বুয়েটের আর্কিটেকচারের ছাত্র তৌকীরের মন কি আসলেই স্থাপত্যকলায় ছিল? নাকি ক্যাডেট কলেজের ইন্টার হাউজ ড্রামা কম্পিটিশনের সামনের সারিতে বসার সময় যে 'ভূত' মাথায় চেপেছিল, সেটাই তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি কখনও?

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় ইন্টার হাউজ ড্রামা কম্পিটিশনে খুব কার্যকরী ভাবেই সামনের সারিতে একটা নাম সব সময়ই দেখা যায়। তৌকীর আহমেদ নামের সেই দুরন্ত ছেলেটি ক্যাডেট কলেজের পর গিয়ে ভর্তি হলো দেশ সেরা স্থাপত্যকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, ক্যাডেটে পড়া ছেলেগুলো দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়াশুনা করবেন। 

ডিফেন্স থেকে শুরু করে দেশ সেরা ডাক্তার, ইঞ্জিয়ারের আঁতুড়ঘর হিসেবে ক্যাডেট কলেজের নাম সর্বাগ্রেই থাকবে। হয়তো জীবনে সিকিউরড কিংবা মেধার বিকাশের কারনেই হোক, বুয়েটিয়ান ছেলেটি কে আমরা দিন শেষে কি নামে চিনি জানি? এক সময়ের রোমান্টিক জুটির অন্যতম অভিনেতা, এই সময়ের দেশের অন্যতম সেরা পরিচালক।

এখন যদি প্রশ্ন রেখে যাই, তৌকীরের মন কি আসলেই স্থপত্যকলায় ছিলো? নাকি ছোটবেলায় ইন্টার হাউজ ড্রামা কম্পিটিশনের সামনের সারিতে থাকার সময় যে 'ভূত'! মাথায় চাপছিলো; তারই বাস্তবিক প্রয়োগ এখন দেখতে পাচ্ছি।

৮০ দশকে নাটকের রোমান্টিক হিরোর দিন-কাল তো ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু ঐ যে ছোটবেলার মাথায় চাপা ভূত তখন এক্সটেশন হয়ে ক্যামেরার পেছনের কারিগর হতে চায়। হুট করেই একদিন সিনেমা বানাবেন বলে পণ করেন। প্রথম সিনেমা বানাবেন আর তার জন্য বেছে নিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। টেকনিক্যালি থেকে শুরু করে গল্প বলার ধরন সবার থেকেই আলাদা। সিনেমার মাধ্যমে নানা ধর্মের মানুষকে একই প্লেটে খাওয়ানোর দৃশ্য ক্যাপচার করার চিন্তা কিন্তু সবার থাকে না। কিছু কিছু মানুষের থাকে, এমন একজন মানুষের নাম তৌকির আহমেদ।

মাস অর্ডিয়েন্সের কাছে বার্তা পৌছে দেয়ার অন্যতম মাধ্যম হলো আমাদের সিনেমা। সারা বিশ্বেই এই ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়। যা বলতে গিয়েও বাধাঁ আসে, কিংবা বলতে গিয়েও না বলতে পারার মেসেজগুলো সিনেমার মাধ্যমে অবলীলায় পৌছে দেয়া যায় আমজনতার মধ্যে। সেটার আরেকবার প্রমাণ দেয়ার জন্যই কিনা, তৌকির আহমেদ এবার বানালেন "রূপকথার গল্প'। আমাদের দেশের বেশিরভাগই মানুষ যে জীবনের খুব কাছাকাছি থেকেও, না দেখার ভান করে থাকি; এবার সে জীবনকেই তৌকির তুলে আনলেন পর্দায়। আন্ডার প্রিভিলেজড মানুষের গল্প অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন তবে তৌকিরের বলার স্টাইলটা একটু অন্যরকম। আর এই অন্যরকমটাই বাকি সবার থেকে আলাদা করেছে তাকে।

তৌকীর আহমেদের সিনেমা 'স্ফুলিঙ্গ' দেখা যাবে টফি অ্যাপে, বিনামূল্যে

এরপর নির্মান করেন দারুচিনি দ্বীপ নামের খুবই বিখ্যাত সিনেমা। হুমায়ুন আহমেদ এর গল্প, লাক্স সুন্দরীদের প্রথম সিনেমা। গল্প, নাচ, গান সব মিলিয়েই সিনেম দারুন উপভোগ্য। সিনেমা দেখে মনে হয়েছিলো, চাইলে তৌকির আহমেদ কমার্শিয়াল সিনেমাও বানাতে পারবেন। তবে শেষ পর্যন্ত তৌকির কমার্শিয়ালের পথে হাঁটেননি। তিনি তার মতো করে গল্প বলার পথেই হেঁটেছেন। তবে বলতে চেয়েছেন নানা ধরনের গল্প, নানা মানুষের কথা।

তবে এই ভিন্ন ধরনের গল্প, আর নানা মানুষের কথা বলতে তিনি দীর্ঘ একটা বিরতি দেন। প্রায় ৯ বছর বিরতি দিয়ে তিনি ফিরেন ২০১৬ সালে তার অজ্ঞাতনামা সিনেমা দিয়ে। যে সিনেমা আমার সবচেয়ে প্রিয় আর বলতে গেলে সবচেয়ে আক্ষেপ করা সিনেমার নাম। আক্ষেপ এ কারণেই যে এই সিনেমা হলে বসে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। আক্ষেপের জায়গায় কিছুটা প্রলেপের মতো হলো, অনেকের ভাগ্যেই এই সিনেমা হলে বসে দেখার সুযোগ হয়নি। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সিনেমা বানায় শুধুমাত্র পুরস্কারের জন্য, আমজনতার জন্য নয়। এই অভিযোগ কে আরো বেশি করে সত্যি প্রমাণের জন্যই বোধহয় অজ্ঞাতনামা এক সপ্তাহের বেশি সিনেমা হলে চলতে দেয়া হয়নি। অথবা আমরা এখনো ঐ পর্যায়ের দর্শক হয়ে উঠতে পারিনি, যেখানে অজ্ঞাতনামার মতো সিনেমা দেখা, ওয়ার্ড অফ মাউথের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া যায়।

এরপর হালদা নামের সিনেমা বলেছেন হালদা নদীর তীরে বাস করা মানুষের গল্প। যেখানের বেঁচে থাকাই নির্ভর করে এই হালদা নদীর উপরেই। এরপর বানান ভাষা আন্দোলন নিয়ে দেশের হাতে গোনা কয়েকটা চলচিত্রের একটি "ফাগুন হাওয়ায়'। যার জন্য তৌকির আহমেদ কে একটা ধন্যবাদ দেয়াই উচিত। কেউ তো অন্তত চেষ্টা করেছেন আমাদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে কিছু করার।

সিনেমা বানানোর পরিক্রমায় এবছর তৌকীর নিয়ে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই প্রজন্মের যোগাযোগ তৈরি করার প্রয়াস। আর বরাবরের মতো তার মাধ্যম হলো সিনেমা, নাম 'স্ফুলিঙ্গ'। সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার অল্প কয়েকদিন আগে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। লকডাউন, সিনেমা হল বন্ধ, ঘর বন্দী মানুষ- স্ফুলিঙ্গর গল্পটা অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে। সেই সিনেমা এবার আসছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম টফি-তে। দর্শকেরা সিনেমাটা উপভোগ করতে পারবেন বিনামূল্যে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা