'জাগো বাহে' অ্যান্থোলজি সিরিজের প্রথম পর্ব 'শব্দের খোয়াব' মাত্র ছাব্বিশ মিনিটের এক নির্মাণ। অথচ এ নির্মাণের শেষদিকে এসে যেভাবে রক্তে জ্বালা ধরলো আর চোখ হলো আর্দ্র, এ নির্মাণ উৎকর্ষতার মাপকাঠিতে উতরে গেলো ঠিক তখনই। জহির রায়হান 'জীবন থেকে নেয়া'য় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে একটা ঘরের রূপকে দেখিয়েছিলেন, খানিকটা সে ঘরানারই মেটাফোরিক্যাল ট্রিটমেন্ট পেলাম এ গল্পেও!
উপমহাদেশের লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসেন মান্টো বরাবরই আমার বিশেষ রকমের প্রিয়। প্রিয় এই লেখকের অন্যতম প্রধান গুণ, খুব অল্প শব্দের মধ্যেই তিনি এমনসব গল্প লেখেন, গল্পের শেষে এসে প্রবল ধাক্কা খেতে হয়। এই বিষয়টা খুব কঠিন। বড় গল্প, বড় উপন্যাসে তিলে তিলে একটা চরিত্র গড়ে সে চরিত্রকে দর্শকের সুখ-দুঃখ-বিষাদের সাথে একত্রিত করে দেয়া হয়তো যায়। কিন্তু অল্প গণ্ডির, অল্প ব্যাসার্ধের কোনো নির্মাণ যখন হৃদয়-প্রাচীরে আঁচড় কাটার সে কাজটি করে, তখন বড্ড চমকে যেতে হয়। বিস্মিত হতে হয়। এবং বিস্ময়ের ঠিক সে নিদর্শনই বরাবর দেখেছি সাদাত হোসেন মান্টোর গল্পে।
ঠিক সেরকমই, নাতিদীর্ঘ গণ্ডির অদ্ভুত সুন্দর এক গল্প দেখলাম 'চরকি'তে। বিজয়ের মাসে 'চরকি'র বিশেষ অ্যান্থোলজি সিরিজ 'জাগো বাহে'র প্রথম নির্মাণ 'শব্দের খোয়াব' এর কথা বলছি। শব্দের খোয়াব। নামটা একটু কেমন যেন! মানুষ তো অনেককিছুর খোয়াব দেখে প্রতিদিন। অর্থ,বিত্ত, প্রতিপত্তি...বহুকিছুর খোয়াব লতায়-পাতায় জড়িয়ে প্রতিদিনই স্পষ্ট হয় চোখের সামনে৷ কিন্তু শব্দের খোয়াবও হয়? এ শব্দের খোয়াব কারা দেখে? কেন দেখে? এসব যাপিত প্রশ্নের উত্তরই যেন বলে যায় 'শব্দের খোয়াব।'
সাল ১৯৫২। বেশ কিছুদিন আগেই 'রাষ্ট্রভাষা উর্দু'র খোয়াব দেখেছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই খোয়াবকে বাস্তবায়নের জন্যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে তার। এদিকে বাঙ্গালী জনতাও বসে নেই। প্রতিবাদ। প্ল্যাকার্ড। কাঁদানেগ্যাস। বুলেট। রক্ত। মুহুর্মুহু সংঘর্ষ। ঘাম। রক্ত। আগুন। উত্তাল ভূখণ্ড। ডামাডোলের সময়। এরকম এক সময়েই শুরু হয় গল্প। সকাল বেলা। ইলিয়াস সাহেব নামের এক অফিসগামী মানুষ। পরিপাটি জামাজুতো, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে যিনি যাচ্ছেন অফিসে। যাত্রাপথে আচমকা পড়ে গিয়েছেন পুলিশ ও বিক্ষোভকারী জনতার মধ্যিখানে। খানিকটা তিতিবিরক্ত হয়ে তিনি ভাবছেন, বিক্ষোভকারী ছেলেমেয়ের এই উন্মাতাল আচরণের কোনো মানে হয়? কী দরকার এসবের? এসব আন্দোলন করে কীই বা হয়?
অফিসে গেলেন। সেখানে তখন নতুন নিয়ম হয়েছে জারি। আগামী এক মাসের মধ্যে উর্দু শিখতে হবে। নাহয় খোয়াতে হবে চাকরী। অফিসের উর্দুভাষী বস সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অফিসের কোনো স্থানে বাংলা অক্ষরের লেশমাত্রও দেখতে চান না তিনি। যদিও বস বলেই খালাস, এদিকে আচমকা এ সিদ্ধান্তে ভীষণ বিপাকে পড়েছেন ইলিয়াস সাহেব৷ তিনি উর্দু তো পারেনই না, জিহবা দিয়ে উর্দুর 'উ'ও বের হয় না তার। কী করবেন? এদিকে 'সবেধন নীলমনি' চাকরীও তো দরকার। অগত্যা, প্রতি সকালে 'উর্দু কায়দা'র এক বই নিয়ে শুরু করলেন ভাষা শেখা। মাঝবয়সে এসে যেন পেরোতে চাইলেন পুলসিরাত!
এদিকে অফিসে পাকিস্তানী বসের জুলুম বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ৷ বাঙ্গালী কলিগদের নিজেদের মধ্যেও বাংলা বলা নিষিদ্ধ করেছেন তিনি, ফাইলের কোথাও বাংলা শব্দ দেখলেই প্রবল আক্রোশে সে শব্দকে পিষে ফেলতে চাইছেন, তুচ্ছ কারণে বাঙ্গালী কর্মচারীদের ছাঁটাই করে দিচ্ছেন চাকরী থেকে। সেখানে ঢোকাচ্ছেন নিজের আত্মীয়স্বজনদের৷ বসের নিপীড়ন যতই বাড়ছে, ইলিয়াস সাহেব ততই আপ্রাণ চেষ্টা করছেন উর্দু রপ্ত করার জন্যে। দেশে গণ্ডগোল, বাড়িতে স্ত্রী। 'সোনার হরিণ' এই চাকরী চলে গেলে তো পথে নামতে হবে! উর্দুই তাই এখন তার অন্ধের যষ্টি! একমাত্র অবলম্বনে। তবুও কী শেষরক্ষা হলো? উর্দু শিখে বসের মন জয় করে কী ইলিয়াস সাহেব আগলে রাখতে পারলেন নিজের চাকরী? নাকি, তাসের ঘরের মতই ভেঙ্গে পড়লো সব?
'শব্দের খোয়াব' মাত্র ছাব্বিশ মিনিটের এক নির্মাণ। অথচ এ নির্মাণের শেষদিকে এসে যেভাবে রক্তে জ্বালা ধরলো আর চোখ হলো আর্দ্র, এ নির্মাণ উৎকর্ষতার মাপকাঠিতে উতরে গেলো ঠিক তখনই। জহির রায়হান 'জীবন থেকে নেয়া'য় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে একটা ঘরের রূপকে দেখিয়েছিলেন, অনেকটা সে ঘরানারই এক ট্রিটমেন্ট লক্ষ্য করি সিদ্দিক আহমেদের এ নির্মাণেও। ইলিয়াস সাহেবের কর্মক্ষেত্র অফিসটা যেন পূর্ব পাকিস্তান। এখানের উর্দুভাষী সেই বস তৎকালীন সময়ের শাসকবর্গ। এবং গল্পের 'ইলিয়াস সাহেব' আসলে আমরাই। যারা বেঁচে থাকার জন্যে, সময়ের প্রয়োজনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুখস্থ করেছিলাম চার কলেমা, শরীরে জড়িয়েছিলাম আলখাল্লার বেসবাস। এ গল্পের শেষটার সাথেও তো মিলে যায় আমাদের গল্প। যদিও স্পয়লারের আশঙ্কায় শেষটা খোলাসা করা যাচ্ছে না, কিন্তু গল্পের শেষাংশের সাথেও তো আমাদের তীব্র মিল!
'শব্দের খোয়াব' এর প্রোটাগনিস্ট আসলে গল্প নিজেই। এই প্রোটাগনিস্ট গল্পকে যারা সাহচর্য দিয়েছেন, তাদের তালিকায় প্রথমেই থাকবেন চঞ্চল চৌধুরী। চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। তিনি বরাবরই অনবদ্য। তবে আলাদা করে নজর কেড়েছে দুজন মানুষ। 'উর্দুভাষী বস' এর চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ এর অভিনয় এতটাই অসাধারণ, কিছু অংশে দর্শকের নির্ঘাত মনে হবে, এই লোকটার টুঁটি চেপে ধরতে পারলে মন্দ হয় না! পাশাপাশি মুগ্ধ হয়েছি এ কে আজাদ সেতুর অভিনয়ে। স্ক্রিনটাইম খুব বেশি না তার৷ তবুও নির্বিবাদী, সন্ত্রস্ত এক ছাপোষা চাকুরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ই করলেন তিনি। বাকিরাও দারুণ।
যখন প্রথমবার দেশ ছেড়ে বিদেশে যাই, বিমানবন্দরে নেমে দেখি, ছিঁটেফোঁটাও বাংলা শব্দ নেই কোথাও৷ চারপাশে গিজগিজে অসংখ্য দোকান। অজস্র মানু্ষের কন্ঠস্বর। কিন্তু সেখানে বাংলা নেই৷ বাংলা শব্দ নেই৷ বাংলা অক্ষর নেই। কেউ একজন বলেছিলেন, দেশকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারা যায়, দেশের বাইরে গেলে। দেশের জন্যে চিনচিনে টান বিদেশে থাকলেই বেশি অনুভূত হয়। সে সত্যিটাই হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম সেবার৷ বাংলা অক্ষর, বাংলা শব্দ, সে শব্দের খোয়াব... খানিকটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম তখন। বাহান্ন, ভাষা আন্দোলন, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ...এসব তো আমরা মনেই রাখি নি কেউ। বিস্মৃতপ্রায় হয়ে নিজেদের ইতিহাস বেমালুম গিলে বসে আছি, তাও তো বহুদিন। এরকম এক স্মৃতিভ্রষ্ট সময়ে এই নির্মাণ, এই গল্প যেন আমাদের গালে সজোরে এক চপেটাঘাত। অন্দরমহলে তীব্র আলোড়ন। সে আলোড়নে যদি আমরা সামান্য হলেও চিন্তিত হই, এ গল্প যদি সামান্য হলেও আপ্লুত করে আমাদের...গল্প সার্থক ঠিক সেখানেই! বিজয়ের মাসে বোধের নিরেট প্রাচীরে সামান্য ফাটল ধরলে সেটাই হবে পরম প্রাপ্তি!