বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি রাজলক্ষ্মী হয়ে দর্শকদের বিমোহিত করেছেন, চাঁপা ডাঙ্গার বউ দিয়ে দর্শকদের কাঁদিয়েছেন। যখন তিনি চলচ্চিত্র কে বিদায় জানান, তখনো তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শাবানা কজনই। তার মতো কেউ ছিলেন না, তার মতো কেউ আসবেন না...

১৯৯৮ সাল, বাংলা চলচ্চিত্র তখন এক যুগ সন্ধিক্ষনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় ঘোষনা এলো, তিনি চলচ্চিত্র ছেড়ে দিচ্ছেন। চলচ্চিত্রের পর্দায় তার নাম আর উঠতে দেখা যাবে না, দর্শকরা আর দেখবে না তাদের সেই অতি প্রিয় মুখ। 

এর ঠিক বছর দুয়েক আগে এক মহাতারকার শোক কাটিয়ে ওঠা চলচ্চিত্রমহল থেকে দর্শকমহল সব জায়গাতেই উৎকন্ঠা, কাছাকাছি সময়ে অকাল মৃত্যু ঘটেছে নিজের এক প্রিয় সহনায়কের। সেই উৎকণ্ঠার কারন, তিনি যে বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ নায়িকা, বলা হতো তাঁর চোখের পানির দাম নাকি লাখ টাকা। ত্রিশ বছর ধরে দর্শকদের যিনি বিমোহিত করেছিলেন,তাঁর এই আচমকা সিদ্ধান্তে সবাই হতবাক।তিনি আর কেউ নন,তিনি বিউটি কুইন খ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয়  চিত্রনায়িকা 'শাবানা'।

শিশুশিল্পী হিসেবে চট্টগ্রামের মেয়ে রত্নার চলচ্চিত্রে আবির্ভাব। ১৯৬৭ সালে এহতশামের 'চকোরী' সিনেমা দিয়ে নায়িকা হিসেবে অভিষেক। প্রথম ছবির সাফল্যের পর নায়ক নাদিমের সাথে বেশকিছু উর্দু ও বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন।হয়ে উঠেন অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল নায়িকা। 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'ওরা ১১ জন' এর নায়িকাও ছিলেন তিনি, একই বছরে করেছেন রোমান্টিক সিনেমা 'অবুঝ মন'। বাংলাদেশের প্রথম রঙ্গিন ছবি 'বাদশা'র নায়িকা তিনি। সত্তরের দশকে অমর প্রেম, চাষীর মেয়ে, অনুভব, দোস্ত দুশমন, মাটির ঘর, জননী- এই সিনেমাগুলো দিয়ে হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা।

এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া, আশির দশকে এসে শাবানা হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির মহাতারকা। ছুটির ঘন্টা, ভাত দে, দুই পয়সার আলতা, লাল কাজল থেকে মা ও ছেলে, অপেক্ষা, নাজমা, রাঙা ভাবী, মরনের পরে সহ অসংখ্য সিনেমা দিয়ে নিজেকে করলেন নন্দিত। বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি রাজলক্ষ্মী হয়ে দর্শকদের বিমুগ্ধ করেছেন, তেমনি চাঁপা ডাঙ্গার বউ দিয়ে দর্শকদের কাঁদিয়েছেন। 

নব্বইয়ে এসে তিনি আর নায়িকা নন, নিজেকে তরুনী সাজার ব্যর্থ চেষ্টা না করে হয়ে উঠলেন একজন পরিনত অভিনেত্রী। মাতৃরূপে হয়ে উঠলেন তিনি এক আদর্শ মা, এই সময়েও তাকে প্রধান করে চিত্রনাট্যকার চরিত্র সাজাতেন। স্বান্ত্বনা, পিতা মাতা সন্তান, অন্ধ বিশ্বাস থেকে সত্যের মৃত্যু নেই, কালিয়া, স্বামী কেন আসামী, মা যখন বিচারক, অজান্তে, পালাবি কোথায়- সব ছবিতেই তিনি প্রধান আকর্ষন। যখন তিনি চলচ্চিত্র কে বিদায় জানান,তখনো তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। 

স্বামী ওয়াহেদ সাদিকের সঙ্গে শাবানা

শুধু নায়িকা হিসেবে নয়, প্রযোজক হিসেবেও তিনি বেশ সফল। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যতজন প্রযোজক হিসেবে এসেছেন, তার মধ্যে তিনিই সবচেয়ে সফল।প্রথমদিকে কিছু ছবি প্রযোজনা করলেও মাটির ঘর দিয়ে নিয়মিতভাবে শুরু করেছিলেন প্রযোজনা। এরপর সখিনার যুদ্ধ, গরিবের বউ, স্বামী কেন আসামী, আর সর্বশেষ স্বামী ছিনতাই সহ প্রায় সব কটিই সফল।

সুদর্শন নায়ক আলমগীর তার নিজের প্রতিভা ছড়িয়ে সকল আশা পূরণ করেছিল শাবানার সাথে জুটি বেঁধে কাজ করে। শাবানার সাথে  'শুধু গান গেয়ে পরিচয়' হয়েছিল বলেই নায়ক রাজ্জাক তার ক্যারিয়ারের ষোলকলা পূর্ণ করেছিলেন। শাবানার কাছে অ্যাকশন কিং জসিম নিজেকে 'স্যারেন্ডার' করেছিলেন বলেই তিনি বাংলা ছবির জনপ্রিয় নায়ক হয়েছেন। মেগাস্টার উজ্জ্বল সুন্দর একখানা মুখ পেয়েছিলেন বলেই শাবানার নায়ক হতে পেরেছেন।

শ্রীকান্তরূপী বুলবুল আহমেদ যতই অভিমান করুক, রাজলক্ষ্মী শাবানার কাছে ঠিকই 'শেষ উত্তর' জানতে অধীর আগ্রহী ছিলেন। সুঠামদেহী ওয়াসিম গানে গানে রাজদুলারী শাবানার মন ভাঙ্গাতেন। বলিউড সুপারস্টার রাজেশ খান্না অনেক 'বিরোধ' কাটিয়ে শাবানার নায়ক হয়েছেন। নব্বইয়ের তারকা বাপ্পারাজ, সালমান শাহ, রিয়াজ, শাকিল থেকে শাবনাজ, মৌসুমীদের সফল মা হয়েছেন। এখনও অনেকে মনে করেন, শাবানা চলচ্চিত্র কে বিদায় না জানালে বাংলা চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতায় গ্রাস করতো না।

বিয়ে করেছেন ১৯৭০ সালে, স্বামী প্রযোজক ওয়াহিদ সাদিক, তাদের ঘরে রয়েছে দুই কন্যা। বিয়ের পরও যে নায়িকারা নিজের ক্যারিয়ারের শীর্ষে আসতে পারেন, তার অনন্য প্রমান তিনি। নব্বইয়ের শেষে এসে ধর্মীয় জীবনধারায় নিজেকে যুক্ত করে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানিয়েছেন, বাস করছেন আমেরিকায়। মাঝে মাঝে আসেন নিজের প্রিয় মাতৃভূমিতে, তবে এড়িয়ে যান মিডিয়ামহল। বর্ণিল ক্যারিয়ারে পেয়েছেন সর্বোচ্চ দশবার জাতীয় পুরস্কার, পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। প্রায় দুই দশকের অন্তরাল পেরিয়ে তিনি দর্শকদের সামনে হাজির হন।

১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করা বাংলা চলচ্চিত্রের এই শ্রেষ্ঠ নায়িকা আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৬৯ টি বছর। শুভকামনা রইল প্রিয় অভিনেত্রীর জন্য। শুভ জন্মদিন, শাবানা! 

ফিচার্ড ইমেজ: প্রথম আলো


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা