করতেন, 'সিনেমা' হচ্ছে সামাজিক বার্তা প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। যেহেতু সিনেমার মাধ্যমে বিশাল এক অডিয়েন্সকে কানেক্ট করা যায়, তাই ঋত্বিক ঘটক সিনেমাকেই বেছে নিয়েছিলেন তার প্রতিবাদের, প্রতিরোধের মাধ্যম হিসেবে। এক ইংরেজ লেখক বলেছিলেন-প্ল্যাকার্ডের প্রতিবাদ মানুষ সর্বোচ্চ একবার পড়ে। অথচ সেই প্রতিবাদ গানে এলে মানুষ তা শোনে বারবার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, যেকোনো বৈশ্বিক সংকটে বব ডিলানের গান, কবীর সুমনের গান...গানেও ক্ষণেক্ষণে উঠে এসেছে প্রতিবাদ। গানগুলো মানুষকে নাড়া দিয়েছে। গান আক্ষরিক অর্থেই 'Gun' হয়ে উঠেছে। এসব ছাড়াও প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে গল্প-নাটক-উপন্যাসও মঞ্চে উঠেছে বারবার। সাহিত্যের এই শাখারা সময়ের ব্যবধানে প্রতিবাদেরই সমার্থক হয়ে গিয়েছে! 

আজকাল সিনেমা-সিরিজের মোড়কেও সামাজিক নানা বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। টিভিএফ এর 'কোটা ফ্যাক্টরি' 'অ্যাসপির‍্যান্টস' 'পঞ্চায়েত' আমাদের দেখিয়েছে শিক্ষা-ভর্তি-চাকরি নিয়ে নগ্ন ইঁদুরদৌড়, প্রশাসনের উদাসীনতা। 'স্যাক্রেড গেমস' কিংবা 'মির্জাপুর' এ উঠে  এসেছে রাজনীতি, সমাজনীতি, অপরাধের সুক্ষ্ম সূক্ষ্ম নুয়্যান্স। 'মালিক', 'বিরিয়ানি' কিংবা 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন' এ প্রকট হয়েছে সামাজিক অসাম্যের ক্লেদাক্ত আখ্যান। অর্থাৎ, বিষয় পরিষ্কার, সামাজিক বার্তার জন্যে খুব দারুণভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে সিনেমা-সিরিজকে। ক্রমশ, সিনেমা-সিরিজ হয়ে উঠছে, প্রতিবাদের চলমান প্ল্যাকার্ড-ব্যানার-শ্লোগান। 

স্ক্যাম ১৯৯২! 

গত বছর স্ট্রিমিং সাইট 'সনি লিভ' এ মুক্তি পায় হানশাল মেহতার 'স্ক্যাম ১৯৯২।' যে ওয়েব সিরিজ এখন আইএমডিবির ভারতীয় ওয়েব সিরিজগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে আছে। ভারতের শেয়ারবাজারের ধাপ্পাবাজ হারশাদ শান্তিলাল মেহতাকে এই সিরিজের আগে কয়জন ঠিকভাবে চিনতেন, তা নিয়ে চাইলে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। অথচ, এই নির্মাণ মুক্তির পরে হারশাদ মেহতাকে ভারতই যে শুধু নতুনভাবে চিনেছে, তা না৷ বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা পাকিস্তানও এখন এক নামে চেনে এই মানুষকে। অর্থাৎ, কুখ্যাত অপরাধী এবং তাদের কীর্তিকলাপকেও চাইলে তুলে আনা যায় পর্দায়। তাদের কুকীর্তি সম্পর্কে মানুষকে ওয়াকিবহাল করা যায়। মানুষের মনে স্থায়ী করে রাখা যায় তাদের সমূহ পাপ। 'স্ক্যাম ১৯৯২' এর ঘোর কাটেনি, এরমধ্যেই শুনতে পাচ্ছি, ভারতের শ্রেষ্ঠ হীরে ব্যবসায়ী, যিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ধাপ্পাবাজির সাথে জড়িত, সেই আলোচিত নীরব মোদিকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ হবে। যে ওয়েব সিরিজের নির্মাণ-কাজ শুরু হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই। 

নীরব মোদি; ভারতের কুখ্যাত হীরে ব্যবসায়ী! 

পাঠক, একটা বিষয় খেয়াল করবেন, প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত যে কয়টা সিনেমা-সিরিজের কথা বললাম, সবই কিন্তু ভারতের। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতে এতসব বিষয়, এত সব ঘটনা, এত সব মানুষ নিয়ে কাজ হয়, বাংলাদেশে কেন হয় না? এ প্রশ্ন আমারও। বোধ করি, আরো অনেকেরই। যাপিত সব বিষয় বা সামাজিক নানা অসঙ্গতি নিয়ে এখানে কাজ কেন হয় না, তা নিয়ে কথা বলার আগে বলা দরকার, সমসাময়িক দুয়েকটা বিষয় নিয়ে ছিঁটেফোঁটা যা কাজ এখন পর্যন্ত এ দেশে হয়েছে, সেগুলোর কিরকম মূল্যায়ন হয়েছে, তা নিয়ে। 

প্রথমেই মাটির ময়না। তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' নির্মিত হওয়ার পরে সেটি বাংলাদেশে ব্যান করা হয়।  'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর 'ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট' এ সিনেমাটি দেখানো হচ্ছে, বিদেশের নানা সিনেমাহলে সিনেমাটি নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে, তুমুল কথাবার্তা হচ্ছে, অথচ- বাংলাদেশে এ সিনেমাকে করা হয়েছে ব্রাত্য। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে 'শনিবার বিকেল' বানাচ্ছেন, সেটিকে সেন্সরে আটকে রাখা হচ্ছে। অথচ একই কনসেপ্ট নিয়ে বলিউডে সিনেমা হচ্ছে। পোস্টারও রিলিজ হয়ে গিয়েছে তাদের। রানা প্লাজার ঘটনা নিয়ে সিনেমা হয়েছে, সে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে না। ফুল-পাখি-লতা-পাতা, প্রেম-রোম্যান্স ছাড়া সিনেমা বানানো হলেই সেখানে সেন্সরের কাঁচি রূপান্তরিত হচ্ছে 'খড়্গ' এ। প্রশাসনের চোখরাঙানিতে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে ভিন্ন কিছু করার যাবতীয় চেষ্টা।  

শনিবার বিকেল! 

অন্য প্রসঙ্গে আসি। ই-কমার্স সাইট 'ইভ্যালি' এবং 'ইভ্যালি'র সিইও রাসেলের যে চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ড, তা নিয়ে চাইলেই দুর্দান্ত ওয়েব সিরিজ বানানো যায়। 'ডেসটিনি গ্রুপ' এর চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে চাইলে একাধিক সিনেমা-সিরিজ হতে পারে। দুর্দান্ত নির্মান হতে পারে 'যুবক' নিয়েও, যে প্রতিষ্ঠান দেড় দশক আগে এদেশের বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করে চলে গিয়েছিলো আচমকা। শাহেদের 'রিজেন্ট হাসপাতাল' নিয়েও হতে পারতো কাজ। পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, গুম, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজ...প্রসঙ্গের কী অভাব ছিলো? ছিলো না তো কখনোই। তাহলে? 

'ইভ্যালি' নিয়েও হতে পারে চাঞ্চল্যকর থ্রিলার! 

তাহলে, এত ঘটনা থাকা সত্বেও আমরা যা করেছি, তাকে এক শব্দে বলা যায়- লবডঙ্কা। কিছুই করতে পারিনি। আমাদের গল্প নিয়ে এখন ভারতে কাজ হচ্ছে। আমাদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভারতের নির্মাতা সিনেমা বানাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের পাঁচটা ভালো সিনেমা নেই। মানুষজন জানেও না মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। ওদিকে বলিউড তাদের মত করে ইতিহাস বিকৃত করে ঠিকই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে 'প্রশ্নবিদ্ধ' করে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা কিছু মানুষ প্রতিদিন এসব দেখছি, দেখে নিস্ফল আক্রোশে গজরাচ্ছি। এটুকুই। এভাবেই এগোচ্ছে সব৷ সাহসী কাজকে উৎসাহ দেয়া দূরে থাকুক, কাজগুলোকে স্রেফ থামিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে। আর 'সেন্সর বোর্ড' নামের অতীব রহস্যময় ওঁচা এক দেবতাকে ফুল-জল-বেলপাতায় তুষ্ট করার মোচ্ছব হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস এবং 'ইশ! আমরাও যদি পারতাম' ক্রমশই বাড়ছে। সাথে বাড়ছে বিষাদ। এবং ক্ষোভ। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা