৯০টিরও বেশি দেশে নেটফ্লিক্সের ১ নাম্বার শো হিসেবে শীর্ষস্থান দখল তো রইলোই, বিশ্বের অনেকগুলো দেশে 'স্কুইড গেম' এর আদলে গেম শো, গেম পার্ক বানানো হয়েছে রাতারাতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই টিভি সিরিজের কুশীলবেরা রাতারাতি হয়ে গিয়েছেন মিলিয়ন মিলিয়ন ফ্যানের অধিকারী। কিন্তু স্কুইড গেম কি এই হাইপ ডিজার্ভ করে?

বং জুন হো গতবছর 'প্যারাসাইট' বানিয়ে যেভাবে টলিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বমঞ্চ, তখন হয়তো কেউ দূরতম কল্পনাতেও ভাবেনি, এর ঠিক পরবর্তী বছরেই আরেকজন কোরিয়ান নির্মাতা 'স্কুইড গেম' নামের এক ওয়েব সিরিজ বানিয়ে আবার কোরিয়াকে নিয়ে আসবে বিশ্বমঞ্চে। এবং শুধু কী নিয়ে আসা? ৯০টিরও বেশি দেশে নেটফ্লিক্সের ১ নাম্বার শো হিসেবে শীর্ষস্থান দখল তো রইলোই, বিশ্বের অনেকগুলো দেশে এই সিরিজের গেমের আদলে গেম শো, গেম পার্ক বানানো হয়েছে রাতারাতি। এই টিভি সিরিজের কুশীলবেরা রাতারাতি হয়ে গিয়েছেন মিলিয়ন মিলিয়ন ফ্যানের প্রাণভোমরা। এই সিরিজের জন্যে অডিয়েন্সের চাহিদা বেশি হওয়াতে অনেক স্থানের লোকাল সার্ভার ক্রাশ করেছে। দুয়েকজন সংক্ষুব্ধ সার্ভার-মালিক আবার এই ক্রাশের জের ধরে নেটফ্লিক্সের বিরুদ্ধে মামলাও করে দিয়েছেন। এই এক টিভি সিরিজকে কেন্দ্র করে অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনাই যেন ঘটছে আশেপাশে।

কিন্তু দর্শকের প্রবল মাতামাতির 'স্কুইড গেম' এবং 'স্কুইড গেম' এর প্রকৃত স্বরূপ... এ নিয়ে খানিকটা খটকাও আছে। কোরিয়ান সিনেমা, সিরিজের দীর্ঘদিনের দর্শক যারা, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, স্টোরি বিল্ডআপ, ক্যারেক্টার আর্ক স্টাবলিশমেন্ট, আনপ্রেডিক্টেবল টুইস্ট... এসব বিষয়ে কোরিয়ান নির্মাতারা বরাবরই সিদ্ধহস্ত। এবং লেখাই বাহুল্য, একটা নির্মাণকে 'ব্রিলিয়ান্ট' বলার জন্যে এসব বিষয় খুবই বেসিক। আর খটকা ঠিক এখানেই। 'স্কুইড গেম' এর নির্মাণে কোরিয়ান ব্রিলিয়ান্স এর অনেকটাই অনুপস্থিত। সে হিসেবে বলা যেতে পারে, 'স্কুইড গেম' গড়পড়তার চেয়ে খানিকটা ভালো মানের কাজ। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এই মোটামুটি সিরিজ নিয়েই গোটা বিশ্ব যেভাবে পাগলামো করছে, সেটা বিস্ময়কর।

'স্কুইড গেম' এর শুরুতেই এই নির্মাণের প্রোটাগনিস্টের সাথে আমাদের পরিচয় হবে। যিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক যুবক। স্ত্রী, কন্যাকে খুইয়ে এখন থাকেন বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে। কপর্দকহীন এই মানুষটির বাইরে প্রচুর দেনা। দেনাদাররা মাঝেমধ্যেই আটক করে তাকে। হুমকিধামকি দেয়। কিডনি- নাক-চোখ কেটে ফেলবার ভয় দেখায়। যুবকটি তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেন এই ঋণের দায় মেটাবার। কিন্তু কূলকিনারা হয়না। অর্থের সংস্থান হয় না। 

এই তিনজনের রসায়ন বেশ উপভোগ্য ছিলো! 

ক্রমশই ঋণের দায়ে এই মানুষটি যখন সেঁধিয়ে যাচ্ছে মাটির গভীরে, তখনই তার কাছে আসে এক অদ্ভুত গেমের প্রস্তাব। যে গেমের নাম স্কুইড গেম। যে গেমের সবগুলো রাউন্ড জিতলে পাওয়া যাবে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ। প্রোটাগনিস্ট ভদ্রলোক চলে যান সেই গেম খেলতে। এবং সেখানে গিয়েই তিনি বুঝতে পারেন, জিততে পারলে হয়তো প্রচুর অর্থ তিনি পাবেন, কিন্তু হারলে আর বেঁচে ফিরবেন না তিনি। কারণ, এই গেম থেকে বাদ পড়া মানেই মৃত্যু। মৃত্যু এখানে খোলামকুচির মতন সস্তা। মৃত্যুই এখানে সবচেয়ে সহজ।

এই যে 'স্কুইড গেম', এই গেমের ছয়টা ধাপ। এই ছয় ধাপের ছয়রকম রোমাঞ্চ। সেট ডিজাইন, গেম কনসেপ্ট, বীভৎসতা...ছয় ধাপই স্বকীয়, অভিনব। সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, অভিনয়... সেখানেও খুঁত ধরার সুযোগ নেই অতটা। নির্মাণের শেষদিকে এসে যে খানিকটা মানবিক ও মনস্তাত্বিক আবহ আনা হলো গল্পে, সেটিও মোটামুটি প্রাসঙ্গিক। ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদের যে বিষাদগ্রহে বসবাস আমাদের, তার নগ্নরূপ দেখানোর যে প্রচেষ্টা...ইতিবাচক সেটিও। 

এদের কথোপকথন খানিকটা বিরক্তি ছড়িয়েছে! 

এটুকু পর্যন্ত সবই ঠিক। কিন্তু প্রত্যাশা টুটলো অন্য জায়গায়। সেটাই বলি। 'স্কুইড গেম' এর যিনি পরিচালক অর্থাৎ ডং হোক হোয়াং, তিনি এর আগে 'সাইলেন্সড' নামে এক সিনেমা বানিয়েছিলেন। সে সিনেমার কনসেপ্ট এবং সে কনসেপ্টের ব্রিলিয়ান্ট এক্সিকিউশন দেখে যারপরনাই চমকে উঠেছিলাম তখন। ঠিক সে কারণেই এই নির্মাণের ক্ষেত্রেও পরিচালকের স্টোরি টেলিং নিয়ে বেশ বড়সড় প্রত্যাশা ছিলো। তাছাড়া কোরিয়ান কোনো সিরিজ এমনি এমনি বিশ্বমঞ্চে রাজত্ব করবে, সেটাও হতে পারে না। অভিনব কিছু তো একটা আছেই। কী সেটা? তা নিয়েও আগ্রহ ছিলো বিস্তর। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির দ্বৈরথ ঘটলো তখনই।

বাংলা সিনেমায় আমরা সবসময়েই দেখেছি, হিরো হবে সহজ-সরল, আলাভোলা, মহৎপ্রাণ মানুষ৷ যার জীবনে কষ্ট বেশি, সুখ কম। এই সিরিজের প্রোটাগনিস্টও হুবহু একই স্ট্রাকচারের। যিনি মৃত্যুফাঁদে গিয়েও মহত্ব দেখাতে ভোলেন না। 'ঘরের শত্রু বিভীষণ' বলে একটা কথা আছে বাংলায়। অর্থাৎ, খুব কাছের কেউ যখন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাংলা নাটক-সিনেমায় এই বিভীষণের আধিপত্য প্রবল। এরকম বিভীষণ আছে এই ওয়েব সিরিজেও। আছে শক্তিশালী অ্যান্টাগনিস্ট। আছে কামুক মহিলা। আছে ভাই-হারানো একগুঁয়ে সাহসী পুলিশ। আছে মুখে মুখোশ আঁটা কিছু ভিলেন। এগুলোর মধ্যে অভিনব ঠিক কোনটা? এর কোন বিষয়টির সাথে আমরা আগে পরিচিত ছিলাম না?

যখন পৃথিবীতে ওটিটির দাপট ছিলো না, তখন একটা টিভি সিরিজ এর জনপ্রিয়তা নির্ণয়ের অনেকগুলো মাপকাঠির মধ্যে একটি ছিলো, সিরিজটির রিওয়াচ স্ট্যাটাস। অর্থাৎ দর্শক বারবার সিরিজটিকে দেখছে কী, দেখছে না...সেটির মাধ্যমে সিরিজটির জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করা হতো। আবার সেসময়কার প্রত্যেক জনপ্রিয় সিরিজ, যেমন- 'গেম অব থ্রোন্স' কিংবা 'ব্রেকিং ব্যাড' এর জনপ্রিয়তার পেছনে স্বকীয় কিছু সংযোজনও ছিলো। 'গেম অব থ্রোন্স' এর স্বকীয়তা যেমন ছিলো এর বিস্তীর্ণ ক্যানভাস। আবার 'ব্রেকিং ব্যাড' এর স্বকীয়তা এর অসাধারণ প্লট এবং তুখোড় স্ক্রিপ্ট। এসব মাস্টারক্লাস শো'এর সাথে এই ওয়েব সিরিজকে তুলনা করাটা অন্যায়, তবুও যেহেতু এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে গোটা বিশ্বই একরকম উন্মাতাল হয়ে গিয়েছে, তাই প্রশ্ন আসেই, কী নতুনত্ব দিলো এই ওয়েব সিরিজ? বা, এই ওয়েব সিরিজ বারবার দেখার মতন কোনো উপাদান কী রয়েছে? 

মুখোশ-আঁটা শয়তানের দল! 

'স্কুইড গেম' এর স্ক্রিপ্টের যে রসদ, তাতে গল্প থামিয়ে দেয়া যেতো পাঁচ কিংবা ছয় পর্বেই। অহেতুক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়াদি এনে কাহিনী শ্লথ করা হয়েছে মাঝেমধ্যেই। টেনে নয় এপিসোড পর্যন্ত লম্বা করা হয়েছে। ওভার-ড্রামাটিক অ্যাক্টিভিটিসে সয়লাব করা হয়েছে। অজস্র প্রশ্ন তৈরী করে সেগুলোর উত্তর না দিয়ে গল্পকে আধাখেঁচড়া এক স্থানাঙ্কে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।  গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর ব্যাকস্টোরি ডেভেলপ করা হয়নি। ক্যারেক্টার আর্ক বোঝার আগেই যবনিকাপাত ঘটেছে অনেকের। যদিও অনেকেই ভাবছেন, হয়তো এই ওয়েব সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি আসবে৷ এবং নির্ঘাতভাবেই বলা যায়, নেটফ্লিক্স এই ওয়েব সিরিজকে নিয়ে আরো কয়েক কিস্তি চালানোরও পরিকল্পনা করতে পারে৷ সেদিক বিবেচনায়, হয়তো সামনের কিস্তিতে এবারে না পাওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কিন্তু, সে তো ভবিষ্যতের ব্যাপার। এবারের গল্পটা তৃপ্তির হলো কই তাহলে? 

যাই হোক, এই সিরিজ অনেকেরই ভালো লেগেছে। হয়তো ব্রুটালিটি, ভায়োলেন্সে আমরা অনেকেই তৃপ্তি পাই। তাছাড়া এই ওয়েব সিরিজে ভাবনাচিন্তারও খুব বেশি বিষয়াদি নেই৷ ঝাড়া হাত-পা হয়ে দেখা যাবে পুরোটাই। এটাও ভালো লাগার কারণ হতে পারে। আবার এ সিরিজের কনসেপ্টও হতে পারে ভালো লাগার প্রধানতম কারণ। ক্যাপিটালিজম, হিউম্যান ডিজায়ার, অ্যানিম্যাল আর্জ এর সাথে ব্লেন্ড করা রক্তপাত, নৃশংসতা এবং শিশুতোষ খেলা...এ জিনিস চমকপ্রদ হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু যদি 'তুখোড় এক ওয়েব সিরিজ' বলা হয়, সে তালিকায় 'স্কুইড গেম' মোটেও শীর্ষের দিকের জায়গা পাবে না। অন্ততপক্ষে এ সিজন তো নয়ই। এ সিজনের প্লটহোল এবং শূন্যস্থান যদি পরবর্তী সিজনে ট্যাকল দিতে পারেন নির্মাতা, তাহলেই হয়তো মতামত পরিবর্তনের সুযোগ আসবে। এর আগ পর্যন্ত তাই এটাই বলা যাবে, 'স্কুইড গেম' এক উপভোগ্য নির্মাণ৷ কিন্তু এটিকে নিয়ে হাইপ তোলা কিংবা উন্মাতাল হওয়া...সেগুলো হয়তো খানিকটা বাড়াবাড়িই। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা