শ্রেয়া ঘোষাল: নিজেই যিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এ আর রেহমানের ক্ল্যাসিক ক্রিয়েশনে তিনি দারুণ মানানসই, আবার প্রীতমের সুরেও তিনি একাত্ম হয়ে যান। 'পিউ বোলে'র মতো শুদ্ধ ভালোবাসার গান যেমন গেয়েছেন, তেমনি 'উ লা লা'র মতো চটুল গানও ধারণ করেছেন গলায়। সনু নিগম থেকে অরিজিত সিং- সবার সঙ্গেই দারুণভাবে মানিয়ে যান তিনি...
২০০২ সাল, বলিউডে মুক্তি পেল সঞ্জয়লীলা বানশালীর যুগান্তকারী সিনেমা 'দেবদাস'। সিনেমার সাফল্যের মতো ইসমাইল দরবারের সুরে গানগুলো ছিল বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের তালিকায়, গানের আয়োজন ছিল যেন চাঁদের হাট। গানের জগতে মহারথীর সঙ্গে এই সিনেমায় প্লেব্যাকে অভিষেক হয়েছিল এক নবাগত গায়িকার। প্রথম গান 'ব্যারি প্রিয়া'। স্বাভাবিকভাবেই সেই নবীনা খুব চাপে ছিলেন, কিন্তু চমকপ্রদ ভাবে সবাইকে অবাক করেই গানটি একবারেই রেকর্ড করে নিলেন, গানের মাঝে বাংলা শব্দ 'ঈশ' টা আরো মুগ্ধতা বাড়িয়ে দেয়।
দেবদাস ছবিতেই গেয়েছিলেন মোট চারটে গান, ব্যারি প্রিয়া ও সিলসিলা পেয়েছে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা, মোর প্রিয়া বাদে সংগীতের বিশালতায় ভরা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে গেয়েছিলেন 'ডোলা রে' মত সুপারহিট গান। পর্দায় মাধুরী আর ঐশ্বরিয়ার নৃত্যকলার অভিনয় আর নেপথ্যে কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে দ্বৈত গান, প্রথম ছবিতেই পেয়েছিলেন গুরুদায়িত্ব।
প্রথম ছবির এমন সাফল্যে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন হিন্দি গানে, ঠিক তখনই এলো সুখবর। নিজের গাওয়া প্রথম প্লেব্যাকের গান 'ব্যারি প্রিয়া'র জন্য পাচ্ছেন জাতীয় পুরস্কার, এ যেন আকাশ কুসুম কল্পনা নিজের হাতে এসে ধরা দিল। ষোড়শী কন্যার সেই যে শুভসূচনা করেছিলেন আজো তা বহমান। হিন্দি, বাংলা কি অসমমিয়া, তামিল, মারাঠি সব গানেই সমান পারদর্শী। শুধুমাত্র কন্ঠের দ্যূতিতে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, তিনি বলিউড তো বটেই পুরো ভারতের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় গায়িকা 'শ্রেয়া ঘোষাল'।

আদি বাড়ি বাংলাদেশে, পূর্বপুরুষেরা চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তবে বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে উঠেছেন রাজস্থানে। ষোল বছর বয়সে জি টিভির রিয়েলিটি শো 'সা রে গা মা পা'র প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে নজরে পড়েছিলেন সঞ্জয় লীলা বানসালীর মায়ের, তবে তার আগেই বাংলায় কিছু এলব্যাম বের করেছিলেন। বানসালী সুযোগ দেন 'দেবদাস' সিনেমায়। এই সিনেমার গানের রেশ না কাটতেই জিসম সিনেমায় 'যাদু হ্যায় নেশা হ্যায়'র মত আবেদনময়ী গান গেয়ে তিনি সত্যিই জানান দেন ক্ষনিকের জন্য নয়, গানের জগতে রাজত্ব করতে এসেছেন।
বলিউডে ক্যারিয়ার গড়েছেন এই আঠারো বছরে পা দিল, এর মাঝে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। বলিউডে প্রথমদিকে প্রতিযোগী পেলেও কয়েক বছর পর তিনিই হয়ে উঠেন যেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। আরো জনপ্রিয় গায়িকা আছেন তবে কেউই যেন শ্রেয়া ঘোষালের মত জনপ্রিয় নন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গানে নিজেকে ভেঙ্গেছেন। এ আর রহমানের সুরে আবার সেই ঐশ্বরিয়ার লিপে বৃষ্টি ভেজা দৃশ্যের নৃত্যের তালে তালে 'বারসো রে মেঘা মেঘা'র মতো ক্ল্যাসিক গান গেয়েছেন,তেমনি প্রীতমের সুরে কারিনা কাপুরের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন 'ইয়ে ইশক হ্যায়' গানে। বিদ্যা বালানের লিপে 'পিউ বোলে'র মত শুদ্ধ ভালোবাসার গান যেমন গেয়েছিলেন তেমনি বিশাল- শেখরের সুরে 'উ লা লা উ লা লা'র মত চটুল গান নিজের করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।
এছাড়া 'তেরি মেরি, চিকনী চামেলি'র মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় গান ছাড়াও পাল পাল, ওয়াদা রাহা, মনওয়া লাগে, শুন রাহা হ্যায় তু, তেরি ওর, ধীরে চালনা, রাধা, ঘর মোরে পরদেশিয়া সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছেই তার ঝুলিতে।
'দেবদাস' এর পর থেকেই সঞ্জয় লীলা বানশালীর প্রতিটা ছবিতেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন শ্রেয়া ঘোষাল। বাজিরাও মাস্তানির 'দিওয়ানি মাস্তানি' ও 'মোহ রঙ দো লাল' তো ক্যারিয়ারের বিশেষ পালক হয়ে থাকবে। সাওয়ারিয়ার 'তোড়ি বদমাশ' থেকে রাম-লীলার 'নাগাড়া', পদ্মাবতের 'ঘুমার' তো রয়েছেই। প্লেব্যাক জুটি হিসেবে দারুন মানিয়ে যেতেন সনু নিগমের সঙ্গে, মানিয়ে যান হালের অরিজিৎ সিং কিংবা আতিফ আসলামের সঙ্গেও।

'যাও পাখি বলো হাওয়া ছলো ছলো,আবছায়া জানালার কাঁচ', বাঙালী মেয়ের বাংলা গানেও স্বাভাবিক বিমূর্ত হয়ে উঠেন, এই গান যেন তার ই প্রমাণ। একই সিনেমার 'ফেরারী মন' তো আরেক বিশেষ সৃষ্টি তার জন্য। কলকাতার সিনেমাতেও বেশ ব্যস্ততা কাটিয়েছেন। 'ভালো লাগে স্বপ্ন কে রাত জাগা স্বপ্ন কে'র মত জনপ্রিয় গান পেরিয়ে চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন, এসো হে সহ বহু গান গেয়েছেন। কিছুদিন আগেই তো 'তোমাকে' গান গেয়ে বাংলার শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। কালজয়ী অনেক বাংলা গান নতুন করে আবার গেয়েছেন। অন্যান্য ভাষার গানেও সমান দক্ষতা, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতেও বেশ জনপ্রিয়, বিশেষ করে তামিল সিনেমাকে যেন আপন করে নিয়েছেন।
ক্যারিয়ারের ইতিমধ্যেই চারবার জাতীয় পুরস্কার ঘরে তুলেছেন, ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন ছয়বার। দক্ষিনের ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন দশবার। প্রথম ভারতীয় সংগীত শিল্পী হিসেবে মাদাম তুসোর জাদুঘরে স্থান পেয়েছে তার আবক্ষমূর্তি। বাঙালীদের বলিউড জয়ে একটা প্রজন্মকে ধারন করেছেন। সামনের শুভদিন এখনো অনেক বাকি, সবেমাত্র জীবনের তিন দশক পার করছেন। ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করা এই জনপ্রিয় গায়িকা আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৩৭ টি বসন্ত, সামনের বসন্তগুলিতে অর্জনের পাল্লা আরো ভারী হবে এই শুভকামনা রইলো।
শুভ জন্মদিন, শ্রেয়া ঘোষাল!