বহু বছর ধরে তিলে তিলে বানানো কোনো সিনেমা যদি বক্স অফিসে ফ্লপ হয়, তাহলে সেটার ধাক্কা কিভাবে সামলান সে সিনেমার পরিচালক সহ বাকিরা? বিগ বাজেটের কোনো সিনেমা যদি অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে, তাহলে সে ব্যর্থতার সাথে কিভাবেই বা মানিয়ে নেন তারা? কীরকমই বা হয় তখন তাদের আচরণ?

প্রেক্ষাগৃহে যখন কোনো একটা সিনেমা যখন মুক্তি পায়, তখন শুধুমাত্র একটা সিনেমাই মুক্তি পায় না। বরং সেই সিনেমার সাথে সিনেমা-সংশ্লিষ্ট মানুষদের দীর্ঘদিনের শ্রম-ত্যাগ, বহু মানু্ষের লগ্নি করা কষ্টার্জিত অর্থ আর অজস্র প্রত্যাশাও মুক্তি পায়। কিন্তু, দিনশেষে, সিনেমা নিয়ে শেষ কথা যেহেতু দর্শকই বলে, সেহেতু তাদের ইচ্ছেজনিত তারতম্যে সিনেমাটা যদি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়, তখন সেই ব্যর্থতার ধাক্কা কিভাবে সামলান সে সিনেমার পরিচালক সহ বাকিরা? বিগ বাজেটের কোনো সিনেমা যদি অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে, সে শোচনীয় পরিস্থিতির সাথে কিভাবেই বা মানিয়ে নেন তারা? কীরকমই বা হয় তখন তাদের আচরণ?

এ প্রসঙ্গে কিছু লিখতে গিয়ে প্রথমেই আশুতোষ গোয়ারিকরের ম্যাগনাম ওপাস 'মহেঞ্জোদারো'র কথা মনে পড়ছে। এ সিনেমা নিয়ে বেশ হম্বিতম্বি ছিলো কলাকুশলীদের। অবশ্য থাকারই কথা। দীর্ঘ দুই বছর ধরে যে যত্ন নিয়ে সিনেমাটা বানিয়েছিলেন আশুতোষ গোয়ারিকর, তা প্রশংসারই যোগ্য৷ সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ঋত্বিক রোশনও বেশ শ্রম দিয়েছিলেন 'মহেঞ্জোদারো'র জন্যে। কিন্তু বিস্ময় এটাই, সিনেমাটি বক্স অফিসে হোঁচট খায়। আর যেই মুহুর্তেই বক্স অফিসে ভরাডুবি হয়, পরমুহুর্তেই শুরু হয় ঋত্বিক-আশুতোষের দ্বৈরথ। ঋত্বিক নিজের অসন্তোষ জানিয়ে বেশ বড়সড় এক আক্রমনাত্মক চিঠি লেখেন আশুতোষকে। আশুতোষও কম না। তিনিও পালটা লেখা লেখেন। বেশ কাদা ছোঁড়াছুড়িই হয় সিনেমা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

এবং এই ঘটনা এটাই বোঝায়, সিনেমা বক্স-অফিসে ক্লিক না করলে, সিনেমার নানাপক্ষ মুখোমুখি সমরেও নামেন ক্ষেত্রবিশেষে। 'ব্লেম গেইম' এ একপক্ষের দোষ অন্যপক্ষের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টাও চালান তারা। 

'মহেঞ্জোদারো'র মত একইরকম ঘটনা হয়েছিলো রোহিত শেঠির 'দিলওয়ালে'র সময়ে। সিনেমাটা খুব ভালো চলেনি। যেহেতু রোহিত-শাহরুখ জুটির আগের সিনেমা 'চেন্নাই এক্সপ্রেস' হিট হয়েছিলো, সবার প্রত্যাশা ছিলো- এ সিনেমাও হয়তো উতরে যাবে বক্স অফিসের গেঁরো। কিন্তু তা হয়না। এবং না হওয়ার ফলশ্রুতিতে শাহরুখ- রোহিত দুই পক্ষেই নামেন লড়াইয়ে। শাহরুখের দাবী- রোহিত শেঠি ঠিকভাবে সিনেমা বানাতেই পারেননি। এদিকে রোহিত শেঠির উষ্মা- শাহরুখ, সঞ্জয় লীলা বানসালির 'বাজিরাও মাস্তানি'র সাথে একই সময়ে সিনেমা মুক্তি না দিলে এ সিনেমা ভালোই ব্যবসা করতো। শুরু হয় বিতর্ক। চাপানউতোর। দুই পক্ষের এ তুমুল বাদানুবাদ চলে বেশ কিছুদিন।

তবে 'সিনেমা ফ্লপ' হলেই যে সংশ্লিষ্টরা একে অন্যকে দোষারোপের নোংরা আয়োজনে নেমে পড়েন, এ বিষয় সবক্ষেত্রে সত্যিও না। 'বোম্বে ভেলভেট' সিনেমাটা যখন বক্স অফিসে ভালো করলো না, তখন এ সিনেমার নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ নিজেই সিনেমার ব্যর্থতাজনিত সব দায় নিলেন নিজের কাঁধে। জানালেন-

পরিচালকই টিম-লিডার। দায়টা মূলত তারই।

তবে নির্মাতা সব দোষ নিজের কাঁধে নিচ্ছেন বলে বাকি সবাই যে দায়মুক্ত হলেন, তেমনটাও না মোটেও। সিনেমার ব্যর্থতা কম বেশি সবাইকেই পোড়ায়। বলা যেতে পারে, আয়ুষ্মান খুরানার কথা। তার ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা 'ভিকি ডোনার' বেশ হিট হলো। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চারদিকে সপ্রশংস স্তুতিবাক্য। আয়ুষ্মান তখন রীতিমতো উড়ছেন। তবে সে ওড়া বন্ধ হলো তাড়াতাড়িই। এই সিনেমার পরের দুটি সিনেমাই হলো ফ্লপ। যে মানুষেরাই এতদিন তাকে প্রশংসা-সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছিলেন, তারাই খাপ খোলা কৃপাণ নিয়ে হলেন হাজির। আয়ুষ্মান খুরানার নাম হয়ে গেলো 'ফ্লপ অ্যাক্টর।' অনেকে তাকে সিনেমা ছেড়ে চণ্ডীগড় গিয়ে দোকান দেয়ারও পরামর্শ দিলেন। মানুষজনের সমালোচনা এতটাই তীব্র ছিলো, এক পর্যায়ে আয়ুষ্মান খুরানা ভেবেছিলেন, চলেই যাবেন নিজ গ্রামে। যদিও এরপর ঘটনা পালটায়। আয়ুষ্মান খুরানা থেকে যান বলিউডেই।

সমালোচনা নিতে না পেরে অভিনয়ও ছাড়তে চাইছিলেন আয়ুষ্মান খুরানা

'সিনেমা ফ্লপ' হলে তা অভিনেতাদের যে অনেকটাই দমিয়ে দেয়, তা আয়ুষ্মান খুরানার এ ঘটনা থেকেই স্পষ্ট। এই বিষয়টি বাস্তব বলিউডের 'মিঃ পারফেকশনিস্ট' আমির খানের ক্ষেত্রেও। যদিও তিনি বেশ সচেতনভাবেই স্ক্রিপ্ট বাছাই করেন। তাও দুয়েকটা ভুল হয়েই যায়। তেমনই এক ভুল 'থাগস অব হিন্দুস্থান।' এ সিনেমা যখন ফ্লপ হলো, যখন চারপাশ থেকে আসতে লাগতো কটুবাক্য, সে সময়ের বর্ণনা আমির খান দিয়েছিলেন এভাবে-

সিনেমা ফ্লপ হলে খারাপ লাগে। পাগলের মত খারাপ লাগে। কিন্তু সে সিনেমার জন্যে দর্শকেরা যখন বাজে মন্তব্য করে, তখন আরো বেশি খারাপ লাগে। আমি এমনিতেই ইমোশনাল মানু্ষ। এই ধাক্কা গুলো খুব একটা নিতে পারিনা। সিনেমা ফ্লপ হলে তাই ডিপ্রেশনে চলে যাই। বাইরে নামিনা। ঘরে থাকি। কান্না করি। প্রচুর কান্না করি। এভাবে, ধীরে ধীরে ধাতস্থ হই। 

তবে 'সিনেমা ফ্লপ' হলে সবাই যে ভালনারেবল হয়ে পড়েন, বিষয়টা এমনও না৷ 'ব্যর্থতা' থেকে অনেকে নানারকম শিক্ষাও পান। যেমনটা পেয়েছিলেন রনবীর কাপুর৷ তার সিনেমা 'সাওয়ারিয়া' যখন বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে পারলো না, তখন থেকেই তিনি সিনেমা বাছাইয়ে হয়ে পড়লেন সচেতন। নিজেকেই নিজে বোঝালেন, সিনেমায় অভিনয়ের আগেই যদি সে সিনেমার ভবিষ্যৎটা দেখে নেওয়া যায়, তাহলেই হয়। ঝোঁকের বশে আবেগি সিদ্ধান্ত না, সিনেমার ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করতে হয় সিনেমার দোষ-গুণ দিয়েই। রনবীর কাপুরের জন্যে 'সাওয়ারিয়া' এরকমভাবেই হয়েছিলো এক জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা।

তবে বক্স অফিসে সিনেমা ফ্লপ হলে, সে ধাক্কা কিভাবে কাটানো উচিত, এটা নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর কথা বলেছিলেন ইরফান খান। তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-

আমি অভিনেতা। আমার কাজ অভিনয়। অভিনয়ের এই যে জার্নি, একটা ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকে পড়ার এই যে রোমাঞ্চ, এটা আমি উপভোগ করতে পারছি কি না, মূখ্য সেটাই। যদি আমার অভিনয় আমি উপভোগ করি, তাহলে সিনেমা ফ্লপ/হিট নিয়ে খুব একটা ভাবিনা। আবার, যদি অভিনয়টা উপভোগ্য না হয়, তাহলেও ফ্লপ/হিট নিয়ে ভাবিনা। আমার কাছে মূখ্য অভিনয়। চরিত্রের সাথে সহাবস্থান। বাকিসব তো বাইপ্রোডাক্ট। এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

সিনেমা ফ্লপ/হিট নিয়ে ইরফান খানের কথাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক

মূল বিষয় এটাই। জনতা-জনার্দন কোনো একটা সিনেমা নিয়ে কেমন আচরণ করবে, তা জানা নেই কারোরই। সুতরাং, তা নিয়ে ভেবেও খুব একটা সুবিধে নেই। এরচে বরং সিনেমা-সংশ্লিষ্ট মানুষেরা সর্বোচ্চ যে কাজটি করতে পারেন, সেটি হচ্ছে- নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকঠাক সামলানো। মূলত, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটুকু ঠিকঠাকভাবে করতে পারলে, বাকিসব আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো আপনা-আপনিই হয়ে যায়। খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা