
ইন্সটাগ্রাম পোস্টের ক্যাপশনেই হয়তো আত্মহত্যার আভাস দিয়েছিলেন এই অভিমানী মানুষটা। ‘ক্ষীণ হয়ে আসা জীবনের’ কথা সুশান্তের পরিবার বা কাছের কেউ কি আঁচ করতে পেরেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন যুক্তিহীন...
ব্যাপারটা সেলুলয়েডের পর্দায় হলে আমরা একটু নড়েচড়ে বসতাম একটা জমজমাট সাসপেন্স বা থ্রিলার মুভি দেখার আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু এটা সিনেমা নয় এটা কঠিন এক ভয়ংকর বাস্তব। রূপালি পর্দার আলো ঝলমলে দুনিয়ার ব্যাকস্টেজটা আসলে আমাদের চিন্তার বাইরে। গ্ল্যামার, খ্যাতি, টাকা-পয়সা, রূপ বা জনপ্রিয়তাটা ক্যামেরার সামনে থাকে বলে সেটাই আমরা ভক্তরা সত্যি বলে মেনে নেই। কিন্তু পেছনের গল্পটা যে অন্যরকম হয় বা হতে পারে সেটি আমাদের মাথায় আসে না। অবশ্য আসার কথাও না। তবে হঠাৎ কখনো কখনো এই গল্পটা সামনে আসে নিষ্ঠুরতার সাথে যা সাধারন মানুষদের কাছে এক বড় ধাক্কার মতোন। তেমনই একটি গল্প সামনে আসে গত বছর সুশান্ত সিং রাজপুতের আকস্মিক চলে যাবার মধ্য দিয়ে।
বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেছিলেন গত ১৪ই জুন। স্বপ্ন নগরী মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় তার মনমতো সাজানো ফ্ল্যাটে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে তার মরদেহ। ঘরের দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সংস্থা থেকে পাওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিনি গত ছয় মাস ধরে হতাশায় ভুগছিলেন। গত তিনমাস ধরেই একভাবে বলা যায় গৃহবন্দী ছিলেন। তার কাছের বন্ধুরাও বলেছেন একই কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে টেলিভিশন চ্যানেল সবখানেই আজ সুশান্ত সিং রাজপুতের এই অসময়ে চলে যাওয়ার গল্প। অসময়ে চলে যাওয়া এই বলিউড অভিনেতার জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে আজ ৩৫ বছর পূর্ণ করতেন তিনি। তাকে নিয়েই এই বিশেষ ফিচার।
বলিউডে আগে একটা সময় ছিল যখন বড় বড় তারকাদের নিয়ে বিগ বাজেটের সিনেমার প্রতিই দর্শক বা প্রদর্শকদের আগ্রহ লক্ষ্য করা যেতো। বিশেষ দিন বা কোনো উপলক্ষ্য ছাড়াই বিগ বাজেটের সিনেমা বক্স অফিসেও ঝড় তুলতো সফলতার সাথে। তবে বিশ্বের অন্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মতোই বলিউডেও খুব অল্প সময়ের মাঝেই অল্প বাজেটের কন্টেন্ট নির্ভর সিনেমার প্রতি দর্শকদের ব্যাপক চাহিদা এবং আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছর ধরে ‘ভিন্নধর্মী গল্প, দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী, অসাধারণ প্রেজেন্টেশন’ এই নীতি অনুসরণ করে বক্স অফিস, পুরস্কার এবং সমালোচক এসব ক্ষেত্রেই একের পর এক চমক উপহার দিয়ে যাচ্ছে নবীন এবং মেধাবী নির্মাতা এবং সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত মানুষগুলো।
সেই ধারাবাহিকতায় বলিউড উপহার দিয়ে যাচ্ছে কিছু নতুন কিন্তু মেধাবী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। রাজকুমার রাও, আয়ুস্মান খুরানা, ভিকি কৌশল, তাপসী পান্নু, ভূমি পেডেনকার, রাধিকা আপ্তে, নুসরাত, কার্তিক আরিয়ান, কৃতি শ্যানন বা সুশান্ত সিং রাজপুত এর মতো একঝাক দক্ষ এবং সম্ভাবনাময় শিল্পীদের নিয়ে আজ বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নতুন ইতিহাস তৈরী করছে। এদের প্রত্যেকেই নিজেদের মেধা এবং দক্ষতা দিয়ে নিজেদের প্রমান করেছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। ভিন্নধর্মী এই এক্সপেরিমেন্ট বক্স অফিস সফলতা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা উভয়ই কুড়াচ্ছে। বলিউডের এই নতুন জোয়ারের অন্যতম এক নাম সুশান্ত সিং রাজপুত। ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড’ দিয়ে নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দর্শক বুঝেছিল, ধোনিরা কেন কখনোও হারতে জানে না।
জীবন দশায় মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ সিনেমা ‘ছিঁছোড়ে’ দিয়ে আবারো আলোচনায় এসেছিলেন। এই সিনেমায় তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে তার টিনএজ ছেলেকে শিখিয়েছিলেন জীবনটা সুন্দর। অনেক বাধা-বিপত্তি, না পাওয়া বা ব্যর্থতাকে জয় করেই আমাদের বেচে থাকতে হবে। তবে বাস্তব জীবনে নিজেই এই বার্তা মনে রাখলেন না সুশান্ত। এই না পারাটাই তার ভক্তদের মাঝে হতাশা আর কষ্ট হয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
সুশান্ত সিং রাজপুত জন্মগ্রহন করেন বিহারের পাটনায়। তার বাবা একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ২০০২ সালে তার মা মারা যাওয়ার পর পরিবারসহ দিল্লিতে চলে আসেন। অভিনেতা সুশান্ত সিংয়ের চার বোনদের মধ্যে একজন মিতু সিং রাষ্ট্রীয় স্তরের ক্রিকেটার। সুশান্ত সিং সেন্ট কারেন্স হাই স্কুল তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন এবং পরে দিল্লির কুলাচি হংসরাজ মডেল স্কুলে। তিনি অ্যাকাডেমিকভাবে খুবই উজ্জ্বল ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানে জাতীয় অলিম্পিয়াডও জিতেছিলেন। তিনি অল ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৭ম স্থান অর্জন করেছিলেন। সুশান্ত সিং রাজপুত দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। কিন্তু তিন বছর পর পড়াশুনো ছেড়ে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন।
দিল্লি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার নাচের প্রতি আগ্রহ ছিল । তাই বলিউডের অন্যতম সেরা কোরিওগ্রাফার শ্যামক দাভারের ড্যান্স গ্রুপে যোগদান করেন। তার নাচের প্রতি প্রভাবিত হয়ে ২০০৬ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে এবং কমনওয়েলথস গেমস পারফর্ম করার সুযোগ করে দেয়। শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানোর সুশান্ত সিং রাজপুত সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি অভিনয় জগতে তার ক্যারিয়ার গড়বেন। তাই অভিনয়ে দক্ষ হওয়ার জন্য তিনি থিয়েটার ক্লাসে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি ব্যারি জনের কাছ থেকে অভিনয় শিখলেন। থিয়েটার পারফরমেন্স করার সময় তার ব্যক্তিত্ব এবং অভিনয়ের প্রতিভা বলিউডের নামীদামি প্রডাকশনস হাউজ বালাজী টেলিফিল্মের কাস্টিং দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২০০৮ সালে বালাজি টেলিফিল্মস সুশান্ত সিং রাজপুতকে ‘কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ ধারাবাহিক প্রিত জুনেজার চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ধারাবাহিকে তার চরিত্র খুব কম সময়ের জন্য থাকলে তার অভিনয় প্রচুর লোকের মন কেড়ে নেয়। তবে আক্ষরিক অর্থে ২০০৯ সালে আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘পবিত্র রিশতা’ যেখানে তাকে মানব দেশমুখের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে সেটি দিয়েই ছোট পর্দায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। এই ধারাবাহিকটি ছিল তখনকার সময়ে টিআরপির নিরিখে অন্যতম সেরা ধারাবাহিক। অঙ্কিতা লোখান্ডে এবং সুশান্ত সিং রাজপুতের জুটি দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। বাস্তবেও তারা একে অন্যের প্রেমে ডুবে যান।
২০১০ সালে সুশান্ত সিং রাজপুত সনি টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় ড্যান্স রিলেয়েটি শো ‘ঝালাক দিখলা যা’ সিজন -৪ এ অংশগ্রহন করে বিজয়ী হন। এরপরেই বলিউড থেকে ডাক পান তিনি। ২০১১ সালের শেষ দিকে ছেড়ে দেন ‘পবিত্র রিশতা’। তিন বছর ধরে জনপ্রিয় চরিত্রে অভিনয় করে সবার হ্নদয়ে জায়গা করে নিলেও যার স্বপ্ন বলিউড তাকে তো আটকে রাখার জো নাই।
২০১৩ সালে তার অভিনেতা হিসেবে বলিউডে অভিষেক হয় তাঁর। সুশান্ত সিং রাজপুতের প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমা ‘কাই পো চে’। অল্প বাজেটের এই সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় এবং সমালোচকদের থেকে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করে। সিনেমায় তাঁর অভিনয় আলাদা ভাবেই নজর কাড়ে দর্শক এবং সমালোচকদের।এরপরেই বলিউডের সবচেয়ে বড় প্রযোজনা সংস্থা ইয়াশ রাজ ফিল্মসের মনীষ শর্মার পরিচালিত ‘শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স’ সিনেমাতে পরিণীতি চোপড়া এবং বাণী কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। প্রথম সিনেমার সেই সুশান্ত আর এই সিনেমার রোমান্টিক চরিত্রের সুশান্ত দুটো বিপরীত চরিত্রে অভিনয় করে নিজের যোগ্যতার প্রমান দেন তিনি।এই সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে তেমন সফলতা না পেলেও গান এবং তার পারফরম্যান্স নজর কাড়ে সকলের।
২০১৪ সালে সুশান্ত সিংক রাজপুতকে অলটাইম ব্লকবাস্টার ‘পিকে’ সিনেমায় একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় দেখা যায়। ২০১৫ সালে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বকশি’ সিনেমায় বিখ্যাত গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বকশির ভুমিকায় অভিনয় করেন তিনি। সিনেমাটি ফ্লপ হলেও তার অভিনয় দক্ষতার ছাপ রাখতে ভুল করেননি তিনি। বক্স অফিসে থুবরে পড়লেও আন্তর্জাতিক অংগনে এবং সমালোচকদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা পান তিনি। তবে তাকে তারকাখ্যাতি বা স্টারডম এনে দিয়েছে ২০১৬ সালের ‘এম এস ধোনি দ্যা আনটোল্ড স্টোরি’ সিনেমাটি। ভারতীয় ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবনী নিয়ে এই সিনেমাটি তৈরি করা হয়। এই সিনেমায় তার অভিনয় মহেন্দ্র সিং ধোনিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এটাই একজন অভিনেতার সাফল্য যে সেলুলয়েড এর পর্দায় চরিত্রটিই মনে গেথে থাকবে। বক্স অফিসে এই সিনেমাটি সুপারহিট ব্যবসা করে।
‘এম.এস.ধোনি দ্যা আনটোল্ড স্টোরি’ সিনেমাটির জন্য সুশান্ত সিং রাজপুত ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেতা হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এই বায়োপিকে অভিনয়ের ফলে ভারত তো বটেই অন্যান্য দেশের অনেক ক্রিড়া ব্যক্তিত্বের কাছেও পরিচিতি পান এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তার মৃত্যুর খবরে শচীন টেন্ডুলকার, শোয়েব আখতার, ইরফান পাঠান সহ আরো অনেক জনপ্রিয় খেলোয়াড় টুইট করে তাদের শোক জানিয়েছেন।
২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাবতা’ বক্স অফিসে ফ্লপ হয়। এই সিনেমায় তার অভিনয় তেমনভাবে দাগ কাটতে পারেনাই। তবে তার সিক্সপ্যাক এবং টোনড বডি সাথে কৃতি শ্যাননের সাথে কেমেস্ট্রি প্রশংসা পায় সবার কাছে। ২০১৮ সালে ‘কেদারনাথ’ সিনেমায় সাইফ-অমৃতা কন্যা সারা আলির সঙ্গে জুটি বাঁধেন সুশান্ত। সিনেমাটিতে তাকে একটি মুসলিম যুবকের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। এই সিনেমায় তার অভিনয় মন জয় করে নেয় সকলের। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে সাফল্য অর্জন করে। সাথে সারার সাথে তার জুটিও প্রশংসা কুড়ায়। প্রেমের গুঞ্জন ছড়ালেও পরে তা শুধু গুজব বলেই প্রমানিত হয়। এরপরে ‘কামিনে’, ‘ইশকিয়া’, ‘উড়তা পাঞ্জাব’-এর মতো সিনেমার পরিচালক অভিষেক চৌবের ‘সোনচিড়িয়া’ সিনেমায় তাকে এক ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। বক্স অফিসে ব্যর্থ হলেও তার অভিনয় নজর কাড়ে সকলের। ২০১৯ সালে শিক্ষক দিবসের আবহে মুক্তি পেয়েছিল সুশান্ত সিং রাজপুত ও শ্রদ্ধা কাপুরের ‘ছিচোড়ে’। প্রথম দিনেই তাক লাগানো ব্যবসা করে ফেলে বক্স অফিসে। সেভাবে প্রচারে না থাকা ও কম বাজেটের সিনেমা হলেও ‘দাঙ্গাল’ খ্যাত নিতেশ তিওয়ারির পরিচালনায় এই সিনেমা কন্টেন্ট, উপস্থাপনা, অভিনয় দিয়ে সপ্তাহ শেষে হিট সিনেমার তকমা পেয়ে গেছে ‘ছিচোড়ে’। এই সিনেমা নিয়ে আবারো আলোচনায় ফেরেন সুশান্ত সিং রাজপুত। সিনেমায় তার অভিনয়, শ্রদ্ধা কাপুরের সাথে তার জুটি নিয়েও আলোচনা চলেছে। সফলতার দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এই সিনেমা নিয়ে আবারো ফিরেছিলেন তিনি। এছাড়া করন জোহরের প্রযোজনায় নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ড্রাইভ’ সিনেমায় জ্যাকলিন ফার্নান্দেজের সাথে দেখা গেছে তাঁকে।
লকডাউনে বাসায় থাকাকালীন সময়ে ডিপ্রেশন রোগটি আরো বিকট হয়ে ধরা দেয় অভিনেতার কাছে। আগে থেকেই ডিপ্রেশনে ছিলেন তিনি। চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর পর জানা যায় মাদকাসক্ত ছিলেন তিনি। হয়তো ডিপ্রেশন, মাদক এবং ব্যক্তি জীবনে প্রেমিকা রিয়ার সাথে বাড়তে থাকা মানসিক টানাপোড়েন সবমিলিয়ে নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি। শোনা গেছে বলিউডের বেশকিছু প্রজেক্ট থেকে বাদ পড়াও মেনে নিতে পারেননি। তবে এসবের কোন কিছুই আত্মহত্যাকে বেছে নেয়ার ইচ্ছাটাকে সাপোর্ট দেয়না। তার মৃত্যুর পর বলিউডে মাদক নিয়ে তো রীতিমতো হইচই বেঁধে গেলো। অনেকেই তার মৃত্যুর ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে ইমোশনালি নিজেদের ক্ষোভ আর অস্থিরতা ঝাড়ার সুযোগ লুফে নিলেন। তবে একটা সময় সবই ঠান্ডা হলো তবে ভক্তদের মনে এক কষ্ট হিসেবে রয়ে গেলেন সুশান্ত সিং রাজপুত।
তার আকস্মিক বিদায়ের পর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় ‘দিল বেচারা’। তার ভক্ত এবং স্রোতে গা ভাসানো অতি উৎসাহী মানুষজন সিনেমা মুক্তির আগেই আবেগের বশে আইএমডিভিতে শতভাগ রেটিং দিয়েছেন, সুশান্তের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখাচ্ছেন। সেটাতে তো আমাদের আপত্তি নেই। তবে তিনি বেচে থাকতে তার ‘সোনচিড়িয়া’র মতো নান্দনিক সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাননি এই ভক্তদের ১০ ভাগের এক ভাগও। এই ভালোবাসার অর্ধেকটাও সুশান্ত বেচে থাকতেই তার কাজের প্রতি দেখালে কিন্তু তিনি হয়তো আজ আমাদের মাঝেই থাকতেন!
বেঁচে থাকলে হয়তো এখন তিনি শ্যুটিং করতেন ইয়াশ রাজ ফিল্মসের ‘পানি’ সিনেমার। এই সিনেমায় তাঁর সাথে জুটি বাধতেন বলিউডের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী আনুশকা শর্মা। ১৯৭০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্নজয়ী ভারতীয় অ্যাথলেট মুরলিকান্ত কে নিয়ে নির্মিতব্য বায়োপিকেও অভিনয় করার কথা ছিলো তার। তবে কিছুই হলোনা। ৩৪ বছর খ্যাতি বা সাফল্য পাবার জন্য অনেক বেশি বয়স না। আর বলিউডে তো আরো কঠিন। এখানে সফলতা পাওয়ার জন্য কতোজনকে ২০/২৫ বছর স্ট্র্যাগল করতে হয় তা সবাই জানেন। সেই হিসেবে সুশান্ত খুব অল্প সময়েই পেয়েছিলেন খ্যাতি, নাম, অর্থ। তাই তার ডিপ্রেশন বা হতাশার আসল কারনটা তিনিই হয়তো ভালো বলতে পারতেন।
আগামী দিনের অন্যতম সেরা তারকা হবার জন্য নিজের দক্ষতা এবং মেধা সাথে নিয়ে এগিয়ে চলা এই অভিনেতা হিন্দি সিনেমায় স্বতন্ত্র এক জায়গায় নিয়ে যাবে নিজেকে এমনটাই ভেবেছিলেন সবাই। তবে জীবনটা সিনেমার মতো এতো সুন্দর সাজানো বা হ্যাপি এন্ডিংফুল হিসেবে সামনে আসবে এমনটা সবসময় হয়না। সুশান্তের বেলায়ও হলোনা। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার আড়ালে একটু একটু করে কখন তারা না জানা বা না বলা কষ্টগুলো নিয়ে ডিপ্রেশনে চলে যান তা তারা নিজেরাও জানেন না। ডিপ্রেশনে থেকে আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া তারকাদের লিষ্ট একেবারে ছোট্ট নয়। সেই সাদাকালো যুগের মোহনীয় মেরিলিন মনরো বা একালের সুশান্ত সিং এদের জীবন কোথায় যেনো মিল খায় বারবার। আর আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় অর্থ, খ্যাতি, সফলতা, জনপ্রিয়তা জীবনের শেষ কথা নয়।
নিজের কাছের মানুষদের সাথে আনন্দ, সুখ আর ভালোবাসা নিয়ে জীবন কাটানোই একমাত্র সত্য। বলিউড কিং শাহরুখ খানকে আইডল মেনে ক্যারিয়ার শুরু করা সুশান্ত সিং শাহরুখের সেই বিখ্যাত ডায়লগ ‘হার কার জিতনে ওয়ালে কো বাজিগর ক্যাহতে হ্যায়’ অসংখ্য বার শুনেছেন, দেখেছেন হয়তো নিজেও বলেছেন কিন্তু নিজের জীবনে সেটা করে দেখাতে পারলেন না।
সর্বশেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্ট দিয়েছিলেন গত ৩রা জুন। অল্প বয়সে হারিয়েছিলেন নিজের মাকে। সেই৷ মায়ের সঙ্গে নিজের একটা ছবি কোলাজ করে লিখেছিলেন- ‘ঝাপসা হয়ে আসা অতীত বাষ্পের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলো হাসির সঙ্গে মিলে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আর একটা ক্ষীণ হয়ে আসা জীবন, আমাদের দুই জীবনের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অস্থির।’ এখন বোঝা যায় যে, ক্যাপশনেই হয়তো আত্মহত্যার আভাস দিয়েছিলেন এই অভিমানী মানুষটা। ‘ক্ষীণ হয়ে আসা জীবনের’ কথা সুশান্তের পরিবার বা কাছের কেউ কি আঁচ করতে পেরেছিলো! এই উত্তর খোজা এখন যুক্তিহীন। তবে তার কাজ আর ক্ষণকালীন জীবনের মধ্য দিয়েই তিনি রয়ে যাবেন তার ভক্তদের হৃদয়ে অনন্তকাল।
সুত্র- ইন্ডিয়া টুডে, ফিল্মফেয়ার, পিংক ভিলা