সূর্যবংশী রিভিউ: টিপিক্যাল 'রোহিত শেঠি' ফিল্ম, তবু উপভোগ্য
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

রোহিত শেঠির স্টাইলে হেলিকপ্টারের পাশাপাশি গাড়িও আকাশে উড়লো, কিছুক্ষেত্রে উড়লো গল্পের গরুটাও। তবু আড়াই ঘন্টার সূর্যবংশী সহ্য করে নেয়া যায়, স্মার্ট প্রেজেন্টেশনের কারনেই বোধহয়। তিন হিরোর আগমনের পর পর্দা থেকে চোখ সরানোর উপায় নেই। এই পনেরো মিনিটের জন্যেই গোটা সিনেমাটা সহ্য করা যায়...
অক্ষয় কুমারকে নিয়ে রোগিত শেঠির মনে কোন ইনসিকিউরিটি ছিল কিনা কে জানে! নাকি রোহিত ভেবেছিলেন, শেষের পনেরো মিনিটে কপ ইউনিভার্সের দুই চরিত্র 'সিংঘাম' আর 'সিম্বা'কে হাজির না করলে অক্ষয় একা এই সিনেমা বাঁচাতে পারবেন না? এই প্রশ্নের উত্তর রোহিতই ভালো দিতে পারবেন। সিনেমার সবচেয়ে উপভোগ্য মুহূর্ত যেহেতু ক্লাইম্যাক্সের ওই পনেরোটা মিনিট, সেকারণে এই প্রশ্নটা মনের ব্যালকনিতে উঁকিঝুঁকি মেরে গেল কয়েকবার।
আপাদমস্তক পাওয়ারপ্যাক অ্যাকশনে ভরপুর সিনেমা 'সূর্যবংশী'। কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু পাগলাটে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অক্ষয় মানিয়ে গেলেন দারুণ, যার কাছে ডিউটি কামস ফার্স্ট, ফ্যামিলি সেকেন্ড প্রায়োরিটি। এমন চরিত্র অক্ষয় এর আগেও করেছেন। হলিডে, বেবি; এবার সূর্যবংশী। আগের দুটো সিনেমার চেয়েও সূর্যবংশীতে বাণিজ্যিক মালমশলা বেশি। রোহিত শেঠির স্টাইলে হেলিকপ্টারের পাশাপাশি গাড়িও আকাশে উড়লো, কিছুক্ষেত্রে উড়লো গল্পের গরুটাও। তবু আড়াই ঘন্টার সূর্যবংশী সহ্য করে নেয়া যায়, স্মার্ট প্রেজেন্টেশনের কারনেই বোধহয়।
সিনেমার গল্পটা শুরু হয় মুম্বাইতে, ব্যাকগ্রাউন্ডে অজয় দেবগনের আওয়াজ- রোহিত শেঠির কপ ইউনিভার্সের সবচেয়ে সফল চরিত্র বাজীরাও সিংঘাম। ১৯৯৩ সালে মুম্বাই ব্লাস্টের সময় আরব সাগর পেরিয়ে পাকিস্তান থেকে ১০০০ কেজি আরডিএক্স এসেছিল ভারতে। মুম্বাই ব্লাস্টে ব্যবহৃত হয়েছে ৪০০ কেজি, তাতেই গোটা ভারত থমকে গিয়েছিল। বাকি ৬০০ কেজি এক্সপ্লোসিভ কোথায় আছে কেউ জানে না। এগুলোর অস্তিত্ব আছে কিনা সেটাই নিশ্চিত নয় কেউ। এই বিশাল পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে মুম্বাই বা দিল্লির মতো দুটো শহর উড়িয়ে দেয়া যাবে অনায়াসে, মাথাব্যথার কারন আছে বৈকি!

সেই তিরানব্বই থেকেই পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠন লস্কর তাদের কিছু কর্মীকে পাঠিয়ে দিয়েছে ভারতে। ভারতের নাগরিক হিসেবেই বাস করছে তারা, কেউ চাকরি করছে, কেউবা ব্যবসা৷ এদেরকে বলা হয় স্লিপার সেল, তারা অপেক্ষা করছে ডাক আসার। সেই ডাক একদিন এলো, ঘুম ভেঙে জেগে উঠলো ছোটখাটো একটা আর্মি। সীমান্তের ওপাড় থেকে ভারতে ঢুকলো বিলাল আহমেদ, তিরানব্বইয়ের বোমা হামলার মাস্টারমাইন্ড। ৬০০ কেজি আরডিএক্স লুকিয়ে রাখা ব্যক্তিটিও সে। একদিকে লস্করের জঙ্গীরা, অন্যদিকে মুম্বাই পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড ওরফে এটিএস। সেই সংগঠনেরই নিষ্ঠাবান অফিসার বীর সূর্যবংশী।
গল্পের থিম ভালো, কিন্তু হিরোকে সুপারহিরো বানাতে গিয়ে বেশ কয়েক দফায় যুক্তির তোয়াক্কা করেননি পরিচালক। গল্পকে বাধাগ্রস্ত করেছে অযাচিত প্রেমের দৃশ্যও, দুটো এক সমান্তরালে চলতে পারছিল না কোনোভাবেই। সিনেমার নায়ক দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান হলে কেন তাকে প্রতিবার পরিবারের প্রতি উদাসীন হতে হবে- এই প্রশ্নের উত্তর বলিউডি নির্মাতারাই ভালো জানেন। চেনা ছক থেকে বেরুতে পারেননি রোহিত শেঠিও। সিনেমায় সব মুসলিম চরিত্রকে ভিলেন বানিয়ে তার ওপরে আবার মলম লেপানোর চেষ্টা করা হয়েছে দুয়েকটা মুসলিম চরিত্রের দেশাত্ববোধের ফিরিস্তি শুনিয়ে, সেগুলোও ভীষণ আরোপিত মনে হয়েছে৷ এটুকু বাহুল্য না রাখলেও ক্ষতি ছিল না।
দুর্দান্ত সব অভিনেতাদের সন্নিবেশ ছিল। ছিলেন জাভেদ জাফরি, জ্যাকি শ্রফ, কুমুদ মিশ্র, আসিফ বসরা, অভিমন্যু সিং- কিন্তু অক্ষয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এদের সবাই রয়ে গেলেন 'আন্ডার-ইউটিলাইজড'। ক্যাটরিনার অভিনয়ের কোন উন্নতি নেই, দুজনের প্রেম জমাট বাঁধার দৃশটাও ভীষণ একঘেয়ে। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের ফ্লার্টিং স্কিলও এতটা বিচ্ছিরি হয় না, প্রপোজের দৃশ্যে চিত্রনাট্যকার সংলাপ যেভাবে লিখেছেন। বিখ্যাত 'টিপ টিপ বারসা পানি' গানটারই বা রিমেক কেন করা হলো, সচেতন দর্শকের বোধগম্য হবে না সেটিও। গানের দৃশ্যায়ন, এবং গানের প্লেসমেন্ট- দুটোই বিরক্তির উদ্রেক করে।

যা লিখছি, সবই নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে, তাই না? এতকিছুর পরেও কিন্তু সূর্যবংশী অন্তত একবার দেখা যায়। সেটা রোহিত শেঠির পাওয়ারফুল প্রেজেন্টেশনের জন্যেই দেখা উচিত। যে সিনেমায় মশলা আছে, কিন্তু মালামাল নেই বিশেষ- সেটাকেও উপভোগ্য করে তোলার কাজটা রোহিত শেঠি জানেন, খুব ভালোভাবে জানেন৷ সূর্যবংশীর পরতে পরতে বোঝা গেছে সেটা। এই সিনেমা ম্যাস অডিয়েন্সের জন্য বানানো, বিশেষ করে সিঙ্গেল স্ক্রিনের দর্শক সিনেমা দেখতে গিয়ে জায়গায় জায়গায় সিঁটি বাজাবেন নিশ্চিত। সূর্যবংশীর এন্ট্রি সীন হোক, টিপ টিপ বরসা পানি হোক, কিংবা ক্লাইম্যাক্সে সিংঘাম-সিম্বার আগমনের পরের কয়েকটা মিনিটই হোক, তুমুল হর্ষধ্বনি এই সিনেমার প্রাপ্য।
বলিউডে অ্যাকশন মুভি প্রচুর হয়েছস, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু রোহিত শেঠির সিনেমায় অ্যাকশনটা আলাদা, একটা 'ডিফারেন্ট ব্র্যান্ড অফ অ্যাকশন' জনরা তৈরি করে নিয়েছেন রোহিত, সেটা দেখলে গায়ে কাঁটাও দেয়, মনে দোলাও দেয়। শরীরে একটা গুজবাম্প দেয়া অনুভূতি তৈরি হয়৷ অ্যাকশনের দিক থেকে সূর্যবংশীতে রোহিত যেন নিজের আগেকার সব কাজকেই ছাপিয়ে গেলেন। তিন হিরোর আগমনের পর পর্দা থেকে চোখ সরানোর উপায় নেই। এই পনেরো মিনিটের জন্যেই গোটা সিনেমাটা সহ্য করা যায়।
এক বছরে কয়েক দফায় মুক্তির তারিখ পেছানোর পর, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রফিট শেয়ার নিয়ে হল মালিকদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে থাকার পর, ওটিটি জমানার রাজত্ব শুরু হবার পর বলিউডে এই প্রথম বিগ বাজেটের ম্যাস অডিয়েন্স সেন্ট্রিক কোন সিনেমা মুক্তি পেলো। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে, কোথাও ৫০% আর কোথাও ৬০% দর্শক উপস্থিতির শর্ত মেনেও ধুন্ধুমার ব্যবসা করে চলেছে সূর্যবংশী, দুই দিনে শুধু ভারতের বক্স অফিস থেকেই কামিয়েছে পঞ্চাশ কোটি রূপির বেশি। সূর্যবংশী যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো, যতই ওটিটির সুসময় আসুক, এন্টাটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে বড় পর্দা আর কমার্শিয়াল সিনেমাই শেষ কথা!