শুরু থেকে শান পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে, তাদের পরিকল্পনায় সিনেমার পোস্টারও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে- এটা খুব চমৎকার একটা দৃষ্টান্ত। এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো সিনেমাই আমরা পাই কালেভদ্রে, সেখানে সিনেমার ভালো পোস্টার পাওয়াটা তো বিরল ঘটনা। শান সেই আক্ষেপটা দূর করেছে...

‘শান’ সিনেমার প্রথম পোস্টারটা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুগ্ধতার জানান দিয়ে লিখেছিলাম, সিনেমার পোস্টার তো এমনই হওয়া উচিত! তবে মুগ্ধ হলেও, মনের কোণে উচ্চাশা রাখার সাহস করিনি। বাংলাদেশী কন্টেন্ট নিয়ে এক্সপেক্টেশন রাখা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পোড়া যে একই জিনিস, সেই অভিজ্ঞতা গত কয়েক বছরে বারবার হয়েছে। কিন্তু শান সম্ভবত এত জলদি হতাশ হতে দিতে চাইছে না। সেজন্যেই তারা একের পর এক দারুণ সব পোস্টার রিলিজ করে চলেছে, তাতে প্রত্যাশার পারদ চড়ছে ক্রমশ।

শানের গল্পটা মানব পাচার নিয়ে, এই তথ্য জানা ছিল। এ কারণেই প্রথম পোস্টারটা দেখে চমকে উঠেছিলাম। পোস্টারের মাধ্যমে গল্প বলার প্র্যাকটিসটা বাংলাদেশে নেই, অন্তত গত দুই দশকে চোখে পড়েনি। শান সেই চেষ্টাটা করেছে। গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিনেমার পোস্টারে ছিল সীমান্তের কাঁটাতারের সরব উপস্থিতি৷ সেই পোস্টারে নায়কের মাচোগিরি ছিল না, নায়িকার আবেদনময়ী উপস্থাপনও অনুপস্থিত। ছিল কিছু অজানা চরিত্র। সবার চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। একজনের কোমরের কাছে কাটা দাগ। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, গল্পে যে পাচার দেখানো হবে, সেটা শুধু মানুষের নয়, মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও। 

বোধ হবার পর, সিনেমা বিষয়টা সম্পর্কে খানিক ধারণা হবার পর বাংলাদেশী কোনো সিনেমায় এমন থট-প্রভোকিং পোস্টার দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং পোস্টার মানেই জেনেছি উদ্ভট কিছু মুখের সন্নিবেশ, যেখানে কোন পরিকল্পনা নেই, নেই সিনেমার গল্পের সাথে কোন ধরণের সংযোগ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গলাকাটা পোস্টারে থাকা নায়িকার কৃত্রিম দেহাবয়বের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি কত পুরুষকে! এক পোস্টারে শত শত মাথা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা দেখে হাসি-ঠাট্টায় মত্ত হয়েছি। সেখানে শানের পোস্টারগুলো তো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। 

শান সিনেমার সবচেয়ে আলোচিত পোস্টার এটি

সত্যি বলতে, প্রথম পোস্টারটাকে একটা ফ্লুক ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, ঝড়ে বক মরেছে। সেই পোস্টারের ডিজাইন করেছিল 'অ্যানোনিমাস' নামের কলকাতার একটা এজেন্সি। একই টিম এর আগে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মজের মন্দার, গোলন্দাজ, রঘু ডাকাতের মতো সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজের পোস্টার বানিয়েছে। তাদের প্রতিটা কাজই একটার চেয়ে আরেকটা আলাদা। তবে শানের পোস্টার দিয়ে তারা সম্ভবত নিজেদেরকেই ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশী সিনেমায় যেহেতু পোষ্টারে শৈল্পিকতা দেখানোর নজির নিকট অতীতে খুব একটা নেই, তাছাড়া হল মালিক কিংবা পরিবেশকদেরও নানা চাহিদা থাকে পোস্টার নিয়ে, তাই ক্লাস ধরে রাখাটা সম্ভব নয় এই মার্কেটে- এটা বাস্তবতা।

কিন্তু শান এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পোস্টারে অভিনবত্ব বজায় রেখেছে। সিনেমার দ্বিতীয় পোস্টারে সিয়াম হাজির হয়েছেন পুলিশের অবতারে। পায়ের নিচে সীমান্তের কাঁটাতার, রিভলভার হাতে ডাকাবুকো ভঙ্গিতে সেখানে সিয়ামের উপস্থিতি, তার পেছনে গনগনে সূর্যটা যেন প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের পতাকার লাল বৃত্তটাকে। ঘৃণ্য কিছু অপরাধীর হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করাই যে পুলিশ অফিসার শানের মিশন, সেটা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে পোস্টারে।

তৃতীয় পোস্টারেও সিয়াম আছেন, তবে এবারও ভিন্নধর্মী উপস্থাপন। রাতের পটভূমিতে নিনজা ওয়ারিয়রদের মতো তলোয়ার হাতে তার দেখা মিলেছে এখানে। চোখের কোণ ফেটে রক্ত পড়ছে, চোয়ালে প্রতিশোধের নেশা। এখানেও সিয়ামকে প্রেজেন্ট করা হয়েছে দারুণভাবে। টানা তিনটে পোস্টারে ধারাবাহিকতার এমন নিদর্শন বাংলা সিনেমা এর আগে কখনও দেখেনি। শানের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও বেশি অবাক করছে কারন এটি একদমই মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ফিল্ম, জনরা হচ্ছে অ্যাকশন থ্রিলার। এই ধরণের সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য চটুল টাইপের পোস্টারের শরণাপন্ন হয় বরাবরই। শান সেই পথে না হেঁটে পোস্টারের ক্ষেত্রে মানের সঙ্গে আপোষ করেনি কোথাও।

শান সিনেমার পোস্টারে সিয়াম আহমেদ

শানের নির্মাতারা শুরু থেকেই সিনেমার পোস্টারকে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রচার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন, পোস্টার বানানোর পেছনে লগ্নি করছেন, যা-তা জগাখিচুড়ি না বানিয়ে এই জায়গাটায় তারা দেশের বাইরের প্রফেশনাল এজেন্সির সাহায্য নিয়েছেন। আমাদের দেশে ভালো পোস্টার হয় না, সে্টা বলছি না একদমই; শানের দ্বিতীয় পোস্টারটাই কিন্তু বাংলাদেশে বানানো। কিন্তু শুরু থেকে শান পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে, তাদের পরিকল্পনায় সিনেমার পোস্টারও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে- এটা খুব চমৎকার একটা দৃষ্টান্ত। এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো সিনেমাই আমরা পাই কালেভদ্রে, সেখানে সিনেমার ভালো পোস্টার পাওয়াটা তো বিরল ঘটনা। শান সেই আক্ষেপটা দূর করেছে।

সিনেমার পোস্টারের একটা নিজস্ব ভাষা থাকে, স্টাইল থাকে। ভারতীয় সিনেমা বলুন, ইরানী বলুন কিংবা কোরিয়ান- এসব দেশের সিনেমা আর সিনেমার পোস্টার- দুটোরই নিজস্ব একটা ধরণ আছে। আমাদের দেশে সিনেমারও ভাষা নেই, ভাষা নেই পোস্টারেরও। শানের মাধ্যমে সেই যাত্রাটা শুরু হবার একটা দারুণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সিনেমা হিসেবে শান যেমনই হোক, পোস্টারের জায়গাটায় তারা যে গর্ব করে কথা বলার মতো একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে, সেটা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় এখনই!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা