টান অভিনয় দক্ষতায়, গানে আর টুইস্টে বেশ উপভোগ্য কাজ। ‘টান’ নামটাকেও যেভাবে জাস্টিফাই করা হয়েছে গল্পে সেটাও ব্রাউনি পয়েন্টস পাবার মতো। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু নতুন নতুন কাজ দেখার সুযোগ পাচ্ছি আমরা নিজেদের দেশের, এটা খুশি হবার মতো ব্যাপার...

রায়হান রাফি প্লট টুইস্ট নির্ভর পরিচালক। তার প্রতিটি সিনেমায় জনরা ডিফাইনিং কিছু থাকে না। অনেকেই তাকে থ্রিলার ডিরেক্টর বললেও তিনি মূলত রোম্যান্টিক জনরাপ্রধান সিনেমাই বেশি করেছেন। প্লটটুইস্টের অংশটুকুকে চাইলে কেবল থ্রিলার জনরায় ফেলা যায়। রায়হান রাফির নতুন নির্মাণ টান নিয়ে তাই এক্সপেকটেশন ছিল রোম্যান্টিক ড্রামা সাথে একটা ছোটখাটো প্লট টুইস্ট। পাশাপাশি নামের সাথে সিনেমার গল্পের কোন জায়গাটায় মিল সেটাও একটা প্রশ্ন ছিল। এসব প্রশ্ন নিয়েই শুরু করেছিলাম টান দেখা। তো, কেমন হল টান?

টান ১০৫ মিনিটের একটি ওয়েব ফিল্ম। বাংলাদেশ যে আড়াই ঘণ্টার বাঁধা ধরা সিনেমার টাইমলুপ থেকে বের হতে পারছে এটা একটা আশার খবর। কিন্তু সিনেমার লেন্থ কমলে যদি গল্প অপূর্ণ থাকে, ক্যারেক্টার রাউন্ড না হয় তাহলে আদতে লেন্থ কমানোর লাভ নেই। টানে পজেটিভ-নেগেটিভ দুটোই হয়েছে। কিছু ক্যারেক্টার অল্প সময়েই রাউন্ড আর্ক পেয়েছে আবার কিছু ক্যারেক্টার প্রচুর স্ক্রিনটাইম সত্ত্বেও স্ট্যাবলিশ হতে পারে নি।

টানের গল্পটা অবনী আর রাশেদকে ঘিরে। রাশেদ ড্রাগ এডিক্ট, সিগারেটের সুখটানই যার একমাত্র নেশা। কিন্তু একইসাথে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে অবনীকে। কিন্তু তার দায়িত্বহীনতার কারণে চাইলেও অবনীকে কাছে টানতে পারে না সে। অন্যদিকে অবনী দায়িত্ব-কর্তব্যের যাঁতাকলে পিষ্ট এক নারী। বোন-দুলাভাই এর বাসায় অপাংক্তেয় অতিথি হয়ে যাকে কাটাতে হয় একেকটি দিন। আর্থিক ও মানসিক টানাপোড়েনের এই জীবনে অবনী শেষমেশ অমোঘ অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে বাসা বাঁধে রাশেদের সাথে। সুখের দিনগুলো শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়, রাশেদ আর অবনীর জীবনে অনিশ্চয়তার কালো মেঘের সাথে প্রতিশোধের কালবৈশাখীও আড়াল থেকে উঁকি মারতে থাকে। একটা দুর্ঘটনা সামনে নিয়ে আসে অতীতের এক কালো অধ্যায়কে।

টানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি 'অভিনেত্রী বুবলী'

টানের স্ক্রিপ্ট একদম সরলরৈখিক। সাদামাটা এক গল্প। কিন্তু উপস্থাপনের দিক থেকে বৈচিত্র্য এনে রায়হান রাফি চেয়েছেন গল্পে টেনশন ক্রিয়েট করে রাখতে। বারবার তাই ন্যারেশন ফরওয়ার্ড-ব্যাকওয়ার্ড গিয়েছে। সমস্যা হল এতে করে কেবল অতীতের গল্পই স্ট্যাবলিশ হয়েছে, বর্তমানের টেনশন স্ট্যাবলিশ হয় নি। গল্পের বাঁক নেয়া শুরু হয়েছে একদম শেষে গিয়ে, খুব দ্রুতই পরিণতি টানা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অবনী চরিত্রটি দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। বুবলী যে এতো ভালো অভিনয় জানেন সেটা ভাবতেই পারি নি। নন গ্ল্যামারাস রোলে বুবলী যেন পাশের বাড়ির অবনীই হয়ে উঠেছিলেন। যে মেয়েটিকে আমরা প্রতিদিন বাসে আসতে যেতে দেখি, কাপড়ের দোকানে কামিজের সাথে ওড়না মিলিয়ে ক্রেতাকে প্রবোধ দিতে দেখি, এলাকার দোকান থেকে দোকানদারের সাথে সুখ-দুঃখের গল্প বলে বাকি আনতে দেখি। বুবলী তার জন্য লেখা অবনী ক্যারেক্টারে নিজেকে একদম সঁপে দিয়েছেন যেন।

অন্যদিকে সিয়ামের রাশেদ চরিত্র অনেকটাই দহনের তুলার মতো। মোরাল গ্রাউন্ড নিয়ে যাকে নিজের সাথে লড়তে হয়, নেশা কাটানোর জন্য যার প্রিয় মানুষের সঙ্গ লাগে। রাশেদের ডেসপারেটনেস সিয়াম ঠিকই তুলে ধরতে পেরেছেন কিন্তু তার চরিত্রে তেমন কোন বাঁক নেই। সত্তার দহনে শেষমেশ যখন উপলব্ধি হল, ডেলিভারির কাজ শুরু করলো রাশেদ সেখানেও কিছুটা ড্রামা দরকার ছিল বলে মনে হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমার হিরোর ‘গুডি টু শুজ’ হবার যে স্টেরিওটাইপ সেটা সিয়াম বারবার ভাঙছেন এটা আশার খবর।

দারুণ অভিনয় করছেন সোহেল মন্ডল

সোহেল মণ্ডলকে যেকোনো কন্টেন্টে দেখা মানে এখন তার ক্যারেক্টারে কিছু না কিছু স্পেশাল আছে এটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। এই ওয়েব ফিল্মে তার উপস্থিতি তাই আগ্রহ জাগানিয়া ছিল। ভালো অভিনেতার মূলত একটা সিন লাগে নিজের জাত চেনানোর জন্য, সোহেল এখানে দু-তিনটা সিনই এমন পেয়েছেন। যদিও গল্পে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে একটু বেশিই তাড়াহুড়ো মনে হয়েছে তবে তার স্ক্রিন টাইম নিয়ে কোন অভিযোগ নেই কারণ সেটুকুতেই তিনি গল্পের পরিণতি ভালোভাবে টানতে পেরেছেন। ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে সোহেল মণ্ডলের হাসি অনেকদিন মনে রাখার মতো।

টান অভিনয় দক্ষতায়, গানে আর টুইস্টে বেশ উপভোগ্য কাজ। ‘টান’ নামটাকেও যেভাবে জাস্টিফাই করা হয়েছে গল্পে সেটাও ব্রাউনি পয়েন্টস পাবার মতো। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু নতুন নতুন কাজ দেখার সুযোগ পাচ্ছি আমরা নিজেদের দেশের, এটা খুশি হবার মতো ব্যাপার। আস্তে আস্তে কোয়ালিটি কন্টেন্টের আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে করতে ঠিকই একদিন হ্যাঁচকা টানে বুলস আই করে ফেলবো, এমনটাই আশা করি। টান অবশ্যই বুলস আই না, তবে গুলি বাইরে দিয়েও যায় নি।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা