সামনে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ পাঁচটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। এখন যদি ধর্মের বিভাজন তৈরি করে হিন্দু ভোটব্যাংক কাছে টানা না যায়, তাহলে তো বিপদ! তাই শাহরুখকে নিশাণা করো, ফুঁ কিংবা হিজাব নিয়ে বিতর্ক উস্কে দাও, সংখ্যালঘু মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলে হিন্দুদের জানান দাও যে, 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'!

ঘটনা এক

২০১৬ সালের কথা, জানুয়ারী মাস চলছে তখন। অল্প কয়েকদিন বাদেই মুক্তি পাবে শাহরুখ খানের সিনেমা 'রইস', তার এক সপ্তাহ বাদে আসবে হৃত্বিক রোশানের সিনেমা 'কাবিল'। দুই তারকার যুযুধান নিয়ে বলিউড তখন বেশ সরগরম। এরইমধ্যে আগুনে ঘি ঢাললেন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিজেপির এক নেতা। তিনি প্রকাশ্যে শাহরুখের বিরোধিতা করলেন। বললেন, রইসের মতো কোনও ডনকে (সেই সিনেমাটা গুজরাটের এক মুসলিম গ্যাংস্টারের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল) নিয়ে সিনেমা বানানোটা অনৈতিক। আরও বললেন, ‘‌নৈতিক বা অনৈতিক ব্যবসা করে রইস (‌ধনী)‌ সকলেই হতে পারে। কিন্তু কাবিল (‌যোগ্য)‌ কজনে হয়?‌’‌ 

পরের দিন হেডলাইন হয়ে গেল সেই খবর। শাহরুখের ব্যবসা মারতে সেই দলের সাইবার সেল নাগাড়ে হোয়্যাটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে ছড়াতে থাকলো রইসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির সম্পর্কে নানা নেতিবাচক তথ্য। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমনটাও লেখা ছিল- 'মুসলিম নায়কের সিনেমা দেখবেন না। হিন্দু নায়কের (‌হৃতিক রোশান)‌ সিনেমা দেখুন।' বক্স অফিসের ফলাফলে অবশ্য সেসব অপপ্রচার খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। কাবিল সেখানে পাত্তা পায়নি রইসের কাছে। হিন্দু মুসলমানের বিভাজন তখনও এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি ভারতে। 

ঘটনা দুই

২০২১, মুম্বাই থেকে গোয়াগামী এক প্রমোদ তরীতে অভিযান চালিয়ে আরও কয়েক তরুণের সঙ্গে শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানকে গ্রেপ্তার করলো ভারত সরকারের নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্ট। পাওয়া গেল কয়েক গ্রাম গাঁজা। তেইশ বছরের আরিয়ানকে নিয়ে পরের দেড় মাসে যা হয়েছে, কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের কাছে সেটাকে সীমাহীন বাড়াবাড়ি আর ক্ষমতার ভয়াবহ অপপ্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। আরিয়ানের অপরাধ এটা নয় যে সে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে মাদক গ্রহণ করতে গিয়েছিল। বরং তার অপরাধ এটাই যে, সে শাহরুখ খানের সন্তান৷ আর শাহরুখের অপরাধ? তিনি মুসলমান, বলিউডের বড় একটা অংশের মতো তিনি বিজেপির ছায়াতলে আসেননি- এটুকুই৷ মোদিরাজত্বে এটা বেশ গর্হিত কাজ বৈকি। 

পরের একটা মাস আরিয়ানকে নিয়ে যা তা হলো। সরকারের নারকোটিক্স ব্যুরো ভিত্তিহীন সব অভিযোগ আনলো, সাতাশ দিন জেল খাটলো আরিয়ান। টিআরপির নেশায় গোদি মিডিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ক্রমাগত আরিয়ানকে নিয়ে চাপান-উতোর খেলে গেল। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের ব্যর্থতা- সব ঢাকা পড়ে গেল শাহরুখ আর তার ছেলের নামে৷ শেষমেশ সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিলো আরিয়ানকে, তারপর জানালো, মাদক কাণ্ডে তার সরাসরি কোন যোগসূত্র ছিল না। ততদিনে অবশ্য বিজেপির আইটি সেল এবং গোদি মিডিয়ার কল্যানে অজস্র মানুষের কাছে আরিয়ান এবং শাহরুখ, দুজনের ইমেজই প্রশ্নবিদ্ধ৷ 

ঘটনা তিন

লতা মঙ্গেশকর মারা গেলেন ৯২ বছর বয়সে। শাহরুখের অনেক সিনেমার গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন, বলিউড বাদশার সঙ্গে তার সম্পর্কটাও ছিল ভীষণ ভালো। লতার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল শাহরুখের। কিংবদন্তী এই শিল্পীর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে অনেকদিন ধরেই মিডিয়াকে এড়িয়ে চলা শাহরুখ ছুটে গেলেন মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্কে, যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে লতার শেষকৃত্য। প্রিয় শিল্পীকে শেষ সম্মাননা জানাতে নিজের ম্যানেজার পূজা দাদলানির সঙ্গে অস্থায়ী বেদিতে উঠলেন শাহরুখ। দুজনে নিজ নিজ ধর্মমতে প্রয়াত লতার আত্মার শান্তি কামনা করলেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একজন হিন্দু এবং একজন মুসলিম নিজ নিজ স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছেন প্রিয় মানুষের আত্মার শান্তির জন্য- সেই ছবি ভাইরাল হলো সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেক্যুলার ভারত, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জয়গান গাওয়া হলো বলে খুশিতে সেই ছবি শেয়ার করলেন অজস্র নেটিজেন।  

লতা মঙ্গেশকরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন শাহরুখ

কিন্তু মুদ্রার উল্টো একটা পিঠ তৈরি হতে সময় লাগলো না। মোনাজাত শেষে মুখের মাস্কটা নামিয়ে লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহের উদ্দেশ্যে 'ফুঁ' দিয়েছিলেন শাহরুখ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে দোয়া করার এই রীতিটা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত, অশুভ শক্তিকে তাড়ানোর জন্যেই এটা করা হয়। শাহরুখও সেটিই করেছিলেন। কট্টরপন্থী হিন্দুরা এটাকেই নিশাণা বানালো। এবারও অগ্রগণ্য বিজেপির আইটি সেল। হরিয়ানা বিজেপি আইটি সেলের প্রধান কর্তা অরুণ যাদব প্রশ্ন তুললেন, শাহরুখ কি থুতু ছেটাচ্ছিলেন? অবান্তর প্রশ্ন, নার্সারিতে পড়ুয়া একটা বাচ্চারও বোঝার কথা। কিন্তু এই প্রশ্ন তো প্ল্যানমাফিক তোলা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের উল্লাস দেখে কট্টরপন্থীদের গায়ে আগুন না ধরে কি পারে? তাইতো বিজেপির একাধিক নেতা টুইট-রিটুইটে সরব হলেন। 

ধর্মের আফিমে বুঁদ হওয়া অজস্র মানুষ তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। গোদি মিডিয়া নামলো ফুঁ নাকি থু সেই প্রশ্ন নিয়ে। রাত পোহানোর আগে ন্যারেটিভটা বদলে গেল। যে ছবিটা অসাম্প্রদায়িক ভারতের প্রতিচ্ছবি ছিল, সেক্যুলারিজমের প্রতীক ছিল, ডাইভার্সিটির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, সেটিকেই বিতর্কিত করা হলো। কারণ ছবিটা শাহরুখ খানের। তিনি ধর্মে মুসলিম। সামনে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ আরও পাঁচটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। এখন যদি ধর্মের বিভাজন তৈরি করে  হিন্দু ভোটব্যাংক কাছে টানা না যায়, তাহলে তো বিপদ! তাই শাহরুখকে নিশাণা করো, হিজাব নিয়ে বিতর্ক উস্কে দাও, সংখ্যালঘু মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলে হিন্দুদের জানান দাও যে, 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'! 

তিনটে ঘটনার কথা বললাম। ২০১৬, ২০২১, ২০২২- প্রতিবারই শাহরুখ উগ্রবাদী হিন্দুদের নিশাণায় পরিণত হয়েছেন। আর তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বিজেপির নেতারা। এর একটা বড় কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে শাহরুখের সখ্যতা। ভারতের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেয়া এই দলটির হয়ে শাহরুখের বাবা তাজ মোহাম্মদ খান স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলেন, যখন তিনি কিশোর ছিলেন। শাহরুখ খানের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। তার মানে এই নয় যে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে শাহরুখের সম্পর্ক ভালো নয়। শাহরুখ কখনও অ্যাক্টিভ পলিটিক্স নিয়ে মুখ খোলেননি, রাজনীতিতে আসার অভিপ্রায়ও জানাননি৷ তবুও বিজেপির কাছে শাহরুখ অচ্ছ্যুৎ থেকে গেছেন বরাবর। তার মুসলমান পরিচয় এবং সেক্যুলার মানসিকতা বিজেপির কাছে শত্রুভাবাপন্ন মনে হয়েছে অকারণেই। 

গত ৫/৬ বছরের বলিউডকে যদি একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, দেখবেন, ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বলিউডের একটা বড় অংশ কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকেছে। ভোটের আগে অক্ষয় কুমার নরেন্দ্র মোদির 'অরাজনৈতিক ইন্টারভিউ' নিচ্ছেন, সবগুলো টিভি চ্যানেলে সেটা প্রচারিত হচ্ছে। অভিনেত্রী থেকে কঙ্গনা রনৌত পরিণত হয়েছেন বিজেপির বলিউড শাখার মুখপাত্রে, যাকে তাকে 'দেশবিরোধী' লাইসেন্স দেয়াটা যার প্রধান কাজ। একতা কাপুর থেকে করণ জোহর, ভিকি কৌশল থেকে রনবীর সিং- সবাই মুম্বাই থেকে বিমান ভাড়া করে দিল্লিতে ছুটে যাচ্ছেন মোদির সাথে সেলফি তুলতে। অথচ 'পদ্মাবত' রিলিজের আগে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে এই রনবীরের স্ত্রী দীপিকার গলা কেটে নিতে চেয়েছিল কট্টর হিন্দুরা, বিজেপি তখন তাদের সাহস যুগিয়েছিল। রনবীর সেটা ভুলে গেছেন হয়তো৷ মোদির ভারতে বাঁচতে গেলে গোল্ডফিশ মেমোরি নিয়েই সম্ভবত বাঁচতে হবে। 

আরিয়ান ইস্যুতে তিলকে তাল বানিয়েছিল গোদি মিডিয়া

একদম বিপরীত চিত্রও আছে। দেশের হাজারটা ইস্যুতে নাগরিকেরা যখন নাক ডাকছে, তখন এই বলিউডেরই ছোট্ট একটা অংশ সিস্টেমের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। স্বরা ভাস্কর হোন, অনুরাগ কাশ্যপ হোন, বিশাল দাদলানী, অনুভব সিনহা, তাপসী পান্নু কিংবা দীপিকা পাড়ুকোন- তারা সিএএ/এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে পথে নামছেন, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর আক্রমণ হলে সেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। সমাজ ও জনগনের প্রতি শিল্পীদের যে দায়িত্ব, সেটি পালনের মাধ্যমে প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছেন তারা। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিজেপির সেটি সহ্য হচ্ছে না, হবার কথাও নয় অবশ্য। 

স্বদেশ সিনেমার ওই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা মনে আছে? যেখানে মোহন (শাহরুখ খান) বলেন, 'আমি মানি না যে ভারত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে মহান দেশ। কিন্তু মহান হওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে...' ভারতের হয়তো সত্যিই মহান হওয়ার সামর্থ্য ছিল, শ্রেষ্ঠ হওয়ার সক্ষমতা ছিল। কিন্তু তাদের দেশের মানুষ যতদিন রাজনীতিবিদদের গেলানো ধর্মের আফিমে বুঁদ থাকবে, ততদিন তারা কেবল দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথেই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিদ্বন্দিতা করে যাবে। 

লোকে বলে, মরা হাতির দাম নাকি লাখ টাকা। শাহরুখ খানের শেষ কয়েকটা সিনেমা ভালো ব্যবসা করতে পারেনি, স্ক্রিপ্ট সিলেকশন ভালো হচ্ছে না, খানদের জমানা শেষ বলেও গুঞ্জন উঠছে। এতকিছুর পরেও বলিউডের সবচেয়ে বড় নাম কিন্তু শাহরুখ খান, বিশ্বমঞ্চে ইন্ডিয়ান ফিল্মের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডার তিনিই। বলিউডের সবচেয়ে বড় বোয়ালটাকে নিজেদের বাগে যে আনা যাবে না, সেটা বিজেপি জানে। শাহরুখ খানদের কেনা যায় না। বরং তাকে বিতর্কিত করে তার মেরুদণ্ডটা ভাঙা হোক। কখনও তার সিনেমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে, কখনও তার ছেলেকে ফাঁসিয়ে, কখনও আবার অযথা বিতর্ক উস্কে দিয়ে। 

তাতে অবশ্য শাহরুখের তেমন কিছু আসে যায় না। ইউটিউব চ্যানেল এআইবির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শাহরুখ নিজেই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বিতর্কে থাকার জন্য আমাকে কিছু করতে বা বলতে হয় না। ওটা এমনি এমনিই হয়ে যায়। এই থুথু বিতর্কেও শাহরুখের আসলে কিছুই আসবে যাবে না। আমাদের যাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে শাহরুখে বুঁদ হয়ে, এখনও তাকে দু'হাত ছড়িয়ে দাঁড়াতে দেখলে যাদের একটা হার্টবিট মিস হয়ে যায়, তাদের কাছেও এসব অহেতুক বিতর্ক খুব একটা পাত্তা পায় না। শাহরুখের 'ফ্যান' সিনেমার ডায়লগের মতোই এই অভিনেতা তো আমাদের কাছে 'সির্ফ স্টার নেহি, দুনিয়া হ্যায় হামারি!' 

মাই নেম ইজ খান সিনেমায় শাহরুখ খানের চরিত্রের নাম ছিল রিজওয়ান খান। ভারতীয় এই মুসলমানকে নিজের নামের জন্য বারবার বিড়ম্বনায় পড়তে হতো, বিশেষ করে ৯/১১ এর পরের বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে। সেই সিনেমার 'মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ টেরোরিস্ট' ট্যাগলাইনটা ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। মোদির ভারতে শাহরুখ খানকেও হয়তো এই প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। নামের পাশে খান, মুসলিম আইডেন্টিটি- এগুলো তো কট্টরপন্থার দিকে ধাবিত হওয়া হিন্দু রাষ্ট্রটিতে অপরাধেরই শামিল... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা