শ্যাম সিংহ রায়: বিরহ-বিপ্লবের জন্মান্তরবাদ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'শ্যাম সিংহ রায়' এর গল্পে উঠে আসে জন্মান্তরবাদ, পূনর্জন্ম কিংবা জাতিস্মরের প্রসঙ্গ৷ শুধু তাই না। এ সিনেমায় উঠে আসে বাংলা ভাষা, কোলকাতা, রসগোল্লা, দুর্গাপূজাও। উঠে আসে নকশালবাড়ি হয়ে দেবদাসী প্রথা, জাতপাত, প্রণয়, প্রতিবাদ, বিপ্লব। পূনর্জন্মের গল্পে ক্রমশ আবির্ভূত হয় পুরোনো ইতিহাসের দগদগে ক্ষতও। হয়তো এসব ক্ষতের আবির্ভাব ছিলো প্রাসঙ্গিকও!
নমস্য সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা'র বিস্ময়বালক মুকুল মনে রাখতো গত জন্মের সব। ফেলুদা সিরিজের কালজয়ী এই উপন্যাসের সুবাদেই প্রথম পরিচয় বিশেষ এক শব্দের সাথে; শব্দটি- জাতিস্মর। পূর্বজন্মের কথা মনে রাখেন যিনি, তিনিই জাতিস্মর। যদিও 'পূর্বজন্ম' কিংবা 'জাতিস্মর' বলে আসলেই কিছু আছে কী না, সে বিতর্কও জোরালো। তবে সে বিতর্কে ইন্ধন না দিয়ে এটুকু হয়তো বলাই যায়, 'জাতিস্মর' থাকুক বা না থাকুক, বিষয়বস্তু হিসেবে 'জাতিস্মর' বরাবরই কৌতূহলোদ্দীপক। হয়তো যে কারণেই সিনেমার উপজীব্য হিসেবেও জাতিস্মর এসেছে আকছার। এবং সে সিনেমাগুলো হয়েছে বিস্তর জনপ্রিয়ও৷ ক্লাউড অ্যাটলাস, আই অরিজিনাল, মাগাধিরা, জাতিস্মর... যে উক্তির সপক্ষে জোরালো প্রমাণ। যদিও এজাতীয় সিনেমা বানানোর সবচেয়ে বড় সংকট, সূক্ষ্মভাবে বুনতে হয় গল্পের কাঁথা। যেহেতু বিতর্কিত বিষয়, একটু পান থেকে চুন খসলেই নাহয় হয়ে যেতে পারে অনর্থ।
তবুও যাপিত এই বিতর্কের শঙ্কার ডঙ্কাকে করোটিতে সযত্নে রেখেই তেলেগু চলচ্চিত্র 'শ্যাম সিংহ রায়' এর গল্পে উঠে আসে জন্মান্তরবাদ, পূনর্জন্ম কিংবা জাতিস্মরের প্রসঙ্গ৷ শুধু তাই না। এ সিনেমায় উঠে আসে বাংলা ভাষা, কোলকাতা, রসগোল্লা, দুর্গাপূজাও। উঠে আসে নকশালবাড়ি হয়ে দেবদাসী প্রথা, জাতপাত, প্রণয়, প্রতিবাদ, বিপ্লব। পূনর্জন্মের গল্পে ক্রমশ আবির্ভূত হয় পুরোনো ইতিহাসের দগদগে ক্ষতও। হয়তো এসব ক্ষতের আবির্ভাব ছিলো প্রাসঙ্গিকও।
গল্পের সূচনালগ্ন থেকে জানা যায়, তেলেগুর এক পাতি নির্মাতা একটা শর্টফিল্ম বানাবেন৷ গল্প রেডি, যোগাড়যন্ত্র রেডি, কিন্তু কুশীলব নেই। কুশীলবের সংকটও একসময়ে কেটে যায়। শর্টফিল্ম বানানো হয়। নবীন নির্মাতার এই শর্টফিল্ম বেশ জনপ্রিয়ও হয়। ক্রমশ সে শুরু করে সিনেমা বানানোর কাজ। অদ্ভুত সুন্দর এক গল্প লিখে সে গল্পকে উপজীব্য করেই সিনেমা বানানো সমাপ্ত করে সে একসময়ে। সিনেমা তুমুল প্রশংসিত হয়। এই নির্মাতার তখন রমরমা অবস্থা৷ বলিউড থেকে ডাক আসছে৷ আস্তে আস্তে মূলধারার নির্মাতাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নাম, বেশ উৎসবমুখর এক সময়, এমন সময়েই ছন্দপতন। জানা যায়, তুমুল জনপ্রিয় এ সিনেমার গল্প নাকি এক বাঙ্গালী লেখকের বইয়ের হুবহু নকল। অল্পবিস্তর নকল না, লাইন বাই লাইন নকল। এদিকে বিপর্যস্ত এই নির্মাতাও দ্ব্যর্থকন্ঠে দাবি করেন, এক লাইনও চুরি না। সবক'টি লাইনই নিজে লিখেছেন তিনি। এরকম এক বিভ্রান্তিময় প্রেক্ষাপটে গল্পে যুক্ত হয় আরেকজন মানুষ, যার নাম- শ্যাম সিংহ রায়। গল্প ক্রমশ ঢুকে পড়ে ইতিহাসের খুব পুরোনো এক অধ্যায়ে। গল্প গতি পায়৷ এগোয় পরিণতির দিকে।

এ সিনেমার প্রাথমিক মুগ্ধতার দিক অবশ্যই গল্প। গল্প যেমন চমৎকার, গল্পের বুনোটও তেমনই খোলতাই। বিশেষ করে, গল্পের দ্বিতীয় অংশ। অর্থাৎ যখন সিনেমার নামভূমিকায় থাকা প্রোটাগনিস্ট আসছেন পর্দায়। পাশাপাশি সত্তরের দশকের বাংলা, সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, টালমাটাল সময়-অসময়... অল্পবিস্তর এসেছে সেসবও। যদিও বাংলা ভাষাকে কুশীলবেরা যেভাবে উচ্চারণ করেছে, তাতে বিস্তর আক্ষেপের জায়গা ছিলো। বাঙ্গালী- তেলেগু পরিবারের সবাই তেলেগু বলতেই পারে, কিন্তু, স্থানীয় মানুষজন কেন তেলেগুতে কথা বলছে, সেটাও বোধগম্য হয়নি। কিছু বাংলা শব্দকে যেভাবে আনা হয়েছে অক্ষরের রূপান্তরে ভুল বানানে, তাতে মর্মপীড়া অনুভব করেছি। প্রোটাগনিস্টের মুখের বাংলাতেও হতাশ হয়েছি ক্ষণেক্ষণে। তবে পুরো সিনেমার সাপেক্ষে এ আক্ষেপ নাতিদীর্ঘ। তাই এ অসঙ্গতিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ারও কিছু নেই হয়তো।

অনেক নির্মাণেই যেরকম দেখি, বাঙ্গালী কালচার আনতে গিয়ে হাস্যকর সব অ্যাডাপ্টেশন হয়ে যায়, এখানে বিষয়টা সেখান থেকে অনেকটাই আলাদা। হয়তো বাঙ্গালী ট্রেডিশনের গড়পড়তা বিষয়গুলোই- দুর্গাপূজা, ধুতি-পাঞ্জাবী, রসগোল্লা, আলপনা, ভাত-মাছের ঝোল, টানা রিকশা...এসবকে আনা হয়েছে এখানে, তবুও সেগুলোর উপস্থাপন বেশ প্রাসঙ্গিক। মূল গল্পকে বেশ ভালোই সঙ্গত দিয়ে গিয়েছে এসব গতানুগতিক অনুষঙ্গ। সিনেম্যাটোগ্রাফীতে মুগ্ধ হয়েছি আরেক দফা। বিস্তীর্ণ নদীর অপ্রস্তুত ডিঙ্গি, সেতুর ওপারে গোধূলির আলো, ঘুড়ি-লড়াই... দুর্দান্ত! আলাদাভাবে বলা যায়, বিজিএম এর কথাও। স্নিগ্ধ সব দৃশ্যকে যথাযোগ্য সমর্থনই দিয়েছে তারা৷
অভিনয়ে আসি। ডাবল শেডের রোল থাকায় নানির উপরেই দায়িত্ব ছিলো সিংহভাগ৷ সে দায়িত্ব খুব যে খারাপ সামলেছেন নানি, সেরকম না। তবে 'বাসু' চরিত্রের নানির চেয়ে 'শ্যাম সিংহ রায়' চরিত্রের নানি ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রখর। কী চলনবলন, কী কথাবার্তা, অভিনয়... পুরোপুরি জাঁদরেল বাঙ্গালী বাবুর মেজাজ! যদি বাংলা উচ্চারণটুকু আরেকটু পাতে দেয়ার মত হতো, তাহলে হয়তো তৃপ্তির ঢেঁকুর আরেকটু সশব্দ হতো। যদিও তা হয়নি। এবং যা হলোনা, তা উহ্য রাখাই যৌক্তিক। প্রসঙ্গান্তরে যাই। নানির সাথে পাল্লা দিয়ে এখানে অভিনয় করেছেন যিনি, ফিরি তার প্রসঙ্গেই। তিনি সাঁই পল্লবী। সাঁই পল্লবীর চেহারার মধ্যে 'বাঙ্গালী কূলবধু'জাতীয় আবহ তো বরাবরই উপস্থিত। আর, এবার তিনি পেয়েছেনও বাঙ্গালী নারীর চরিত্র! রাজযোটকই যেন! পাশাপাশি, নিজের নৃত্যশৈলীকেও এমনভাবে অভিনয়ের সাথে, চরিত্রের যুক্ত করেছেন, বিস্মিত হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, অভিনয় ও স্নিগ্ধতায় মাঝেমধ্যে নানিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন এই অভিনেত্রী। পাশাপাশি অন্যরাও ঠিকঠাক। কৃতী, ম্যাডোনা অল্প রানটাইমে দারুণ অভিনয়ই করেছেন। যীশু সেনগুপ্ত এবং বরুণ চন্দের অভিনয়েও বৈচিত্র্য ছিলো বিস্তর।

সিনেমার শেষাংশের ক্লাইম্যাক্সটাই হতে পারতো এই সিনেমার সবচেয়ে ভয়ের জায়গা। এই জায়গা 'খেলো' হলেই পুরো নির্মাণ হতো প্রশ্নবিদ্ধও। স্বস্তির ব্যাপার, তা হয়নি। নির্মাতা রাহুল সাংকৃত্যায়ন ক্লাইম্যাক্সের এই ভঙ্গুরতাজনিত বিষয়ে যে বেশ সতর্ক ছিলেন, সেটারই প্রমাণ এসেছে গল্পের অন্তিম পরিনতিতে। এবং শেষাংশে এসে সার্থক হয়েছে কবীর সুমনের গাওয়া 'জাতিস্মর' গানের সেই বিশেষ দুটি লাইনও-
অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া,
এই নশ্বর জীবনের মানে, শুধু তোমাকেই চাওয়া।
কিভাবে বিশেষ এই দুটি লাইনের সাথে সিনেমার শেষভাব মিলে গেলো পুরোপুরি, সেটারই সুলুকসন্ধান দেয় দুই ঘন্টা সাঁইত্রিশ মিনিটের 'শ্যাম সিংহ রায়।' এবং দেয় ছিঁটেফোঁটা আক্ষেপ বাদে বেশ স্নিগ্ধ এক বিরহ-বিপ্লবের গল্পের অনাস্বাদিতপূর্ব তৃপ্তিও। এবং ঠিক সেখানে এসেই সার্থক হয়ে যায় এ নির্মাণের সাজসজ্জা, বিন্যাস, উৎকর্ষতা।