
কিছু সিনেমা হাসায়, কিছু সিনেমা কাঁদায়, কিছু আবার বিরক্তি উপহার দেয়। খুব অল্প সিনেমা থাকে, যেগুলো বুকের গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয়, ভাবতে বাধ্য করে, জীবনে প্রভাব ফেলে। তামাশা ঠিক সেরকমই একটা সিনেমা...
সিনেমার দুটো প্রকারভেদ- খারাপ সিনেমা, আর ভালো সিনেমা। 'তামশা' তাহলে দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পড়ে নিঃসন্দেহে। অনেকেরই ধারণা, সিনেমা দুই ধরণের হয়, যেটা আমজনতা দেখে, আর যেটা দেখে বুদ্ধিজীবি আঁতেল দর্শকেরা তালি বাজায়। সেখানে 'তামাশা' দ্বিতীয় ধারায় পড়ে। সিনেমার দুটো ধাপ আছে, একটা তুমুল ব্যবসা করে, অন্যটা মন জেতে, পুরস্কার জেতে। সেভাবে ভাগ করলে 'তামাশা' অবশ্যই দ্বিতীয় গ্রুপে যাবে।
আমার চোখে সিনেমা হয় দুই রকম, একটা আপনি দেখলেন, আনন্দ পেলেন, বা পেলেন না, তারপর ভুলে গেলেন। অন্যটা আপনাকে ধাক্কা দিলো ভালোভাবে। সেই সিনেমা দেখে আপনি আনন্দ পেতে পারেন, কষ্টও পেতে পারেন, বেদনার একটা চোরাস্রোত বুকের ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠতে পারে, সেই সিনেমাটাকে আপনি ভুলতে পারবেন না, সেগুলো প্রথম প্রেমের মতোই অবিনাশী স্মৃতি নিয়ে হাজির হবে বারবার। বিভিন্ন ঘটনায়, বিভিন্ন সময়ে, কারণে বা অকারণে আপনার মনে পড়বে সেই সিনেমার কথা, বিশেষ কোন দৃশ্য বা সংলাপের কথা। হ্যাঁ, তামাশা ঠিক সেরকম একটা সিনেমা।
ইট ওয়াজ নট এবাউট দ্য স্টারকাস্ট, নট এবাউট কর্সিকা, নট ফর দ্য মিউজিক অফ এ আর রেহমান। ইটস অল এবাউট দ্য স্টোরি, অল অ্যাবাউট দ্য বিল্ড আপ, দ্য স্ক্রিনপ্লে... যে জিনিসগুলো বছর কুড়ির এক তরুণের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ছয়র বছর আগে। হলপ্রিন্টের ঘোলাটে পর্দায় দেখা একটা সিনেমা, সংলাপগুলো বুঝতেও কষ্ট হয়- সিনেমার টেকনিক্যাল দিক নিয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকা এক তরুণ হঠাৎ করেই যেন জগদীশ চন্দ্র বসু হয়ে গেল।

বসুবাবু আবিস্কার করেছিলেন, গাছের প্রাণ আছে। ছেলেটা আবিস্কার করলো, মানুষ বা গাছই নয় শুধু, সিনেমারও আসলে প্রাণ আছে! সিনেমা কথা বলতে পারে, মৃতপ্রায় আত্মাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, পারে স্মৃতির কুঠুরিতে বন্দী থাকা কিছু অব্যক্ত অনুভূতির গায়ে হাতুড়ির আঘাত দিয়ে তার ঘুম ভাঙাতে, পারে হৃদয়ের বন্দীশালার তালা ভেঙে লুকিয়ে রাখা মনের ভাবগুলো বের করে আনতে। সব সিনেমা সেটা পারে না, হাতেগোনা কয়েকটাই পারে এমন অসাধ্য সাধন করতে। তামাশা ঠিক তেমনই একটা সিনেমা।
কর্সিকা থেকে শুরু, সেখান থেকে দিল্লি। ছোট শহরের এক তরুণ বেদ, কিংবা ডন; আর তার সঙ্গী তারা- বিপরীতমুখী চরিত্রের দুটো মানুষ, সময়ের প্রয়োজনে যারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। জীবনের চিরাচরিত শাশ্বত একটা রূপ। ওদের চরিত্রের ওপর কোন আরোপিত মুখোশ নেই, ওরা যেভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে, ঠিক সেভাবেই কয়েকটা দিন কেটেছে কর্সিকায়। 'লাইফ ইফ বিউটিফুল' থিমটার সাথে কি দুর্দান্তভাবেই না মিলে যায় ব্যাপারটা! ঘন্টা বেজে ওঠে তারপর, বিদায় নিতে হয়, আরোপিত মুখোশটা চড়িয়ে নেয়া লাগে চেহারার ওপর। তারপর মানুষটা বদলে যায়, বদলে যায় সময়, পারিপার্শ্বিকতা।
জীবনে প্রচুর সিনেমা দেখেছি- এমন দাবী করা সম্ভব নয়। যেটুকুই দেখেছি, তার মধ্যে মন থেকে যে চরিত্রের মতো হবার বাসনা জেগেছে- সেটা অবশ্যই বেদ। আড়াই ঘন্টার ওই জার্নিটাতে আমার সামনে মোবাইলের পর্দায় বেদ ছিল না, রনবীর কাপুর ছিলেন না, ছিলাম আমি নিজে। আর কোন চরিত্রের সাথে এত বেশি কানেক্ট করা সম্ভব হয়নি কখনও। সমাজ-সংসারের দাবী মেনে একটা মিথ্যে জীবন কাটানো মানুষ, এটা তো আমিই!

ম্যাথ জিনিসটা আমিও বুঝি না, পড়ালেখা আমারও ভালো লাগে না, ভালো লাগে অন্যকিছু, যেটাকে সমাজ 'অর্থহীন' ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। কোন কিছু না বুঝেই শুধু প্রিয় কিছু মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে অজানা একটা রেসে শামিল হয়েছি আমিও, যেটার গন্তব্য জানা নেই একদমই। এই রেসে জিতলে কি হবে সেটাও জানি না, শুধু জানি, দৌড়াতে হবে, পেছন থেকে চিৎকার করে আদেশ দেয়া হচ্ছে শুধু। আজন্ম মিডিওকার হয়ে থাকা আমি জানিই না, বুকের ভেতরে প্রতিভার কোন আগ্নেয়গিরিটা লুকিয়ে আছে আমার, সেটা খুঁড়ে দেখার কথা মাথাতেই আসেনি কখনও। কিংবা আমার চারপাশ সেসবের কথা জানায়নি আমাকে! তারা বলেছে ভার্সিটির ভালো ডিগ্রির কথা, নয়টা-পাঁচটার চাকরির কথা, আর্থিক নিশ্চয়তার কথা। জীবনের আনন্দের কথাগুলোই শুধু শোনা হয়নি কখনও।
তামাশা এমনই একটা সিনেমা, যেটা মুক্তির ছয় বছর পরেও প্রতিটা দিনই কোথাও না কোথাও সেই সিনেমার সংলাপ চোখে পড়ে। ফেসবুক হোক কিংবা ইনস্টাগ্রাম, কেউ না কেউ প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় তামাশার কথা স্মরণ করেই। বক্স অফিসে ফ্লপ হওয়া একটা সিনেমা মানুষের কতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে, কতটা আপন হয়ে উঠতে পেরেছে, সেটা পরিমাপ করার মতো কোন নিক্তি আবিস্কার হয়নি। কিংবা অলকা ইয়াগনিকের সেই জাদুকরী কণ্ঠস্বরে 'আগার তুম সাথ হো'- ফেসবুকে বোধ হয় এমন মানুষ খুব কম আছে যারা কিনা গত ছয় বছরে এই গানটা অন্তত একবার শেয়ার করেনি!
থ্যাংকস বেদ, তারা এবং ইমতিয়াজ আলী। না, বেদের মতো সিনেম্যাটিক ওয়েতে আমি হাঁটতে পারিনি, গল্পের ছলে কখনও বলা হয়নি স্বপ্নের কথাগুলো। তবে স্বপ্নের রাস্তা ছাড়িনি, সেই সাহসটা তৈরি করে দিয়েছিলেন আপনারা। এখনও যখন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়, হতাশা ঘিরে ধরে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেদের নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- 'মজা হচ্ছে খুব, তাই না?' তারপর আনমনেই হেসে উঠি, নিজেকে জবাব দেই- 'হ্যাঁ, সেটা তো হচ্ছেই...' যাপিত জীবনের না বলতে পারা কষ্টগুলোকে মজায় রূপান্তরিত করার শিক্ষা দেয়ার জন্যেও তামাশাকে ধন্যবাদ...