
আরিফ-বিজন যুগলের নির্মাণ 'মাটির প্রজার দেশে' দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই যুগলের 'স্কুটি'ও অবহেলার কাজ না। বরং বেশ ছিমছাম এক নির্মাণ হিসেবেই গন্য করা যায় একে। পারিবারিক বলয়ের মধ্য থেকেও যে এক মেয়ে ক্রমশ স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সেটা হয়তো আমাদের আশেপাশের সমাজে খুব একটা প্রচলিত দৃষ্টান্ত না। কিন্তু, অন্ততপক্ষে, 'স্কুটি'র সহজসরল প্রেক্ষাপটে যে এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে; মূলত এই নির্মাণ থেকেই এটা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
প্রতিদিন ভোর হয়। নগরীর ছোট ছোট কুঠুরি থেকে নুড়িপাথরের মত গড়িয়ে বাইরে নেমে আসে অজস্র নারী। জড়ো হয় সড়কে। তাদের যেতে হবে নানা গন্তব্যে। যদিও গন্তব্যে যাওয়ার পথটুকু মোটেও নিরাপদ নয়। বরং, অনেকটাই অনিরাপদ। পথে পথে ওৎ পেতে থাকা বিষাক্ত নিঃশ্বাসের অজস্র শ্বাপদে গিজগিজে এ পথ অনিরাপদ হওয়াটাও তীব্র প্রাসঙ্গিক। তবুও, এ শ্বাপদসংকুল পথেই নিয়মিত এগোয় নারীরা। এবং প্রতিদিনই তাদের হয় বিষাক্ত একেক অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা বাড়ে। বাড়ে শ্বাপদের আস্ফালনও। এ নিয়মের ব্যত্যয় নেই যেন। আদিকাল থেকেই চলছে এভাবে। এবং, হয়তো, এভাবেই চলবে চিরদিন।
এই যে শ্বাপদসংকুল রাজধানী, এখানে বসবাস 'অণু' নামের এক তরুণীর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা তার। পড়াশোনার তাগিদেই প্রতিদিন নামতে হয় পথে। যদিও পথে নামার পরের অংশটুকু তীব্র অস্বস্তির। বাসে উঠলে মধ্যবয়সী পুরুষের ঘৃণ্য স্পর্শ কিংবা রাইড শেয়ারিং এর বাইকে উঠলে দুশ্চরিত্র বাইকারের নোংরামো... এসবের সাথে ক্রমশ যুঝতে যুঝতে যে সিদ্ধান্ত নেয়, একটা স্কুটি কিনবে সে। 'নারী' হয়ে জন্মানোর সামাজিক নানা বৈষম্য হয়তো এ স্কুটি আড়াল করতে পারবে না, তবে শ্বাপদের ক্লেদাক্ত নিঃশ্বাস থেকে যে খানিকটা হলেও রেহাই পাওয়া যাবে, তাও বা কম কি! অগত্যা, 'স্কুটি'ই হয়ে যায় অণু'র একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।
কিন্তু, স্কুটি সহজপ্রাপ্য বস্তু নয়। তার অর্থমূল্যও গগনচুম্বী। এবং ছাপোষা চাকুরীজীবি বাবার কাছে স্কুটির আবদার করলেও যে লাভ হবেনা, তাও অণুর অজানা নয়। তাই অণু নিজেই শুরু করে 'স্কুটি'র জন্যে অর্থসংগ্রহের কাজ। এবং এভাবেই ক্রমশ গল্প এগোয়। দৃশ্যপটে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় আরো কিছু চরিত্র। অণুর বাবা-মা, প্রেমিক, খিটখিটে শিক্ষক...সহ অনেকে। এসব চরিত্রকে আশ্রয় করে আসা নানাবিধ সংকট, ঘটনা- পাল্টা ঘটনার মিলিত ফলাফলে শেষাংশ যখন মঞ্চস্থ হয়, নির্মাণের নামের সাথে সঙ্গত রেখে সেখানে দেখি খানিকটা ভিন্ন বয়ানও। কী সেই বয়ান? তা এখানে খোলাসা করা উচিত হবে না মোটেও। সে কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্যে 'স্কুটি' দেখাই হবে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত।

'নারী দিবস' উপলক্ষ্যে বানানো 'স্কুটি'র গল্প বেশ সাদামাটা৷ নির্মাণের শেষাংশে যদি কেউ বিস্তর চমক আশা করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আশাভঙ্গের বেদনা পেতে হবে। যদিও 'স্কুটি' যেভাবে শুরু হয়েছিলো, এবং যেভাবে এগোচ্ছিলো, তা দেখে নানারকম প্রত্যাশাই তৈরী হয়েছিলো ভেতরে। কিন্তু প্রাথমিক সে গল্পকথন থেকে আচমকাই যেন সরে যান নির্মাতা। 'সামাজিক সমস্যা' থেকে 'পারিবারিক সমস্যা'য় সরিয়ে নেন গল্পকে। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন, ছিমছাম এক পারিবারিক গল্প বলতে। যদি সেটাই উদ্দেশ্য হয়, সেখানে তিনি সফল। এবং আড়ম্বরহীন এ গল্পের মাঝখানে খণ্ড খণ্ড লিঙ্গবৈষম্য, গণপরিবহনের হেনস্থা, পরিবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাসি-আনন্দ-বিষাদ... সবকিছু মিলেমিশে যা তৈরী হলো, সেটিকে অপর্যাপ্ত বলারও সুযোগ নেই অতটা। কিন্তু এক নারীকে ভরকেন্দ্রে রেখে সামাজিক সমস্যাকে কটাক্ষ করার যে অভিনবত্ব... খানিকটা খামতি রয়ে গেলো প্রত্যাশার সে অপ্রাপ্তিবিন্দুতে।
তবে গল্প নিয়ে যেরকমই চাপানউতোর থাকুক, তা পুরোপুরি উবে যায় নির্মাণের অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় দেখে। নাজিফা তুষি, সিয়াম রায়হান, অশোক ব্যাপারী কিংবা সঙ্গীতা চৌধুরী... নিজ নিজ জায়গা থেকে ভালোই করলেন সবাই। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে রানটাইম বেশি ছিলো নাজিফা তুষির, তিনি অভিনয়ও করলেন দারুণ৷ তবে এরকম 'দৃঢ়চেতা' চরিত্রে তিনি আগেও অভিনয় করেছেন৷ তাই অভিনয় ভালো লাগলেও অভিনয়ে নতুনত্ব সেভাবে এলোনা৷ প্রত্যাশা থাকবে, গল্পের পাশাপাশি চরিত্র বাছাইয়েও এখন থেকে আরেকটু মনোযোগী হবেন তিনি। কারণ, তিনি যেকোনো চরিত্রেই যে সাবলীল, এটা প্রমাণ করার দায়টাও দিনশেষে তার উপরেই বর্তায়।

আরিফ-বিজন যুগলের নির্মাণ 'মাটির প্রজার দেশে' দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম বিস্তর। এই যুগলের 'স্কুটি'ও অবহেলার কাজ না। বরং বেশ ছিমছাম এক নির্মাণ হিসেবে গন্য করা যায় একেও। পারিবারিক বলয়ের মধ্য থেকেও যে এক মেয়ে ক্রমশ স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সেটা হয়তো আমাদের আশেপাশের সমাজে খুব একটা প্রচলিত দৃষ্টান্ত না। কিন্তু, অন্ততপক্ষে, 'স্কুটি'র সহজসরল প্রেক্ষাপটে যে এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে...মূলত এই নির্মাণ থেকেই এটা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। 'নারী অধিকার' প্রসঙ্গে এই আদ্যিকালের সমাজ কবে পাল্টাবে, তা জানা নেই কারোরই। তবে, অন্ততপক্ষে, শিল্প-সংস্কৃতির বয়ান যে বিস্তর পাল্টাচ্ছে, আপাতত সেটাই সন্তুষ্টির ক্ষেত্র। সেটাই ভরসার জায়গা।