মজা করে বলা হতো, নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া নাকি টিকে আছে রাধিকা আপ্তের জন্য। সেরকম বলা যায়, এদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অনেকটাই টিকে আছে শ্যামল মাওলার কারণে। নেটফ্লিক্স থেকে হইচই কিংবা জি ফাইভ- সব জায়গায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য...

মাস কয়েক আগেও প্রতীক গান্ধীর নাম জানতো না কেউ। এর আগে কয়েকটা বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা গেছে তাকে, গুজরাটি দুটো সিনেমাও করেছিলেন, কিন্ত বলার মতো কিছু ছিল না সেগুলো। গত অক্টোবরে স্ক্যাম ১৯৯২ ওয়েব সিরিজটা রিলিজ পেলো, তারপর তো সাড়া পড়ে গেল গোটা ভারতে! ১৯৯২ সালে ঘটা ভারতীয় শেয়ার বাজারের অস্থিরতা নিয়ে নির্মিত এই সিরিজে হার্ষাদ মেহতা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন প্রতীক, অল্প ক'দিনের মধ্যেই রীতিমতো সেনসেশনে পরিণত হলেন তিনি, গোটাদশেক বলিউডি সিনেমার অফার এখন তার হাতে! ওয়েব প্ল্যাটফর্ম যাদের জীবন বদলে দিয়েছে, তাদের তালিকা করলে তাই প্রতীক গান্ধীর নামটা সবার ওপরের দিকেই থাকবে। 

শ্যামল মাওলার গল্পটা প্রতীকের মতো নয়, বরং শ্যামলের গল্পটা তার নিজের মতোই। শান্ত, নিটোল, ধীরপায়ে এগিয়ে চলার গল্প। দুম করে একরাতে তারকা হননি শ্যামল, বরং সময়ের সাথে সাথে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন, ক্যামেরার সামনে নিজেকে অবিরত ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছেন। তবু একটা মিল তো আছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মটাই এই অভিনেতাকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে গেছে, নাটকে যেটা করতে পারেননি, সেটা শ্যামল করেছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, পেয়েছেন তারকাখ্যাতি। নানা ধরণের চরিত্র, নানা এক্সপেরিমেন্ট, কিছু জায়গায় বেশ খানিকটা দুঃসাহসের পরিচয় দেয়া, তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে তারকাখ্যাতি না পেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকা- এগুলোই অনন্য করে তুলেছে শ্যামল মাওলাকে। 

চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট গোলাম মাওলা শ্যামল, ঢাকায় জন্ম, এখানেই বড় হওয়া। শাহবাগ- যে জায়গাটাকে শিল্পের আঁতুড়ঘর ধরা হয় বাংলা টেলি দুনিয়ায়, সেখানেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। অভিনয়ের পোকাটা ছোটবেলা থেকেই তার সঙ্গী, মঞ্চে অভিনয় করেছেন, অভিনয়ের অ-আ-ক-খ শিখেছেন সেখানেই। তারপর টেলিভিশনে পা রেখেছেন, সিনেমাতেও তাকে দেখা গেছে। কিন্ত শ্যামলের সেরাটা দেখা গেছে অনলাইনে, সেখানে তিনি মোটামুটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন বলা চলে। 

শ্যামল মাওলা

'একজন দীপুর কথা বলছি', 'অন্ধকার ঢাকা', 'মাকড়শা', 'স্বপ্ন দেখি আবারও', 'মায়াশ্রী', 'বারান্দায় রোদ্দুর', 'সিনেমাওয়ালা', 'লিফলেট', 'মাধবীলতা'- ছোটপর্দায় শ্যামল মাওলা দারুণ সব কাজ উপহার দিয়েছেন নিয়মিতই। ঈদ হোক কিংবা ভ্যালেন্টাইন- এক ঘন্টার নাটকে তিনি উপস্থিত থেকেছেন বরাবর, জুটি বেঁধেছেন নতুন-পুরাতন সব ধরণের শিল্পীর সাথেই, কাজ করেছেন অনেক পরিচালকের নির্দেশনায়। কিন্ত চঞ্চল-মোশাররফ কিংবা অপূর্ব-নিশোদের মতো জনপ্রিয়তা তার ছিল না, এখনও হয়েছে সেটা বলা যাবে না- কিন্ত ভিন্নধর্মী কাজের মাধ্যমে নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন শ্যামল মাওলা। তারই ফলাফল এখন তার হাতে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তিনি এখন সবচেয়ে ব্যস্ত মুখ, নির্মাতাদের কাছে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। 

'তাকদীর' ওয়েব সিরিজটা নিয়ে খুব আলোচনা হলো কিছুদিন আগে। হইচইয়ের ব্যানারে সৈয়দ আহমেদ শাওকীর এই ওয়েব ফিল্মে দারুণ অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। এই একই পরিচালকের 'ক্যাশ' ওয়েব সিরিজ দিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অভিষেক শ্যামলের। সালটা ২০১৮, তখনও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের তেমন ক্রেজ তৈরি হয়নি দেশে। অন্যরকম এক শ্যামল মাওলাকে পাওয়া গেল সেখানে, রোমান্টিক বা বাস্তবধর্মী ঘরানার বাইরে গিয়ে থ্রিলারধর্মী এই ড্রামায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ফলটা হাতেনাতে পাওয়া যায়নি, ক্যাশ খুব বেশি মানুষ দেখেননি, কিন্ত যারাই দেখেছেন, শ্যামলের অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন তারা।

এরপর 'মানি হানি' এলো, ভারতীয় ওয়েব প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ের ব্যানারে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কাজ। দেশে এত ডাকাবুকো অভিনেতা থাকার পরেও দুই পরিচালক তানিম নূর এবং কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় ভরসা রাখলেন শ্যামলের ওপর, সেটার যোগ্য প্রতিদানও দিলেন এই অভিনেতা। ব্যাংক ডাকাতির সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ওয়েব ফিল্ম সাড়া ফেলেছিল ঢাকা-কলকাতা দুই জায়গাতেই। 

মানি হানি'র পোস্টারে শ্যামল মাওলা

এরপর এলো 'সদরঘাটের টাইগার' এবং 'বুমেরাং', অভিনয়ের প্রশংসার পাশাপাশি বাড়তি পাওনা হিসেবে জুটলো অশ্লীলতার বিতর্কও। শ্যামল যদিও সেসবকে পাশ কাটিয়ে আপন মনে নিজের কাজটাই করে গেলেন, যেটা তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে করে আসছেন। ভারতের আরেক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম 'জি ফাইভ' বাংলাদেশে নির্মাণ করলো তাদের প্রথম প্রোজেক্ট 'মাইনকার চিপায়', সেখানে আফরান নিশো এবং শরীফুল রাজের সঙ্গে দেখা গেল শ্যামলকেও। কিছুদিন আগে হইচইয়ে মুক্তি পেয়েছে আশফাক নিপুণের ফ্যামিলি ড্রামা 'কষ্টনীড়', সেখানেও অভিনয়ের ভাণ্ডার নিয়ে তার প্রবল উপস্থিতি। শুটিং শেষ করেছেন জি-ফাইভের সিরিজ 'কন্ট্রাক্ট', সেখানে তিনি অভিনয় করছেন গোয়েন্দা অফিসারের চরিত্রে। মানি হানি সিজন-২ ও আসার কথা শিগগিরই।

একটা সময় মজা করে বলা হতো, নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া নাকি টিকে আছে রাধিকা আপ্তের জন্য। কারণ ভারতে নেটফ্লিক্সের শুরুর দিকের প্রায় সব প্রোজেক্টেই ছিলেন এই অভিনেত্রী। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অনেকটাই টিকে আছে শ্যামল মাওলার কারণে। আইফ্লিক্স থেকে নেটফ্লিক্স বলুন, হইচই বলুন, কিংবা জি ফাইভ- সব জায়গায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তাকে ছাড়া অনলাইন কন্টেন্ট যেন ভাবতেই পারছেন না নির্মাতারা। স্বল্পচরিত্রের গল্পে তিনি যেমন সাবলীল, তারকাবহুল কাহিনীতেও দারুণভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। তার ওপর দারুণ অভিনয় আর নানা ধরণের চরিত্রে পারদর্শীতা তো আছেই! শ্যামল মাওলা তাহলে এক নম্বর পছন্দ হবেন না কেন, বলুন? 

নেটফ্লিক্সে দেখা যাচ্ছে 'ইতি তোমারই ঢাকা'

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর 'গেরিলা' সিনেমাতে ছোট, কিন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, এরপর বড় পর্দার সাথে দীর্ঘ একটা বিরতি। অফার পেয়েছেন, কিন্ত যে গল্পটা পছন্দ হয়নি, যে চরিত্রটার সাথে নিজেকে মেলাতে পারেননি, সেটাকে 'না' বলেছেন অবলীলায়। নাটকে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো বেশকিছু কাজ করলেও, সিনেমায় সেটা করতে চাননি কখনও। দেশের প্রথম অ্যান্থোলজি ফিল্ম 'ইতি তোমারই ঢাকা'র একটা গল্পে তিনিই ছিলেন মূল চরিত্রে, মার্চে মুক্তি পেতে যাওয়া তৌকীর আহমেদের স্ফুলিঙ্গেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যাবে শ্যামল মাওলাকে। এনকাউন্টার নামের একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, সেটি এখনও মুক্তির আলো দেখেনি। 

বড় পর্দাও নিশ্চয়ই এখন থেকে শ্যামল মাওলার দারুণ অভিনয়ের সুবাস পাবে নিয়মিত, কারণ যে কোন অভিনেতার জন্য তো নিজেকে বড় পর্দায় দেখতে পাওয়াটাই পরম আরাধ্য বিষয়। শ্যামল মাওলাও তাই সিনেমায় অভিনয়টাকে গুরুত্ব দেন, কিন্ত করতে চান মনে রাখার মতো কাজ। অনেক বছর পর পেছনের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের করা কাজগুলোর কথা ভেবে গর্ব করতে পারেন। প্রতিযোগিতায় তিনি বিশ্বাস করেন না, আলোচনায় আসা বা জনপ্রিয়তা পাওয়াটাও তার কাছে বড় বিষয় নয়, তিনি শুধু একমনে অভিনয়টা করে যেতে চান, চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা চালু রাখতে চান। অভিনয়ের এই খিদেটাই হয়তো অনন্য করে তুলেছে তাকে... 

ফিচার্ড ইমেজ- পার্থ চৌধুরী

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- হৃদয় সাহা, সৈয়দ নাজমুস সাকিব


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা