এই যে 'শান' সিনেমা-সংশ্লিষ্ট মানুষজন, যাদেরকে নিয়ে কিছু মানুষের এত বিদ্বেষ, তারা কিন্তু ঠিকই এই ঈদের আরেক সিনেমা 'গলুই' এর দুঃসময়ে এই সিনেমার পাশে দাঁড়িয়েছে। জামালপুরে 'গলুই' এর প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ায় 'শান' এর অফিশিয়াল পেজ, সিয়ামের পেইজ, সিয়ামের ব্যক্তিগত আইডি থেকে শুরু করে সবখানে সবাই এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ পারস্পরিক বিদ্বেষের এ দেশে সম্প্রীতির মুগ্ধকর এক চর্চাই যেন শুরু করেছে তারা...

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের একটা থ্রিলার উপন্যাস আছে- কেউ কেউ কথা রাখে৷ এ বইটায় একটা চরিত্র ছিলো হায়দার। যে হায়দারকে যদি কেউ 'আপনার বাড়ি কই' জিজ্ঞেস করতো, সে উত্তর দিতো- বাংলাদেশ। এই উত্তর দেয়ার পেছনে তার বেশ পরিষ্কার একটা যুক্তিও ছিলো। তিনি বলতেন- বাংলাদেশ এমনিতেই একটা ছোট দেশ। এরপরে আবার 'নিজের হোম ডিস্ট্রিক্ট' এর নামে সেটাকে আরো খণ্ডবিখণ্ড করার কোনো মানে হয়না।

কিন্তু, হায়দার পছন্দ করুক বা না করুক, এদেশের মানুষ খণ্ডবিখণ্ড হতে পছন্দ করে। এরা এলাকায় খণ্ডবিখণ্ড হয়। ধর্মে খণ্ডবিখণ্ড হয়। এমনকি, মতাদর্শেও হয়। নিতম্বের ভাঁজ ও খাঁজের মত পৃথক না হলে এই উপকূলের মানুষ শান্তি পায়না,  ধ্রুবসত্যি এটাই। যদিও, এভাবে নানাভাগে ভাগ হয়েও যদি তারা শান্তি পেতো কিংবা চুপ থাকতো, তাও এক কথা ছিলো। কিন্তু, সেটাও হয়না। এরা নিজেদের প্রিয় সবকিছুকে 'সর্বশ্রেষ্ঠ' বানানোর পাশাপাশি অন্যের মতামতকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলতে চায়।  ভলতেয়ার বলেছিলেন- ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করা উচিত। কিন্তু শ্রদ্ধা তো দূরে থাক, ভিন্ন মতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাতেই যেন নিহিত থাকে একশ্রেণির মানুষের গৌরব, উল্লাস। 

এই যে বিভক্তির আখ্যান কিংবা বিভক্তিজনিত বিদ্বেষ, তা পৌঁছেছে বহুদূর। অনেককিছু গড়িয়ে আজকাল সিনেমাতেও এসেছে তা। আজকাল কোনো একটা সিনেমা মুক্তির পরেও সেই সিনেমার ভালো/খারাপ নিয়ে কথা বলার বদলে চলে প্রতিপক্ষের ক্লেদাক্ত নোংরামো। গঠনমূলক সমালোচনা, কটাক্ষ, বিদ্রুপ... সবসময়েই ছিলো। কিন্তু, এখন মাত্রাজ্ঞান ত্যাগ করে যেভাবে উলঙ্গ নোংরামো হয়, দেখতে খারাপই লাগে।

খুব রিসেন্ট একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। এম রাহিমের সিনেমা 'শান' মুক্তি পেয়েছে। অনেকেরই বেশ ভালো লেগেছে সিনেমাটা। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেও সিনেমাটা নিয়ে। এবং লেখার পরেই হয়েছে বিপত্তি। একশ্রেণির কদর্য মানুষ যেভাবে সেসব লেখায় হামলে পড়েছে তাদের যাপিত অস্ত্র- হাহা রিঅ্যাকশন, বিষাক্ত কমেন্ট আর ইনবক্সে থ্রেট নিয়ে, তা দেখে বিস্মিত হয়েছি, দুঃখও লেগেছে। একজন অমুক নায়ক/অমুক সিনেমার ফ্যান হতেই পারেন, সমস্যা নেই। তাই বলে সে মানুষটি তমুক নায়ক/ তমুক সিনেমার সাফল্যে পরশ্রীকাতরতায় ভুগবেন, এক নায়ককে অপমান করে অন্য নায়ককে সর্বশ্রেষ্ঠ বানানোর চেষ্টা করবেন... এত নীচে নামার আসলেই কি প্রয়োজন ছিলো কোনো? 

অথচ, এই যে 'শান' সিনেমা-সংশ্লিষ্ট মানুষজন, যাদেরকে নিয়ে কিছু মানুষের এত বিদ্বেষ, তারা কিন্তু ঠিকই এই ঈদের আরেক সিনেমা 'গলুই' এর দুঃসময়ে এই সিনেমার পাশে দাঁড়িয়েছে। জামালপুরে 'গলুই' এর প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ায় 'শান' এর অফিশিয়াল পেজ, সিয়ামের পেইজ, সিয়ামের ব্যক্তিগত আইডি থেকে শুরু করে সবখানে সবাই এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ 'শান' মুক্তির পরে যেভাবে এই সিনেমার উপরে হামলে পড়েছিলো একশ্রেণির মানুষ, তাতে 'শান' টীম এই কার্টেসিটুকু না দেখালেও খুব বেশি দোষ দেয়া যেতো না তাদের। কিন্তু দান্তে যেরকম বলে গিয়েছে- সংকটে যারা চুপ থাকে, তারাও অপরাধী', তেমনিভাবেই সংকটে সরব হয়ে 'শান' তাদের মানসিকতাকেই স্টাবলিশ করেছে ভালোভাবে। 

সুস্থ সংস্কৃতিত এক চর্চা শুরু করেছে 'শান'

শুধু এখানেই না। প্রথম থেকেই, 'শান' এর প্রমোশনসহ সবকিছু সবাই দেখেছে। সে প্রমোশনে নিজেদের ইম্প্রুভমেন্ট নিয়েই কথাবার্তা বলেছে তারা৷ অন্য সিনেমাকে প্রতিপক্ষ তো ভাবেইনি, বরং, অন্য সিনেমা দেখারও আহ্বান জানিয়েছে সবাইকে। শাকিব খানকে নিয়ে আপত্তিকর এক প্রশ্ন করায়, 'শান' এর প্রোটাগনিস্ট সিয়াম রেগে গিয়ে সে প্রশ্নের উত্তরই দেননি। এবং ঠিক এভাবেই, রেষারেষির যে সংস্কৃতি এই দেশে, সেই দেশে থেকেই, বিভাজনের সংস্কৃতিকে সজ্ঞানে এবং খুব সচেতনভাবেই উপেক্ষা করে গিয়েছে 'শান।' এবং এই যে এই ব্যবহার, এই যে রুচিবোধ, মূলত এটাই দিনশেষে গড়েছে বিশাল পার্থক্য। ব্যবধান।

জানিনা, এত এত পজেটিভিটি থাকার পরেও কিছু মানুষের টনক নড়বে কি না, বোধোদয়  হবে কি না৷ তবে, এটুকু বুঝি, এভাবে যদি ক্রমশ ভাগ হয় সব, তখন একদিন নিঃশেষেই বিভাজ্য হয়ে যাবে সবকিছু। তখন বলার মত, করার মত, দেখার মত কিছুই আর থাকবেনা। যেখানে একটা দেশে সময়ের ব্যবধানে নিয়মিত সিনেমাহল কমে যায়, যেখানে একটা শিল্প চোখের সামনেই কঙ্কাল হয়ে যায়, যেখানে শেষ সময়ে এই প্রায়-মৃত জায়গাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কেউ কেউ, এরকম এক অবস্থায়ও যদি আমরা ভিন্ন শিবিরে যুদ্ধ লড়তে দাঁড়াই, নিজেই হই নিজের মুখোমুখি, সংকটেও যদি আমরা শিখতে না পারি 'এক' হওয়ার গুরুত্ব, তাহলে বোধহয় কোনোদিনই আর এক হওয়া হবেনা আমাদের। বোধহয়, এভাবে হারিয়ে যাওয়ার নিয়তিই স্রষ্টা লিখে রেখেছিলেন আমাদের কপালে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা