যে সময়ে নারীরা ঘরের বাইরে যেতো কদাচিৎ, সেই সময়ে তিনি দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, কিন্ত তাকে প্রাপ্য সম্মানটা দিতে পারেনি এদেশ। বেঁচে থাকতে পাননি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, মৃত্যুর পরেও জোটেনি কোন পদক। এই প্রজন্ম হয়তো সুমিতা দেবীর নামটাও জানে না...

ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে হেনা ভট্টাচার্য,বিয়ে হয় অমূল্য লাহেড়ীর সঙ্গে। কিন্তু এই বিয়ে সুখের হয়নি,স্বামী ভারতে চলে যান। ভাগ্যের চাকা ঘুরে এলেন চলচ্চিত্রপাড়ায়। ফতেহ লোহানীর 'আসিয়া'য় সুমিতা দেবী হয়ে নিজের নতুন নামে দর্শকদের সামনে এসেছিলেন। আসিয়া প্রথম চুক্তিবদ্ধ ছবি হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'এ দেশ তোমার আমার'।

আসিয়া মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে, ততদিনে মুক্তি পায় আরো দুইটি ছবি আকাশ আর মাটি, মাটির পাহাড়। আসিয়া মুক্তির পর বদলে যায় সুমিতা দেবীর নায়িকার ক্যারিয়ার। এফডিসিতে নির্মিত এই ছবি সমালোচক মহলে বেশ সমাদৃত, সেরা বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে ছবিটি প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছিল। খেতাব পান ফার্স্ট লেডি সুমিতা দেবী।

১৯৬১ সাল। অভিনয়ের ক্যারিয়ারই বলুন, ব্যক্তিজীবন বলুন; দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। জহির রায়হানের 'কখনো আসেনি', যা বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে স্বীকৃত। যুগের চেয়ে আধুনিক ধারার এই ছবি সব সময়ের দর্শকদের পছন্দের ছবি। একই বছরে বিয়ে করেন জহির রায়হান, ধর্মান্তরিত হয়ে নাম হল নীলুফার বেগম। তবে চলচ্চিত্রে সুমিতা দেবী নামেই রেখেছেন।

সুমিতা দেবী ও জহির রায়হান

কাঁচের দেয়াল ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়ের ছবি। ততদিনে জহির রায়হানের সহধর্মিনী তিনি। ছবিটা আর্ন্তজাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত, দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন উনার অভিনয়। এই দেশের প্রথম রঙ্গিন ছবি জহির রায়হানের 'সঙ্গম' থেকে সোনার কাজল, সঙ্গে বেহুলার বিশেষ উপস্থিতি। দুই দিগন্ততে তিনি স্মরনীয় হয়ে আছেন। বাংলা, উর্দু ছবি মিলিয়ে একের পর এক ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন।

১৯৬৭ সালে প্রযোজক হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেন আগুন নিয়ে খেলা ছবির মাধ্যমে, এরপর আরো কিছু ছবি প্রযোজনা করেন। নায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ার দীর্ঘ না হলেও এই দেশের নায়িকাদের অগ্রপথিক হিসেবে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত। ওরা ১১ জন, সুজন সখী, দুই পয়সার আলতা, চিত্রা নদীর পাড়ে সহ অনেক ছবিতেই ছিলেন পার্শ্ব চরিত্রে।

সুমিতা দেবীর বিয়ে ভাগ্য সুখের হয়নি। জহির রায়হান বিয়ে করেন সুচন্দাকে, সুমিতা দেবী এইসবের কিছুই জানতেন না। যখন জানলেন, তখন জহির রায়হানের বাড়িতে তড়িঘড়ি করে এসেছিলেন, কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। ততদিনে কোল আলো করে এসেছে দুই সন্তান বিপুল আর অনল, সঙ্গে প্রথম সংসারের সন্তান কল্লোল। স্বামীর ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পড়েছিলেন অথৈ জলে। তবুও সামলিয়েছেন নিজেকে, নায়িকার ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে পার্শ্ব চরিত্র নিতে হয়েছিল সিনেমাতে।

সুমিতা দেবী

কিছু বছর বাদে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ, নিজেকে জড়িয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। বেতারের শব্দসৈনিক থেকে কলকাতায় নানান কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছেন। স্বাধীনতার পর এফডিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজের ছেলেদের বাবা জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার পর অনেক তদবির করেছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। নায়ক সোহেল রানা, নূতনদের সিনেমায় এনেছেন তিনি।

২০০৪ সালের ৬ই জানুয়ারি দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে জীবনাবসান ঘটে এই কিংবদন্তির। বেঁচে থাকতে পাননি রাষ্ট্রীয় সম্মান, পাননি মরনোত্তর সম্মাননা। নায়িকাদের অগ্রপথিককে আজও দেয়া হয়নি একুশে পদক। যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন, নতুন প্রজন্মদের কাছে তিনি এখন অচেনা। সুমিতা দেবীর মূল্যায়ন করতে হবে দর্শকদেরই। তাকে যারা চিনেন জানেন, তাদেরকে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

সুমিতা দেবী চিরঅম্লান হয়ে থাকুক.... দর্শকদের মনে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা