শিবা চাড্ডা: বড় মঞ্চ আর বড় সুযোগের অপেক্ষা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'শর্মাজী নামকিন' এর কিটি পার্টির সেই আলাভোলা মহিলা কিংবা 'পাগলাইত' এর ছেলেহারানো বিষণ্ণ মা... চরিত্র বুঝে বরাবরই যে অভিনয় শিবা চাড্ডার, তা বিস্মিত তো করেই, সপ্রশংস শ্রদ্ধাও চলে আসে সাথে। এবং ঠিক সেজন্যেই এই উপলব্ধি হয় ক্রমশ, তাকে নিয়ে যতটা আলাদা করে কথাবার্তা হওয়া উচিত, তা হচ্ছে তো? তাকে ভেবে যে বিশেষ নির্মাণের পরিকল্পনা ভাবা উচিত, তা কেউ ভাবছে তো?
সচেতন দর্শকেরা যদি একটু খেয়াল করেন, দেখবেন, বিগত কিছু বছর ধরে বলিউডে বেশ নানারকম ভাঙ্গাগড়া চলছে। রোমকম উঠে যাচ্ছে, ওল্ড স্কুল লাভ স্টোরিগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছেনা, মেইনস্ট্রিম সিনেমাগুলো মার খাচ্ছে কিংবা 'সোশ্যাল ড্রামা' জঁরা ক্রমশ সাফল্য পাচ্ছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, বলিউডের এ মার্কেটটা এখন মোটেও আর স্থিতিশীল নেই। প্রতিবছরেই কিছু না কিছু পালটে যাচ্ছে। হারাচ্ছে। গজাচ্ছে। আবার, এরইমধ্যে, সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে ব্যবসার ব্যাটন নিজদায়িত্বেই তাদের হাতে নিয়েছে, বলিউড একরকম ব্যাকফুটেই চলে গিয়েছে যেন। অনেকে 'বলিউড' এর শেষটাও দেখে ফেলেছেন এরইমধ্যে। যদিও 'বলিউড'কে নিয়ে শেষকথা বলার মত সময় এখনো আসেনি মোটেও। তবে এও ঠিক, বেশ ক্রাইসিসের সময়ই পার করছে বি-টাউন।
তবে, বলিউডের এই যে রূগ্নদশা, এখানেও খানিক ব্যতিক্রম আছে। খানিকটা আশার আলো আছে। সে ব্যতিক্রম কিংবা 'আশার আলো'র নাম- বলিউডি 'সোশ্যাল ড্রামা' জঁরা। নিখাদ বিনোদন আর কমার্শিয়াল এলিমেন্টসের মাঝখান দিয়ে হালকা সামাজিক সবক... বলিউডি এই স্ট্রাকচার বরাবরই সফল। বরাবরই ধ্রুবক। 'ভিকি ডোনার' থেকে ' 'বাধাই দো'... আয়ুষ্মান খুরানা থেকে রাজকুমার রাও... বলিউড বেল্টে যেভাবে প্যারাডাইম শিফট করে ফেলেছে এই জঁরা, তা অভূতপূর্বও। যদিও অনেকের মত- এই একই স্ট্রাকচারে সিনেমা বানাতে বানাতে স্ট্রাকচারটাকেই একঘেয়ে করে ফেলেছে বলিউড! তবে এও ঠিক, এই স্ট্রাকচারের সিনেমার ভরসাতেই এখনও হলমুখী হয় মানুষ।
এই যে 'সোশ্যাল ড্রামা' জঁরা, যেটা নিয়ে এত কথা বলছি, প্রসঙ্গত জানাই, এই জঁরার উত্থানের সাথে আবির্ভাব হয়েছিলো গুণী কিছু শিল্পীরও। আয়ুষ্মান খুরানা বলি কিংবা রাজকুমার রাও... তারা হয়তো এসব নির্মাণের ফ্রন্টলাইনে ছিলেন, কিন্তু তাদের অন-স্ক্রিন আত্মীয়স্বজন, পরিবারের মানুষজন কিংবা প্রতিবেশী হিসেবেও এমন কিছু শিল্পী এসেছেন বলিউডে, যারা দারুণ অভিনয় দিয়ে ক্রমশই মুগ্ধ করেছেন। যদিও, এই শিল্পীরা বহু আগে থেকেই অভিনয় করছেন। বহু আগে থেকেই আছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু 'ফুটেজ পাওয়া' বলতে যা বোঝায়, সেটি এসেছে মূলত এসব 'সোশ্যাল ড্রামা'য় অভিনয়ের কল্যানেই। যেসব শিল্পীর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- সীমা পাহওয়া, মনোজ পাহওয়া, নীনা গুপ্তা'র কথা। এবং, অতি অবশ্যই, শিবা চাড্ডার কথা।
শিবা চাড্ডার নাম আলাদাভাবে বলার কারণ, তার অদ্ভুত সুন্দর অভিনয়-ক্ষমতা। এই অভিনেত্রীর অভিনীত চরিত্রগুলোর দৈর্ঘ্য কম হোক অথবা বেশি, তিনি বরাবরই আলাদাভাবে যেভাবে নজর কাড়েন, মূলত এটাই তার প্রতি মুগ্ধতার প্রধান কারণ। বেশ কিছুদিন আগে দেখা 'শর্মাজী নামকিন' এর কিটি পার্টির সেই আলাভোলা মহিলা কিংবা 'পাগলাইত' এর ছেলেহারানো বিষণ্ণ মা... চরিত্র বুঝে যে অভিনয় শিবা চাড্ডার, তা বিস্মিত তো করেই, সপ্রশংস শ্রদ্ধাও চলে আসে সাথে। এবং ঠিক সেজন্যেই এই উপলব্ধি হয় ক্রমশ, তাকে নিয়ে যতটা আলাদা করে কথাবার্তা হওয়া উচিত, তা হচ্ছে তো? তাকে ভেবে যে কোনো নির্মাণের পরিকল্পনা করা উচিত, তা কেউ ভাবছে তো? অথর-ব্যাকড রোলে তার যে অভিনয় করা দরকার, সে প্রয়োজনীয়তা কেউ আন্দাজ করছে তো?
কেন শিবা চাড্ডার আরো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া উচিত, এবার সেটাই খোলাসা করি। শুরু করি 'শর্মাজী নামকিন' সিনেমা দিয়ে। এই সিনেমায় শীবা চাড্ডার অভিনীত চরিত্র খানিকটা অন্যরকম৷ সমাজের উঁচুস্তরের বেশ বিত্তশালী একজনের স্ত্রী তিনি৷ তিনি তার মত আরো কয়েকজন মহিলাকে জুটিয়ে শুরু করলেন কিটিপার্টি। যে কিটিপার্টি করতে গিয়েই তার সাথে পরিচয় শর্মাজী'র। এভাবেই, সিনেমা যত সামনে এগোলো, আমরা বুঝতে পারলাম, 'মঞ্জু গুলাটি'রূপী শিবা চাড্ডার অভিনয়ের স্বকীয়তা। সিনেমার ক্রাইসিসের সময়গুলোতে তার দুর্দান্ত কমিক রিলিফ, প্রিভিলেজড ফ্যামিলির 'নির্বোধ গৃহিনী' চরিত্রে সার্থক অভিনয়, শেষাংশের পুলিশ স্টেশনে দুর্দান্ত টাইমিং এর একেকটা ফান সিকোয়েন্স; শিবা চাড্ডা এই সিনেমায় ক্ষণেক্ষণেই দেখিয়েছিলেন,তিনি অভিনয়টা অন্য অনেকের চেয়ে যথেষ্টই বেশি ভালো বোঝেন।
ফিরি সাম্প্রতিক আরেক সিনেমায়। 'বাধাই দো।' 'এলজিবিটিকিউ' কনসেপ্টকে উপজীব্য করে বানানো এ সিনেমার মূল দায়িত্ব যদিও রাজকুমার রাও এবং ভূমি পেদনেকারের উপরেই ছিলো ন্যস্ত, তাও শীবা চাড্ডাকে উপেক্ষা করা গেলোনা মোটেও। অল্প সময়ের জন্যে এসেও যে অভিনয় তিনি করলেন, অনবদ্য। স্রেফ অনবদ্য। র্যাপিডলি চেঞ্জ হওয়া এক জেনারেশনের মধ্যে এসে কিভাবে একান্নবর্তী পরিবারের এক বিধবা মহিলা তড়পাচ্ছেন, সেটারই যেন এক দারুণ উদাহরণ হয়ে রইলো শিবা চাড্ডার 'বেবি ঠাকুর' চরিত্রটি৷ একদিকে সন্তানের জন্যে মমতা, আরেকদিকে বহু বছরের লালিত সংস্কার... এই দুইয়ের মাঝে পড়ে শিবা চাড্ডার যে টানাপোড়েন, সেটা অল্পসময়েও যেভাবে স্টাবলিশ করেছেন তিনি, তা অনেক শিল্পীর জন্যেই বেশ দুরূহ কাজ হয়ে যেতো।
শিবা চাড্ডা এরকম কঠিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিয়মিতই। 'দম লাগা কে হাইশা'র সেই 'সিঙ্গেল আন্টি' থেকে 'লাক বাই চান্স' এর ন্যুয়ান্সড পারফরম্যান্স, বরাবরই থেকেছেন সপ্রতিভ। তবে এরইমধ্যে আলাদা করে 'পাগলাইত' এর প্রসঙ্গ আনা হবে প্রাসঙ্গিক। নিজের সন্তান মারা গিয়েছে। সে সন্তানের অনুপস্থিতিজনিত বিষাদ, আর সে বিষাদে ভেঙ্গে না পড়ে কপট দৃঢ়তার প্রদর্শনী দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা... আপাত বিপরীত এই অনুভূতি-সর্বস্ব চরিত্রে অভিনয় করা ঠিক কতটা কঠিন, তা সচেতন দর্শকমাত্রই বুঝবেন। এবং সে কাজটিই যেভাবে দক্ষতার সাথে করে গেলেন শিবা চাড্ডা, মুগ্ধ হলাম। এ সিনেমায় যে ক'টি দৃশ্য তার ছিলো, প্রতিটি দৃশ্যেই তিনি রইলেন অনবদ্য। তিনি ভাবালেন। ভাবতে বাধ্যও করলেন। শক্তিশালী অভিনয়ের ক্ষমতা কতটুকু, সেটুকু নিয়েও বেশ পরিষ্কার ধারণা দিলেন।
তবে এসবের পরেও, এত দারুণ দারুণ সব কাজের পরেও, আক্ষেপ এটাই, তিনি এখনো আটকে আছেন 'পার্শ্বচরিত্র' নামক খোলসে। অবশ্য এও তো ঠিক, গুণী শিল্পীকে উপেক্ষা করে উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর কাজটি উপমহাদেশ বরাবরই বেশ যত্ন নিয়ে করেছে৷ এবং সে কাজেরই প্রতিক্রিয়ায় উপেক্ষিত থেকেছেন শীবা চাড্ডার মত কেউ কেউ। এ অচলায়তন কাটবে কবে, কবে এই গুণী শিল্পী পাবেন যোগ্যতা প্রদর্শনের যথাযোগ্য মঞ্চ, তা জানা নেই। তবে যদি ঠিকঠাক সুযোগ পান, তাহলে মনে রাখার মতই কাজ যে তিনি উপহার দেবেন, সেখানেও নেই বিন্দুমাত্র সন্দেহ। সেজন্যেই তাই অপেক্ষা। একটি সুযোগের অপেক্ষা। নিজেকে প্রমাণের অপেক্ষা। কিংবা, এক গুণী অভিনেত্রীর জ্বলে ওঠার অপেক্ষা।