খাগড়াছড়ির ঝিরিপথে ট্রেকিং, কলাপাতায় বাঁশ কোড়ল-সাদা ভাত, নদীর বুকে জেলের জালে খলবলিয়ে আটকে পড়া মাছ, অজ্ঞাতকুলশীল  মানুষের কাছ থেকে খাবারের নেমন্তন্ন, সর্ষের তেলে ভাজা ইলিশ আর গরম ভাত, শীতের পিঠাপুলি... সবই এলো ক্ষণে ক্ষণে। হঠাৎই সিলেটের চা-বাগান। পড়ন্ত বিকেল। হাতে চায়ের কাপ। সিলেট থেকে ঢাকা। পুরান ঢাকা। কাঁঠাল-পাতায় তেহারি। নোনতা-মিষ্টি বাকরখানি। ঘোল। চটপটি। ফুচকা। আগুন পান...

কয়দিন আগে এক ফুড ফেস্টিভালে গিয়েছিলাম। শীতের সন্ধ্যা। ঠাসাঠাসি মানুষ। গুনগুন। হট্টগোল। গরম গরম খাবারের ধোঁয়া। থালাবাটির টুংটাং। জমজমাট সব। খাবারের স্টলে স্টলে ঘুরছি। কিন্তু যতই স্টল দেখছি, ততই বিমর্ষ হচ্ছি। বিমর্ষ হবার কারণও আছে। প্রায় সব দোকানেই পাস্তা,নুডুলস, ফ্রাইড রাইস, স্টেক, সুশি, পিৎজা। এমন একটা দোকান নেই যেখানে সাদা ভাত-ডাল-ভর্তা, ভাপা-পাটিসাপটা, অথবা, চালের রুটি- হাঁসের মাংস আছে। অদ্ভুত এক প্রহসন মনে হলো যেন। নিজের দেশের এত বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভার থাকা সত্বেও যদি অন্য দেশের খাবারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়, ময়ূর হয়ে কাকের বেশ ধারণ করতে হয়, তাহলে তা বিস্তর হতাশাজনক এক বিষয়। সেদিন বেশ হতোদ্যমই হয়ে গিয়েছিলাম স্টলগুলোর দৈন্যদশা দেখে। আর মস্তিষ্কে ঘুরছিলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'বঙ্গভাষা' কবিতার সেই লাইন- 

কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন! 

গুণী সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বেশ ভোজনরসিক মানুষ ছিলেন। দেশ-বিদেশের খানাখাদ্য নিয়ে তার আগ্রহও ছিলো উল্লেখ করার মতন। সেই মানুষটিও তার একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছেন, সরু চালের ধোঁয়া-ওঠা ভাতের সাথে মাখিয়ে দেশী মাছের ঝোল খাওয়ার যে সুখ, তা আর কোনো খাবারে পাওয়া যায় না। এ সত্যিটা বুঝেছিলাম প্রথমবার বিদেশে যাওয়ার পর। এত এত খাবার চারপাশে, অথচ কোনো কিছুই মুখে রুচছিলো না। একরকম অনাহারে প্রবাসের ক'টা দিন কাটিয়ে এরপর যখন দেশে ফিরেছি, মুজতবা আলীর বর্ণনার মতন, কাকতালীয়ভাবে ধোঁয়া-ওঠা ভাতের থালা আর মাছের ঝোল পেয়েছি সামনে, তখনকার যে অনুভূতি, তা বলে বোঝানোর মত না৷ 

বৈচিত্র্যময় সব খাবার নিয়ে আমাদের যে মাতামাতি আর খাবার যেভাবে হয়ে ওঠে আমাদের আনন্দ-উৎসবের অংশ, এখনকার  প্রজন্ম তার হয়তো অনেকটুকুই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু একটু আগের প্রজন্মের মানুষদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে, বাংলা খাবারের তাৎপর্য- মহিমার সাত-সতেরো। তাছাড়া স্থানভেদে যেভাবে এদেশে পালটে যায় খাবারের স্বাদ, মান, ঘ্রাণ...সেটাও বা আর কে পাবে কোথায়? এদেশের মায়েরা যৎকিঞ্চিত উপকরণ দিয়েও যেসব অমৃত তৈরী করেন নিরন্তর, সেটাও বা আর আছে কোন দেশে?

বাংলা খাবার নিয়ে বাঙালির আবহমান এই নষ্টালজিয়াকে উপজীব্য করে বানানো এক বিজ্ঞাপন দেখলাম সম্প্রতি। গুণী নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী 'স্কয়ার গ্রুপ' এর জন্যে 'আমার বাংলাদেশ' শিরোনামের দুটি বিজ্ঞাপন করেছেন। যার একটিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের খাদ্যবৈচিত্র‍্যের অদ্ভুত সুন্দর এক আলেখ্য। যদিও 'রাঁধুনি' ব্রাণ্ডের জন্যে করা হয়েছে এ বিজ্ঞাপন, কিন্তু এ বিজ্ঞাপনের মূখ্য ভূমিকায় রয়েছে বাংলার রূপ ও খাদ্যবৈচিত্র‍্যের মেলবন্ধনটাই। যে মেলবন্ধন এতটাই অনবদ্য, বিজ্ঞাপনের পুরো সময়ে স্থানু হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় সেদিকে। চোখ সরানো যায় না লেশমাত্র।  

বিজ্ঞাপনের শুরুতেই যেমন আমরা দেখি, বাঙালি এক তরুণী, প্রবাসী মেয়ে লরাকে নিয়ে ঘুরছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। খাগড়াছড়ির ঝিরিপথে ট্রেকিং, কলাপাতায় বাঁশ কোড়ল-সাদা ভাত, নদীর বুকে জেলের জালে খলবলিয়ে আটকে পড়া মাছ, অজ্ঞাতকুলশীল  মানুষের কাছ থেকে খাবারের নেমন্তন্ন, সর্ষের তেলে ভাজা ইলিশ আর গরম ভাত, শীতের পিঠাপুলি... সবই এলো ক্ষণে ক্ষণে। এরপর সিলেটের চা-বাগান। পড়ন্ত বিকেল। হাতে চায়ের কাপ। সিলেট থেকে ঢাকা। পুরান ঢাকা। কাঁঠাল-পাতায় তেহারি। নোনতা-মিষ্টি বাকরখানি। ঘোল। চটপটি। ফুচকা। আগুন পান। 

বাকরখানি! 

এ বিজ্ঞাপনের পুরোটাজুড়েই রঙ আর রঙিন খাবারের স্নিগ্ধ ছড়াছড়ি চোখের শান্তি দেবে যে কাউকেই৷ তাছাড়া অজ্ঞাত কোনো একজন মানুষ একবারের পরিচয়েই কাউকে বাড়িতে নিয়ে এসে যে তরিবত করে খাওয়াতে পারে, এরকম দৃশ্যকল্প এনে নির্মাতা বাঙালির আতিথেয়তার বিষয়টিকেও যেভাবে সূক্ষ্ম ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে যান এই নির্মাণে, সেটিও অনবদ্য। তাছাড়া সিনেম্যাটোগ্রাফী এবং আবহসংগীতের চমৎকারিত্বও এই নির্মাণকে আলাদা, স্বকীয় দ্যোতনাই দিয়ে যায় যেন। 

শীতের পিঠাপুলি! 

তবে এই বিজ্ঞাপনে মুগ্ধতার পাশাপাশি খানিকটা আক্ষেপ আছে। চাইলে আরো দুয়েক জায়গার খাবার দেখানো যেতো, খুলনা-চট্টগ্রাম-বরিশালের যে বিশাল খাদ্য-বৈচিত্র‍্য, সেটা নিয়েও খানিকটা ক্যামেরার খসখস হতে পারতো, কিংবা দেশীয় ভর্তা-ঝোলের যে মাহাত্ম্য, এটাও বিজ্ঞাপনের কোথাও এলে ভালো লাগতো। অবশ্য এটাও মাথায় রাখা উচিত, এটা বিজ্ঞাপন। বিন্দুতেই ধারণ করতে হবে সিন্ধু। চোখের তারায় আনতে হবে আকাশ। তাই আক্ষেপ থাকলেও এই বিষয়টিকে সমালোচনা হিসেবে ধরতে পারছি না। 

ফারুকী এমনিতেও নির্মাতা হিসেবে দুর্দান্ত। কিন্তু 'স্কয়ার গ্রুপ' এর জন্যে তার এই দুই বিজ্ঞাপন যেন কোথাও গিয়ে ছাপিয়ে যায় গড়পড়তা বিশেষণের সমস্ত গণ্ডি।  বাংলাদেশের রূপ ও খাদ্যবৈচিত্র‍্যের এই মোলায়েম উপস্থাপন দেখে ভুলতে বসা বাংলাদেশকেই তাই মনে পড়ে ক্রমশ। এই দুই বিজ্ঞাপন হয়ে থাকে পশলাখানেক বিশুদ্ধ বাতাস। এমন বাতাস, যে বাতাসে স্বস্তি পাওয়া যায়। যাপিত সব ক্লেদাক্ত পরিস্থিতিতে যখনই নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়, ক্রমশই বিষিয়ে ওঠে সব...তখন যে বাতাসে নাক ডুবিয়ে ধাতস্থ হওয়া যায়। এজন্যেই তাই প্রত্যাশা বাড়ে, বিজ্ঞাপনের মোড়কে দারুণ গল্প বলার এরকম অজস্র নির্মাণের। ক্যামেরার চোখ যেভাবে এই নির্মাণে হয়ে উঠেছে ক্যানভাসের তুলির আঁচড়, সেরকম হোক নিয়মিত! এটাই কায়মনোবাক্যে প্রত্যাশা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা