সুচিত্রা সেন সারাজীবন নিজের আশেপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। এই রহস্যই যেন তাকে আরো আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় করেছে। 

কৃষ্ণা (ডাক নাম) নামের সুন্দরী, সুহাসিনী মেয়েটি যখন তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশের পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন, তখন কি কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল এই মেয়েটি এক বিরল ইতিহাস রচনা করে দেখাবে? না, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া নয়, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে একদম অন্যরকম কিছু যা এর আগে বা পরে কেউ করে দেখতে পারেনি। সেই পঞ্চাশের দশক, সমাজ আরো কত কড়া ছিল, মানুষ আরো অনেক অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল; অথচ সেখানে, সেই সময়ে একজন নারী রমা দাসগুপ্ত থেকে সুচিত্রা সেন হতে পেরেছিলেন! ত্রিশ বছর অতিক্রম করলে কিংবা বিবাহিতা হলে সে নারী নাকি বাতিলের খাতায় চলে যায়!

অথচ তাঁর স্বামী যখন তাঁকে প্রথমবার নিজেদের আলিশান গাড়িতে করে টালিগঞ্জের ফিল্মপাড়ায় নামিয়ে দিতে এসেছিলেন, তখন তিনি দু'টি সন্তানের মা ছিলেন। একটি ছেলে যে জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা গিয়েছিলো এবং একটি মেয়ে যার তখন অল্প কয়েক বছর বয়স মাত্র। বনেদি বাড়ির বৌ, শ্বশুর মশাইয়ের খুব স্নেহ ও প্রিয় পাত্রী। মূলত স্বামী ও শ্বশুরের অনুপ্রেরণাতেই তার অভিনয় জগতে আবির্ভাব। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যুগে যুগে পুরুষেরা ডমিনেট করেছে। সব রকমের জি হুজুর নায়কদের করা হয়, সহঅভিনেত্রী পছন্দ/বাছাই করার অধিকার তাদের দেয়া হয়, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চিত্রনাট্য, দৃশ্য বা সংলাপ পরিবর্তন করা হয় এবং সর্বোপরি তাদের পারিশ্রমিক বা সম্মানীও নায়িকা/অভিনেত্রীদের থেকে বহুলাংশে বেশি। নারী শিল্পীরা সেটা মেনেই কাজ করে আসছেন।

সুচিত্রা সেন

এক সুচিত্রা সেনই ছিলেন যিনি কোনো কালেই এই নিয়ম মানেন নি, প্রথা ভেঙে নিজের জন্য নতুন প্রথা গড়েছিলেন তিনি। এক অসম্ভব শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল তার, যেই ব্যক্তিত্বের জোরে সকলকে ধরাশয়ী করে ফেলতে পারতেন। কারো সাহস হতো না তার কথা অমান্য করার বা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেয়ার। দুই বাংলার প্রথম মহানায়ক উত্তম কুমার বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের এক বিশেষ ভালবাসার নাম, এ কথা কে না জানে?

এই মানুষটি শুধু জীবিতকালেই মানুষের হৃদয়ে রাজত্ব করেন নি, মৃত্যুর এতো বছর পরও তার সেই সিংহাসন অক্ষত রয়েছে। সেই উত্তম কুমারও সুচিত্রার ব্যক্তিত্বের কাছে হার মেনেছিলেন। এই জুটির ছবিগুলোর টাইটেলে ক্রেডিটে সুচিত্রা সেন নামটি আগে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বরাবর দেখেছি সুচিত্রা সেন-উত্তম কুমার অভিনীত ''.....'' , কখনো চোখে পড়েনি, উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ''......''। উত্তম কুমারের আর কোনো নায়িকার ক্ষেত্রে কিন্তু এটা দেখা যায় না। তার আরো অনেক অভিনেত্রীর সাথে সফল জুটি ছিল, তাদের মধ্যে একজনকে তিনি বিয়েও করেছিলেন। অথচ ছবিতে নাম দেয়ার সময় নিজের নামটিই সব সময় আগে রেখেছেন। শুধু সুচিত্রার বেলায় ব্যতিক্রম। কি অবাক করা ব্যাপার, না?

বোম্বেতে অভিনয় করতে যাওয়া সর্বকালেই অভিনেতা/ অভিনেত্রীদের জন্য চরম আকাঙ্খার বিষয়। কাল পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু একজন অভিনয়শিল্পীর এই চাওয়া পরিবর্তন হয়নি। মিসেস সেন এক্ষেত্রেও একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে গেছেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে হিন্দি ছবির জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমা নির্মাতা, নির্দেশক ছিলেন রাজ কাপুর। তার ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার জন্য নায়িকারা নাকি নিজেদের হাত, পা কেটে ফেলতেও রাজি ছিলেন এমন কাহিনী শোনা যায়!

সেই রাজ কাপুরকে সুচিত্রা সেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ রাজ কাপুরের পার্সোনালিটি তার পছন্দ হয়নি। নির্ভীক সুচিত্রা সেসময় মিডিয়াতে খোলাখুলি ও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ভঙ্গিতে রাজ কাপুর তার (সুচিত্রার) পায়ের কাছে বসে তাকে ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই ভঙ্গি তাকে (রাজ কাপুরকে) সুচিত্রার কাছে হালকা চরিত্রের মানুষ হিসাবে পরিচয় করে দিয়েছিলো। আর সুচিত্রা এরকম হালকা ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের অপছন্দ করেন।

সেই ষাটের দশকে একজন রিজিওনাল অভিনেত্রী রাজ কাপুরের মতো প্রভাবশালী একজন মানুষকে নিয়ে এমন কথা বলছেন, ভাবা যায়? সুচিত্রা সারাজীবন নিজের শর্তে নিজের জীবন কাটিয়েছেন। সুযোগের পেছনে ছোটেন নি, বরং সুযোগ নিজেই বারবার তার কাছে এসে ধর্ণা দিয়েছে। মানুষের চোখে যা লোভনীয় সেরকম অনেককিছু তিনি পেয়েও অগ্রাহ্যভরে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

কেউ কেউ তাকে অহংকারী, রাগী, খামখেয়ালি বিভিন্ন নাম অভিহিত করেছে, এতে তার কোনোদিনও কিছু এসে যায়নি। কারো জন্য নিজেকে বা নিজের কোনো সিদ্ধান্ত বা স্বভাব পরিবর্তন করেন নি, যা তার ভালো লেগেছে ঠিক সেটাই করে গেছেন। ১৯৭৮ সালে তার অভিনীত সর্বশেষ ছবিটি মুক্তির পর সেই যে লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার মৃত্যু পর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত বহাল ছিল। দীর্ঘ পয়ত্রিশটি বছর নিজেকে কারো সামনে আনেননি!

মানুষের এতো আগ্রহ, এত আকুলতা, এতো অনুনয় কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। পঁয়ত্রিশ বছরে তাকে এক ঝলকের জন্যও বাইরের কোনো মানুষ দেখতে পায়নি। এতটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে দাদাসাহেব ফালকের (ভারতে চলচ্চিত্রের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ পুরস্কার) মতো পুরষ্কার নিতে যেতে পর্যন্ত তিনি অস্বীকার করেছিলেন কারণ পুরষ্কারটি গ্রহণ করতে হলে তাকে দিল্লী যেতে হতো!

কথায় আছে, যখন কোনো মানুষ নিজের সম্পর্কে শুধুই ভাল কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন নিজের প্রতি মানুষের এক ভয়ঙ্কর উঁচু ধারণার তৈরী হয়। নিজের সম্পর্কে মানুষ এতটাই পসেসিভ হয়ে যায় যে, সে ধরেই ভেবে নেয় এই প্রশংসা, এই এডমিরেশন এগুলো চিরকালের জন্য। ধীরে ধীরে বয়সের সাথে সাথে যখন এই প্রাপ্তিগুলো কমে আসতে শুরু করে, তখন ভালোবাসার আধিক্যে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষটা সেটা সহ্য করতে পারে না। অনেকের ক্ষেত্রেই নানান রকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

কিছু লোকে বলে সুচিত্রা হয়তো নিজেকে সেই অবস্থানে দেখতে চাননি, তাই আগেই সরে গেছেন। তিনি চাননি, তার বৃদ্ধারূপ কেউ দেখুক। তিনি মানুষের মনে যুগে যুগে সেই আভিজাত্যের প্রতীক, সেই চিরসুন্দরী, চির অম্লান ও অপূর্ব হাসির অধিকারিণী হয়েই থেকে যেতে চেয়েছেন। আর সেকারণে তার এই এতগুলো বছর ধরে নিজেকে আড়াল করে রাখা। বক্তব্যটি নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু পুরো ব্যাপারটি যে রহস্যময় সেটি নিয়ে কারো দ্বিমত নেই! এই রহস্যই যেন তাকে আরো আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় করেছে। 

সুচিত্রা সেন সারাজীবন নিজের আশেপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। এমন অসম্ভব সাহসী, বেপরোয়া এবং দৃঢ়চেতা একজন সেলিব্রিটি সে যুগে বিরল ছিল। আর শুধু সে যুগে কেন? যুগে যুগে তার মতো সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা, দাপুটে অভিনেত্রীর জুড়ি মেলা ভার। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজ ব্যক্তিত্বের বলে বলীয়ান ক'জন হতে পারে?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা