শেরশাহ: ব্যালেন্সড স্ক্রিপ্ট, ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকশন ও মাপা অভিনয়ের দারুণ এক কম্বিনেশন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

শেরশাহ'র গল্প 'আউট অব দ্য বক্স' নয়। কিন্তু এক্সিকিউশন, ন্যারেশন, ট্রিটমেন্ট... গল্পের সাথে এসব উপাদানের দারুণ মিশেলে সিনেমা এগিয়েছে তরতর করে। তবুও সবকিছু ছাপিয়ে এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, বাস্তবের হিরো 'ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা'কে সিনেমার উপজীব্য হিসেবে আনা...
মধ্যযুগে আরবী ভাষার বিখ্যাত গবেষক আল-বেরুনীর একটা কথা খুব জনপ্রিয়-
জীবন যাতে বড় না হয়। জীবন যাতে প্রশস্ত হয়।
এই কথাটার গূঢ় তাৎপর্য আলাদা করে বলার কিছু নেই। 'বিন্দুতে সিন্ধু' কিংবা 'চোখের তারায় আয়না' উপমার মতন এ কথাও টলটলে জল৷ স্বচ্ছ। পরিষ্কার। অবয়ব যতই ক্ষুদ্র হোক, সময় যতই অল্প হোক, চাইলে তার মধ্যেই অসাধ্যসাধন করা যায়। সে বিষয়টিই যেন সত্যি হতে দেখি, অ্যামাজন প্রাইম এ আসা 'শেরশাহ' সিনেমায়।
'শেরশাহ' নাম শুনে ইতিহাসের হলদেটে পৃষ্ঠার দিকে তাকানোর কোনো দরকার নেই। সামান্য সেনাকর্মচারী থেকে মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীর সেনানায়ক হলেন যে মানুষটি, সেই 'শেরশাহ'কে নিয়ে এ সিনেমার গল্প না। এ সিনেমা মোটাদাগে এক যুবকের গল্প, যে যুবক ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতো, সে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হবে। সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়ে দেশের জন্যে লড়বে। ছেলেটির নাম বিক্রম। বিক্রম বাত্রা।
লক্ষ্য যার অটুট, তাকে আটকাতে স্রষ্টাও ইতস্তত করেন। বিক্রম বাত্রাও একসময়ে হয়ে যান সেনাবাহিনীর অংশ। দেহে চাপে সেই বিশেষ উর্দি, যে উর্দির দিকে সবাই বরাবরই সম্ভ্রমের দিকে তাকায়। প্রথম পোস্টিং হয় কাশ্মীরে। সেই কাশ্মীর, যেখানের বাতাস বরাবরই উত্তপ্ত। যেখানের বাতাসে তরকারির গন্ধ আসে না, আসে বারুদ-বোমার গন্ধ। মৃত্যু যেখানে বেঁচে থাকার চেয়ে সহজ। সেখানে পোস্টিং পাওয়া বিক্রম প্রবল-বিক্রমে একের পর এক মিশনে অংশ নিতে থাকে। আস্তে আস্তে হয়ে যায় ব্যাটালিয়নের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মুখ। একসময়ে তার দায়িত্ব পড়ে কার্গিল যুদ্ধে অংশ নেয়ার৷ সেই কার্গিল, যেখানের আকাশে ঝুলে থাকে একখণ্ড নরক। কার্গিলের সেই যুদ্ধেও তুমুল পরাক্রমে অংশ নেয় ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। গল্প এরপরই বাঁক নিতে থাকে নানাদিকে।

অনেকদিন পরে বলিউডের কোনো সিনেমায় পরিমিতিবোধের উপস্থিতি দেখে ভালো লাগলো। যদি কেউ বলিউডের বিগত গণ্ডাখানেক সিনেমার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করেন, দেখবেন, সেসব সিনেমায় পরিমিতিবোধের লেশমাত্র নেই। হয়তো অতিরিক্ত আবেগ, হয়তো অতিরিক্ত কমেডি, হয়তো অতিরিক্ত আষাঢ়ে গালগপ্পের মোচ্ছব সেখানে৷ সেদিক থেকে 'শেরশাহ' ভিন্ন পথের পথিক। কী অভিনয়, কী গান, কী ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কী ন্যারেশন...সবকিছুই মাপা। ছিমছাম।
প্রোটাগনিস্ট সিদ্ধার্থ মালহোত্রা অনেকদিন পরে কোনো সিনেমায় ভালো অভিনয় করলেন। রানটাইম বেশি ছিলো তার। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতন রিয়েল লাইফ হিরোর চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে তিনি যে বেশ যত্নের সাথেই হোমওয়ার্ক করেছেন, তা সিনেমায় স্পষ্ট। ছয় মাস সামরিক ট্রেনিং নেয়া, বিক্রম বাত্রার ভাইয়ের কাছ থেকে বিক্রম বাত্রার কথাবার্তা, চালচলন সম্পর্কে জেনে সেগুলোকে সিনেমায় নিয়ে আসার জন্যে তার প্রচেষ্টা বেশ প্রশংসনীয়। বিক্রম বাত্রার প্রেমিকা 'ডিম্পল চিমা' চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিয়েরা আদভানি। খুব বেশি রানটাইম ছিলো না তার। তবে যতটুকু ছিলো, দারুণ করেছেন। বাকিরাও ঠিকঠাক। অভিনয়ে দারুণ পরিমিতিবোধ ছিলো সবারই।

গল্পের ন্যারেশন খুব ব্যালেন্সড। বায়োপিক এই গল্পে প্রেম আছে, যুদ্ধ আছে, পারিবারিক-সামাজিক দ্বন্দ্বে জেরবার হওয়া আছে, প্রিয়জনের শোকে মুহ্যমান হওয়া আছে...অনেক কিছুই আছে। সেগুলোকে খুব নিয়ন্ত্রিত, মেদবিহীন ন্যারেশনে দেখিয়েছে 'শেরশাহ।' গানগুলোও বেশ ভালো। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছিমছাম। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি মারাত্মক।
সিনেমার গল্প 'আউট অব দ্য বক্স' না। তবে এক্সিকিউশন, ন্যারেশন,ট্রিটমেন্ট... এগুলোর দারুণ ভূমিকা সিনেমাকে দুর্দান্তভাবে এগিয়ে নিয়েছে সামনে৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা'কে সিনেমার উপজীব্য হিসেবে আনা হয়েছে। আমাদের চারপাশে, পর্দার পেছনে বহু ত্যাগী, গুণী মানুষ ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, যাদের সম্পর্কে আমরা লেশমাত্রও জানি না৷ সিনেমার মূলবস্তু হওয়ার পরে 'বিক্রম বাত্রা'কে আরো কিছু মানুষ হয়তো চিনবে। ঠিক এ জায়গাতেই এই সিনেমা সার্থক৷
লোপামুদ্রা মিত্রের একটা গান খুব প্রিয় আমার। সে গানের বিশেষ দুটি লাইন-
এ মানচিত্র জ্বলছে-জ্বলুক, এ দাবানল পোড়াক চোখ
আমার কাছে দেশ মানে, এক লোকের পাশে অন্য লোক।
হয়তো গানের এ দুটি লাইনের সাথে 'শেরশাহ' সিনেমার সম্পর্ক আছে। হয়তো নেই। সম্পর্ক অথবা সম্পর্কহীনতার এ ধোঁয়াশা সিনেমা দেখলেই ধরতে পারা যাবে। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ সিনেমা ধাক্কা দেবে শুকিয়ে যাওয়া বোধের প্রাচীরে, চোখ খানিকটা আর্দ্র করবে, মনের মধ্যে খানিকটা খচখচানিও নিয়ে আসবে।
'শেরশাহ'র চমৎকারিত্ব সেখানেই।