প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে অদ্ভুত পেলব এক বাংলাদেশের গল্পই ধাপে ধাপে বলে যায় 'স্কয়ার টয়লেট্রিজ কোম্পানি'র স্নিগ্ধ এই বিজ্ঞাপন। বুঝিয়ে দিয়ে যায়- বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করার মতন, বাংলাদেশকে ভালোবাসার মতন এখনও অগণিত উপকরণ আছে আশেপাশে। শুধু খোঁজার মত মন ও দেখার মত চোখ থাকলেই খুঁজে পাওয়া যায় তা!
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনক্ষেত্রের ইতিবাচক বিবর্তন যেন রাতারাতিই ঘটেছে। আগে যেমন বিজ্ঞাপন মানেই ছিলো বিশেষ কোনো পণ্য নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আদিখ্যেতা, সেখান থেকে সরে এসে আজকাল বিজ্ঞাপনে কী-ই না আনা হচ্ছে! সামাজিক নানা গুরুত্বপূর্ণ বার্তাকে যেভাবে স্বকীয় উপস্থাপনার মোড়কে নিয়ে আসা হচ্ছে একের পর এক বিজ্ঞাপনে, তা নিরন্তর বিস্মিতও করছে। দৈর্ঘ্যে মাত্র দুই-তিন মিনিটের একেকটা নির্মাণ, অথচ যেসব গভীর বার্তার টইটুম্বুর উপস্থিতি সেখানে, স্বল্পসময়ের মলাটেও যেভাবে ভেতরকে নাড়িয়ে দেয়ার মত কাজ, অবাক হতে হচ্ছে ক্রমশ। 'বিন্দুতে সিন্ধু ধারণ করা'র যে নীতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশের এ সময়ের বিজ্ঞাপনগুলো, সে নীতির নবতম সংযোজন এক নির্মাণ দেখলাম সম্প্রতি। যে বিজ্ঞাপন দেখে একই সাথে অবাক হলাম, চমকিত হলাম, খানিকটা আক্ষেপও হলো!
বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরত্বের বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা বাংলাদেশি এক তরুণী এবং তার রুমমেট 'লরা'কে উপজীব্য করে শুরু হওয়া বিজ্ঞাপনের শুরুতেই 'ক্রিসমাস ট্রি'র উপস্থিতিতে বুঝতে পারি, সামনে ক্রিসমাসের ছুটি। এই ছুটিতে বাংলাদেশি তরুণীটি ফিরবে বাংলাদেশে। নিজের নিবাসে। ফিরলোও সে। কিন্তু একা ফিরলো না। সাথে করে নিয়ে এলো রুমমেট 'লরা'কে। ইচ্ছে- বিদেশি এই রুমমেটকে বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখাবে। পরিকল্পনা মাফিক শুরু হলো ভ্রমণ। শুরু হলো দুই তরুণীর 'বাংলাদেশ' অনুসন্ধান। কর্পোরেট মেট্রোপলিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা ক্রমশ যেতে লাগলো গহীন থেকে গহীনতর বাংলাদেশে। রূপসী বাংলাদেশে।
বেশ কয়েকদিন আগেই 'আমার সোনার বাংলা'র অর্কেস্ট্রা ভার্সনের মিউজিক ভিডিওতে অকৃত্রিম বাংলাদেশের আটপৌরে অবয়ব দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই দৃশ্যগুলোর রেশ মস্তিষ্ক থেকে কাটতে না কাটতেই 'স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড' এর 'বিউটি অব বাংলাদেশ' শিরোনামের এই বিজ্ঞাপন! যে বিজ্ঞাপনে ক্ষণেক্ষণে উঠে এলো সে বাংলাদেশেরই অবয়ব, যে বাংলাদেশের ভাঁজে ভাঁজে অকৃত্রিম মোহ, স্নিগ্ধতা। যে মোহ দেখে সঞ্জীব চৌধুরীর বিখ্যাত গানের সেই লাইনই মনে পড়ে প্রথমে-
ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও, করি প্রেমের তর্জমা।
জলের বুকে ঝলসে ওঠা অবাক সূর্য, পদ্ম-ভর্তি নৌকার শরীর, জামদানি-পল্লীর শুভ্র জামদানি, নদীর শরীরে লেপ্টে থাকা ভাসমান জলযান, সে জলযানের পাটাতনে মুসাফিরের দরাজ গলায় 'সহজ মানুষ ভজে দ্যাখ না'র আধ্যাত্মিক সুর, সুন্দরবনের নিবিড় নিস্তব্ধতা, রূপোলী খাল দিয়ে নীরবে বয়ে যাওয়া ডিঙ্গি, সমুদ্র, গাঙচিল, শঙখ... মাত্র সাড়ে তিন মিনিটেরই তো বিজ্ঞাপন। কিন্তু বিষয়ের বৈচিত্র্যে কিংবা বর্ণনার সৌকর্যে তা এতই অনবদ্য, ক্রমশই সৌন্দর্য-পিপাসা বাড়ে। কোথায় গিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার মতই আক্ষেপ হয়-
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
বিজ্ঞাপনের পুরোটাজুড়ে এই নাতিদীর্ঘ বদ্বীপের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির টুকরো টুকরো খণ্ড। সব খণ্ড একত্রে জুড়ে অকৃত্রিম এক বাংলাদেশের প্রতিকৃতি! তবে এসবকিছু ছাপিয়েও বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে প্রকট হয়ে ধরা দেয় বাংলাদেশের অকৃত্রিম অতিথিপরায়ণতাই! বিজ্ঞাপনের প্রথমেই যেমন দেখি, 'লরা' নামের বিদেশি মেয়েটির যাওয়ার মত কোনো জায়গা নেই দেখেই বাংলাদেশি এই তরুণী সাথে করে নিয়ে আসে তাকে। এই যে বাঙ্গালী তরুণীটির অকৃত্রিম মায়ার টান, এ তো বাংলাদেশেরই স্বরূপ। এই বিশেষ স্বরূপ যে অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বিরল, সেও তো ধ্রুবসত্যি। সৈয়দ মুজতবা আলী একবার বলেছিলেন-
বাঙ্গালী ঠিক দুইটা কারণে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। ভালোবাসা আর আতিথেয়তা।
সেই দুই উপাদানই যেন দেখি এখানে। অতিথিপরায়ণ ও মায়াময় বাংলাদেশেরই এক নিটোল প্রতিকৃতি খুঁজে পাই প্রোটাগনিস্ট মেয়েটির মধ্যে। কিংবা সাগরপাড়ের সে মেয়েটি, যে 'লরা'কে শঙখ উপহার দিয়ে টাকা না নিয়ে পবিত্র এক হাসি দিয়ে জানায়- ন লাগিবু... সেই মেয়েটির এই বাক্যেও মিশে থাকে নরম এক বাংলাদেশের ঘ্রাণ। এভাবেই প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে অদ্ভুত পেলব এক বাংলাদেশের গল্প বলে ইতি টানে 'স্কয়ার টয়লেট্রিজ কোম্পানি'র স্নিগ্ধ এই বিজ্ঞাপন। বুঝিয়ে দিয়ে যায়- বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করার মতন, বাংলাদেশকে ভালোবাসার মতন এখনও অগণিত উপকরণ আছে। শুধু খোঁজার মত মন ও চোখ থাকলেই খুঁজে পাওয়া যায় তা।