কেন এত জনপ্রিয়তা পেলো 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস?'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ক্রিটিকদের ইতিবাচক প্রশংসা, মোদি এবং বিজেপির পাবলিসিটি, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ায় এই ইস্যু নিয়ে নিয়মিত সরগরম থাকা, সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে ওয়েল মেড ফিল্ম- সবগুলো ফ্যাক্টর এমনভাবে একত্রে কাজ করেছে এ সিনেমায়, যা এর আগে আর কোনো সিনেমার ক্ষেত্রে হয়নি কখনোই। এবং সামনেও হবে বলে মনে হয় না। এবং ঠিক এটাই 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'কে পৌঁছে দিয়েছে ঈর্ষণীয় এক অবস্থানে, যে অবস্থানে পৌঁছাতে গেলে এমন কিছু উপাদানের একসাথে থাকার প্রয়োজন হয়, যা হয়তো 'ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম' ই ঘটে!
পনেরো কোটি রূপি বাজেটে বানানো কোনো সিনেমা সর্বোচ্চ কত ব্যবসা করতে পারে বক্স অফিসে? ত্রিশ কোটি? চল্লিশ কোটি? আচ্ছা, নাহয় ধরলাম একশো কোটি! এর বেশি ভাবনা না যাওয়াটাই সমীচীন। কিন্তু যদি এমন হয়, পনেরো কোটির সিনেমা বক্স অফিস থেকে আয় করলো দুইশো কোটি রূপির অবিশ্বাস্য এক সংখ্যা, তাও মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে, কেমন লাগবে শুনতে? রূপকথা মনে হবে? কিংবা, আকাশকুসুম কল্পনা?
যদি এসব মনে হয়, তাহলে আপনার জন্যে পরামর্শ, চোখ রাখুন 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' সিনেমায়। যে সিনেমা পনেরো কোটিতে নির্মিত হয়ে চৌদ্দ দিনের মধ্যেই ঢুকে গিয়েছে দুইশো কোটির ক্লাবে। যে সিনেমা নিয়ে বিগত মাসখানেক ধরেই হচ্ছে বচসা, তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা। এবং যে আলোচনায় আখেরে লাভ হচ্ছে সিনেমাটিরই। খণ্ড খণ্ড বাদানুবাদের সুবাদে খুব ভালোভাবেই আলোচনার টেবিল দখল করে রেখেছে এ নির্মাণ। কিন্তু, তবুও, যতই আলোচনা হোক, যে সিনেমা মুক্তির প্রথম দিনে আয় করে সাকুল্যে সাড়ে তিন কোটি রূপি, সে সিনেমা সপ্তাহান্তে গিয়ে কিভাবে টক্কর দেয়া শুরু করে দ্য গ্রেট 'বাহুবলি'র গ্রস ইনকামের সাথে? কি আছে এ সিনেমায়? গিমিক? ভোজবাজি? নাকি, অন্যকিছু?
বিবেক অগ্নিহোত্রীর আগের সিনেমা 'দ্য তাশখন্দ ফাইলস' বক্স অফিসে আয় করেছিলো মাত্র বিশ কোটি রূপি। সে হিসেবে, 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' নিয়ে কারোরই খুব একটা উচ্চাশা যে ছিলো না, তা বলাই বাহুল্য। যদিও সিনেমা মুক্তির আগে 'কপিল শর্মা শো'তে আমন্ত্রণ পাওয়া, না-পাওয়া জনিত বিতর্ক উসকে পরিস্থিতি খানিকটা ঘোলাটে করার চেষ্টা করেছিলেন খোদ নির্মাতাই। তবে তা স্থায়ী হয়নি। বিশেষ কোনো গুরুত্বও পায়নি। এবং এই নির্বিষ বিতর্কের পরবর্তীতে বক্স অফিসের প্রথম দিন যখন মাত্র সাড়ে তিন কোটি আয় করে সিনেমাটি, সবাই ধরেই নিয়েছিলো, অগ্নিহোত্রীর আগের সিনেমার মতই দশা হবে এ সিনেমারও। কিন্তু সে সিনেমাই যে সপ্তাহান্তে গিয়ে আয় করবে ৯৭ কোটি রূপি, তা কেউ ভেবেছিলো! আবার দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে এ সিনেমা যে টপকে যাবে প্রথম সপ্তাহের আয়কেও, করবে ১১০ কোটি রূপির ব্যবসা, সেটাও বা কার দূরতম কল্পনাতে এসেছিলো! এবং ঠিক এভাবেই, ইতিহাস গড়ে সবাইকে যারপরনাই চমকে দিয়েছে এ নির্মাণ। বলিউডের এত বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' হয়ে গিয়েছে 'টক অব দ্য কান্ট্রি'ও।
এটা ঠিক, এ সিনেমা নিয়ে প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত হয়েছে সব বোদ্ধামহলে। যদিও বোদ্ধাদের রুচি আর সাধারণ মানুষদের রুচি যে একস্রোতে প্রবাহিত হয় কদাচিৎ, তাও আমাদের জানা। তাছাড়া ক্রিটিকদের 'ভালো মন্তব্য' একটা সিনেমাকে হয়তো খানিকটা বুস্টআপ করতে পারে। কিন্তু তাদের কথামৃত রাতারাতি ভোজবাজির মত খোলনলচে পালটে দেবে সব, এও কি হতে পারে? অবশ্য, সিনেমা মুক্তির পরেই 'ফিল্ম ক্রিটিক'রা যেভাবে সমস্বরে সিনেমাটির গা চাপড়ে দিয়েছেন, তা যে খানিকটা হলেও 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'কে সমর্থন দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই মোটেও। মূলত, ক্রিটিকদের কথাবার্তার জেরেই হল মালিকেরা বক্স অফিসে এ সিনেমার 'ওপেনিং ডে'র কালেকশন দেখেই বীতশ্রদ্ধ হন নি। তারা বরং খানিকটা সুযোগই দিয়েছে সিনেমাটিকে! এবং যত সময় গড়িয়েছে সেই সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছে এ সিনেমা। এবং এটুকু সাপেক্ষে, ক্রিটিকদের অবদান অস্বীকার করারও উপায় নেই মোটেও।
যদিও অতীত ইতিহাস আমাদের বলে- পিঙ্ক, নীরজা কিংবা কুইন- এই সিনেমাগুলোও ক্রিটিকদের 'পজিটিভ রিভিউ'র জোরেই জোরদার ব্যবসা করেছিলো বক্স অফিসে। কিন্তু এ কথাও জেনে রাখা ভালো, এ সিনেমাগুলোর মধ্যে একটিও পায়নি 'একশো কোটি'র ক্লাবে ঢোকার সুযোগ। অথচ, 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' সেটাই করেছে অবলীলায়। শুধু তাই না, আদায় করেছে সরকারের সমর্থনও। 'টোল ফ্রি' সিনেমা হয়েছে। পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে বিশেষ শুভেচ্ছাবার্তাও। কিভাবে সম্ভব হলো এসব? বলছি। সেসবের জন্যেই ক্রমশ এখন ঢুকছি মূল আলোচনায়।
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' যারা দেখেছেন তারা অবলীলায় স্বীকার করবেন, এই সিনেমায় জাতীয়তাবোধ এবং দেশপ্রেমকে ঠিক সেভাবেই দেখানো হয়েছে, যেভাবে দেখতে চায় মানুষ। নির্মাতার নিউট্রালিটি, সিনেমা বানানোর পলিটিক্যাল এবং সোশ্যাল ন্যারেটিভ নিয়ে নানা কথাবার্তাই হতে পারে, কিন্তু, সিনেমার মেকিং এর যে চমৎকারিত্ব, সেখানে হয়নি একবিন্দুও খামতি। সবচেয়ে বড় কথা, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বেদনাকে এর আগে এভাবে সেলুলয়েডে দেখা যায়নি কখনও। মানুষ স্বভাবতই পছন্দ করেছে। এবং এরকম 'ওয়েল ক্রাফটেড' সিনেমা নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে আলাদা করে কথা বলেছেন, সেটাও হয়েছে আরেক বিস্ময়। শক্তপোক্ত এক স্রোতই যেন পেয়েছে এই বিশেষ সিনেমা। যদিও, প্রসঙ্গত জানাই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এর আগেও 'বিশেষ' কিছু সিনেমা নিয়ে প্রশংসার ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন বিস্তর, এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেসব সিনেমা জনপ্রিয়তার বদলে হয়েছিলো তীব্র বিতর্কিতও! তবে এটাও ঠিক, পার্লামেন্টে এই সিনেমা নিয়ে সরকারী ও বিরোধী পক্ষের বাদানুবাদে সিনেমাটি যে বিশেষ এক জাতীয় গুরুত্ব পেয়েছে, তা মূলত খুব কম সিনেমার ভাগ্যেই ঘটে!
তবে এটাও শেষ কথা না। এই ঘটনা, অর্থাৎ, মোদির বিশেষ প্রচারণার পরে সিনেমাটি দেখার আহ্বান যখন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের সর্বত্র, ডালপালায়, শাখাপ্রশাখায়, সেটিও আলাদা এক প্রণোদনা দেয় এ সিনেমাকে। সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ - ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেলিগ্রাম... যেভাবেই হোক, সমাজের নানা স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় বিশেষ এক বার্তা। যে বার্তার সারমর্ম-
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' এমন এক সিনেমা, যে সিনেমাকে সমর্থন দেয়া উচিত সবার। সবার দলেবলে গিয়ে উচিত সিনেমাটি দেখা।
ক্ষুদেবার্তার এই 'পাবলিসিটি স্টান্ট'ও বেশ জনপ্রিয় হয়। যারা ভেবেছিলো এ সিনেমা দেখবে না, তারাও ক্রমশ হয় হলমুখী। এখানে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র ক্ষুদেবার্তার বরাতেই তারা সিনেমাহলে কিন্তু যাচ্ছে না। ক্ষুদেবার্তার আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, ফিল্ম ক্রিটিকদের 'পজিটিভ রিভিউ' এবং বক্স অফিসে ক্রমশ হুলস্থুল ফেলে দেয়া পরিসংখ্যানই একত্রে হয়ে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। অর্থাৎ, সম্মিলিত যুযুধান আক্রমণই মানুষকে পঙ্গপালের মত টেনে নেয় প্রেক্ষাগৃহের দরজায়।
তাছাড়া, এই সিনেমার যে উপজীব্য অর্থাৎ- কাশ্মিরী পন্ডিতদের উপর অত্যাচার, এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এর আগে সেভাবে আসেনি কোনো সিনেমাতেই। তাদের ওপর ঘটে যাওয়া বর্বর নৃশংসতা এতটা নগ্ন করে দেখায়নি আগের কোনো সিনেমাই। এবং বিশেষ এই কারণটিও এ সিনেমাকে দিয়েছে আলাদা গতি। যদিও, সিনেমার পক্ষপাতদুষ্ট স্টোরি ডেভেলপমেন্ট, মুসলিম কমিউনিটিকে 'সব দোষের কেন্দ্রবিন্দু' বানানো নিয়ে নানারকম কথাবার্তা হয়েছে, হচ্ছে, হবেও। সেসবে গা করারও কিছু নেই। অনেকে এও বলছেন, মুসলিম কমিউনিটিকে অ্যাটাক করার কারণেই সিনেমা হিট হচ্ছে! যদিও এটাও পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য। অস্বীকার করার উপায় নেই, কোনো একটা কমিউনিটিকে হিট করলে সিনেমা কখনোসখনো ছিঁটেফোঁটা লাইমলাইট পেতে পারে, কিন্তু তাই বলে এতটা? হয় কখনো?
যাই হোক,অনেক কিছুই বলা হলো। এবার পর্দা নামাই। শেষ কিছু কথা বলি। যারা 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' কেন এরকম অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করলো, সেটার মোদ্দা কারণ এখনও খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের জন্যেই বলা- এই সিনেমার এরকম তাণ্ডবের পেছনে যেকোনো একটি কারণ মোটেও রাখেনি বড়সড় ভূমিকা। বরং অনেকগুলো কারণ একত্রে ক্লিক করেই এই সিনেমাকে এরকম এক হাইটে পৌঁছে দিয়েছে৷ ক্রিটিকদের ইতিবাচক প্রশংসা, প্রধানমন্ত্রীর পাবলিসিটি, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া নিয়মিত সরগরম থাকা, সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে ওয়েল মেড ফিল্ম... সবগুলো সেক্টর এমনভাবে একত্রে কাজ করেছে, যা এর আগে আর কোনো সিনেমার ক্ষেত্রে হয়নি কখনোই। এবং সামনেও হবে বলে মনে হয় না। এবং ঠিক এটাই 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'কে পৌঁছে দিয়েছে ঈর্ষণীয় এক অবস্থানে, যে অবস্থানে পৌঁছাতে গেলে এমন কিছু উপাদানের একসাথে থাকার প্রয়োজন হয়, যা হয়তো 'ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম' ই ঘটে। যদিও এসব কারণই যে বেদবাক্য, তাও নয়। হয়তো এর আড়ালেও আছে বহু চলকের লুকোচুরি। কী সেসব, তা নিয়ে হয়তো আরেকদিন বলা যাবে। আপাতত, আজকের সমাপ্তি এখানেই।