'সিন্ডিকেট' এর গল্পটা হয়তো অনেকের চেনা মনে হতে পারে, কিন্তু, হলফ করে বলতে পারি, যে আফরান নিশোকে আপনি এখানে দেখবেন, সে পুরোপুরি অচেনা। এবং নিশোর এই দুর্দান্ত অভিনয়-বাজি দেখার জন্যে হলেও 'সিন্ডিকেট' রেকোমেন্ডেড। 

একজন মানুষ একটা বিশেষ রোগে আক্রান্ত। যে রোগের কারণে কেউ তাকে ডাকে টিউবলাইট, কেউ ভেজিটেবল। রোগটার নামও অদ্ভুত৷ অ্যাসপারগার সিনড্রোম। এই অদ্ভুত 'অ্যাসপারগার সিনড্রোম' এ আক্রান্ত মানুষটি শুধু একটা কবিতাই জানেন। সে কবিতা শুনেই তার প্রেমে পড়ে এক তরুণী৷ একই ব্যাঙ্কের কর্মচারী তারা। একদিন তারা হুট করেই সিদ্ধান্ত নেয়, বিয়ে করবে৷ পরিকল্পনা-মাফিক, মেয়েটির কথামত ছেলেটি অফিসের নীচে এসে দাঁড়ায়। একটু পরেই নামবে মেয়েটি। এরপর কাজী অফিস। সেখানেই বিয়ে। কিন্তু, আচমকাই বিপর্যয়! বিল্ডিং এর ছাদ থেকে নীচের রাস্তার গাড়ির উপর এসে আছড়ে পড়ে একজন মানুষ৷ বহুতল ভবনের ছাদ থেকে পতনে যে মানুষটি ততক্ষণে লাশ, মাংসপিণ্ড। ছেলেটি অবাক বিস্ময়ে দেখে, যে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হবার কথা, সে মেয়েটির লাশ পড়ে আছে গাড়ির উপরে৷ রক্তাক্ত। প্রাণহীন। 

গল্পের শুরু থেকেই শুরু হয়েছিলো চমক! 

সাত পর্বের সিরিজের প্রথম পর্বেই এরকম ধাক্কা খেয়ে খানিকটা নড়েচড়েই বসতে হয়। এবং, অবধারিতভাবেই বুঝতে পারা যায়, নিজের প্রেমিকার এরকম রহস্যজনক মৃত্যুর অনুসন্ধান হয়তো করবে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড সে তরুণ।  সেটা সে করা শুরু করেও। এবং, এই মৃত্যুর পেছনের জটপাকানো সুতো ধরে টান দিতেই প্রেক্ষাপটে আসতে থাকে একের পর এক মুখোশ, চরিত্র। যৌনতা, ভায়োলেন্স, অর্থ,বিত্ত, বিশ্বাস, অবিশ্বাস সব ওড়া শুরু করে গ্যাস বেলুনের মত। শুরু হয় এক চক্রের গল্প। যে চক্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ- 'সিন্ডিকেট।'

শিহাব শাহীন 'চরকি'র একেবারের শুরুর ওয়েব সিরিজটা বানিয়েছিলেন। 'মরীচিকা।' খুব প্রত্যাশা থাকলেও যে কাজটা শেষপর্যন্ত ভালো লাগেনি। মনে হচ্ছিলো, নির্মাতা শেষে এসে খানিকটা খেইও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এবং, খুব তাড়াহুড়ো করেই সবকিছু করেছিলেন শেষ। হয়তো, সে কারণেই, 'মরীচিকা'র ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে, তিনি 'সিন্ডিকেট' এর শুরুটা করলেন ঢিমেতালে। খুব আস্তে আস্তে বিল্ডাপ করলেন গল্প। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে আরেকটু ফাস্ট স্ক্রিনপ্লে আশা করেছিলাম। কিছু জায়গায়, ফাস্ট ন্যারেশনের দরকারও ছিলো। কিন্তু, ডিরেক্টর অল্প আঁচে রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ সেটাই তিনি বহাল রেখেছেন শেষতক। 

স্লো-বার্ণ স্ক্রিনপ্লে হওয়ায় গল্প মাঝের কিছু পর্বে এসে একই বৃত্তে ঈষৎ ঘুরপাক খেয়েছে। গল্পটাও মেইন ফোকাস থেকে খানিকটা ডাইভার্ট হয়ে অডিয়েন্সকে কনফিউজড করেছে। কিন্তু, সে কনফিউশন কেটেছেও আবার তাড়াতাড়ি। শিহাব শাহীন খুব তাড়াতাড়িই গল্পটাকে ফিরিয়েছেন মূলস্রোতে। শেষে এসে খানিকটা চমকও দিয়েছেন। যদিও সে চমকটা আরেকটু অন্যরকম হবে, আশা করেছিলাম। কিছু প্লটহোল পেয়েছি। তবে, যেহেতু সিরিজ সম্ভবত কন্টিনিউ হবে, আশা করছি- দ্বিতীয় সিজনে এই গর্তগুলো ভরাট হবে।

অসঙ্গতি বলতে এটুকুই। আর, মুগ্ধতা যতটুকু, তার সিংহভাগই আরফান নিশোর। মাত্র দুইদিন আগেই হইচই'তে আসা ওয়েব সিরিজ 'কাইজার' দেখলাম। সেখানে কাঁচাপাকা চুলের রগচটা এক গোয়েন্দা অফিসার চরিত্রে তার অভিনয়-জনিত মুগ্ধতা এখনো কাটেনি, এরমধ্যেই এই রোল! 'অ্যাসপারগার সিনড্রোম' যেটা কিনা একটা মাইল্ড অটিজম, সে রোগে আক্রান্ত একজন মানুষ, থেমে থেমে কথা, ইতস্তত চলাফেরা আর চোখের চাহনিতে নিশ্চিত বিভ্রান্তি... 'কাইজার' এর সেই বোল্ড আফরান নিশো আর 'সিন্ডিকেট' এর ডাল আফরান নিশো যে একই মানুষ... সেটা বুঝতে বেশ বেগ পেলাম। সাথে, চরিত্রের মাত্রাজ্ঞান বুঝে যে অভিনয়! মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায়ও বা রইলো কই? কেন তিনি এ সময়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক অভিনেতা, সেটার প্রমাণ তিনি যেন নিজেই দিলেন আবার! 

আরফান নিশো মুগ্ধ করলেন আরেকবার! 

নাজিফা তুষি'র রোলটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং। সে চ্যালেঞ্জের বার্ডেনগুলো তিনি ক্যারিও করলেন ভালোভাবে। ইনার কনফ্লিক্ট, মেন্টাল আনস্টেবিলিটি বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুললেন চোখেমুখে। সাধারণত এরকম চরিত্রে তাকে দেখেছি কম। সে কারণেই অবাক হলাম অভিনয়ের সৌকর্যে। এদিকে, তাসনিয়া ফারিণ খানিকটা আশাহত করলেন, করলেন গড়পড়তা অভিনয়। তবে, ক্যারেক্টারটাই যেহেতু ফ্ল্যাট, করার কিছু ছিলোও না। নাসিরুদ্দিন খানের অভিনয় ভালো লাগলো। তিনি বরাবরের মতই তারাবাজির প্যাকেট। আলো-ঝলমলে। রাশেদ মামুন অপুও দারুণ।  বাকিরাও জায়গা বুঝে ঠিকঠাক। যদিও একটা নেগেটিভ পয়েন্ট আছে। শতাব্দী ওয়াদুদ'কে ঠিকঠাক ইউটিলাইজ না করার পয়েন্ট। তবে, এটুকু বাদে সবার অভিনয় দারুণ।

অনবদ্য নাজিফা তুষি

'সিন্ডিকেট' এ শিহাব শাহীন যে বিষয়টা নিয়ে ডিল করেছেন, সেটাকে ভালোভাবে স্টাবলিশ করতে গেলে স্ক্রিপ্টটা আরেকটু ডিটেইলড আর টেকনিক্যাল হওয়া দরকার ছিলো, সেটি হয়নি। 'স্ক্রিনপ্লে' ডিমান্ড করছিলো আরেকটু স্পিডি হওয়া, সেটাও হয়নি। গল্পের সাসপেন্স ধরে রাখতে গিয়ে কিছু জায়গা খানিকটা হোঁচটও খেয়েছে। তবে, সেসব যদি বাদও দিই, শুধুমাত্র নতুন এক কনসেপ্ট নিয়ে ভাবনা ও আফরান নিশোর এরকম শো-স্টিলার অভিনয়ের জন্যে হলেও 'সিন্ডিকেট' দেখা উচিত।  'সিন্ডিকেট' এর গল্পটা হয়তো অনেকের চেনা মনে হতে পারে, কিন্তু, হলফ করে বলতে পারি, যে আফরান নিশোকে আপনি দেখবেন, সে পুরোপুরি অচেনা। এবং নিশোর এই দুর্দান্ত অভিনয়-বাজি দেখার জন্যে হলেও 'সিন্ডিকেট' রেকোমেন্ডেড। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা