সিনেমায় ভ্রমণ, ভ্রমণ নিয়ে সিনেমা: চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইনটু দ্য ওয়াইল্ড, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা কিংবা লায়ন... এসব সিনেমায় ক্ষণেক্ষণেই আসে পাতার মর্মরধ্বনি, ঝিঁঝিঁর কোরাস আর সমুদ্রের উষ্মা। এই সিনেমাগুলো ভাবায় বিস্তর। করে মুগ্ধ। দেয় অচেনা জীবনবোধের সন্ধান। সে সাথে, ভ্রমণ নিয়ে বাড়ায় হাপিত্যেশও। এবং ঠিক সে কারণেই, আজকের কলমযাত্রা এসব বিশেষ সিনেমার প্রতি উৎসর্গিকৃত...
যদিও 'অবসর' বরাবরই দূরত্বে স্থির, তবুও আচমকা কখনোসখনো পরম আরাধ্য এ বস্তু হাতে এসে ধরা দিলে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির উপক্রম হয়। হয়তো এ সময়ে কেউ কেউ বিবাগী হয়ে যেতেও চান বহুদূর। হয়তো কেউ কেউ যেতে পারেনও। কিন্তু বাকিরা পারেন না। তাদের ইচ্ছে ষোলোআনাই আছে, কিন্তু তবুও যাওয়া হয় না। ট্যাঁক বিপত্তি জানায়। মুখব্যাদান করে ঘোষণা করে- চাল-ডালের পৃথিবীতে সংস্থান হবেনা ভ্রমণের৷ অগত্যা, দুধ পালটে যায় ঘোলে। অসহায় মানুষেরা আশ্রয় খোঁজেন বোকা বাক্সে, সিনেমায়। চোখ রাখেন সে সিনেমায়, যে সিনেমায় পাতার মর্মর, ঝিঁঝিঁর কোরাস আর সমুদ্রের উষ্মা মিলেমিশে হয় লীন। সেরকম কিছু সিনেমাই আজকের উপজীব্য, তারাই আজকের আলাপ কিংবা প্রলাপ। কলমের ডগায় এমন সব সিনেমার প্রসঙ্গ আজ, যারা ভ্রমণের আকাঙ্খা বাড়ায় বহুগুণ, সে সাথে শিক্ষা দেয় অমূল্য জীবনবোধেরও।
১. ইনটু দ্য ওয়াইল্ড
'ট্রাভেল ফিল্ম' এর কথা বললেই যে সিনেমার নাম সবার আগে চলে আসে কলমের ডগায়, সে সিনেমা- ইনটু দ্য ওয়াইল্ড। এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট 'ক্রিস' যেভাবে ঘর, সংসার, অর্থবিত্ত ত্যাগ করে চলে যায় প্রকৃত মুক্তির সন্ধানে, প্রকৃতির সন্ধানে... তা কোথাও গিয়ে যেন আমাদেরও 'ঘরছাড়া বাউন্ডুলে' হবার প্রেরণা দেয়। যদিও 'পায়ের তলায় সর্ষে'র বিরল অভিজ্ঞতা ঘটে খুব কম মানুষের সাথেই, তবুও এ সিনেমার বরাতে খানিকটা হলেও যেন ঘুরে আসা যায় অস্পৃশ্য সে জগত থেকে। 'ক্রিস' যেমন আমাদের প্রকৃতির মুখোমুখি করে, তেমনি 'ক্রিস' এর পরিণতি আমাদের এও বোঝায়- প্রকৃতি যেমন অসাধারণ, তেমনি অসাধারণ মানব সম্পর্কের নানামাত্রিক বিন্যাসও। এভাবেই নানান আবহে 'ইনটু দ্য ওয়াইল্ড' হয়ে থাকে সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা।
২.দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ
বিপ্লবী চে গুয়েভারার আত্মস্মৃতি 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ' অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমাও বিশেষভাবে প্রিয়। তরুণ ডাক্তার আর্নেস্তো (চে গুয়েভারা) আর তার প্রিয়বন্ধু গ্রানাদো মিলে যখন লক্কড়-মার্কা মোটর সাইকেল নিয়ে নেমে পড়লেন লাতিন আমেরিকার পথেপ্রান্তরে, বুঝলাম, পথের গল্পই বলছে এ সিনেমা। তবে, আপাতদৃষ্টে দুই তরুণের 'বল্গাছাড়া হরিণ' হয়ে ঘোরার গল্পে যখন ক্রমশই আসে লাতিন আমেরিকার সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতিজনিত বৈচিত্র্যের সাত-সতেরো এবং সমাজের নানা স্তরের মানুষের মিথস্ক্রিয়া, গল্প জমে যায় ঠিক তখনই। বৈষম্য, দারিদ্র্য কিংবা অনটনের পৃথিবী দেখে যেরকম পালটায় আর্নেস্তোর মানসপট, এ সিনেমার সরলতা দেখে ক্রমশ পালটায় আমাদের মনস্তত্বও।
৩. লায়ন
সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত 'লায়ন' এ উঠে আসে 'সারু ব্রিরলি' নামের এক মানুষের গল্প, যে মানুষটি খুব ছোটবেলাতেই বাড়ি থেকে হারিয়ে যান। বিড়ম্বিত ভাগ্যের ফেরে 'এতিম' হয়ে যাকে নিজের দেশ ভারত থেকে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই এক পরিবারের 'দত্তক সন্তান' হিসেবে সারু যতই বড় হতে থাকে, নিজের দেশের জন্যে টান ক্রমশই হতে থাকে জোরালো। এবং সে টান এতটাই অমোঘ, একসময়ে তিনি ফিরেও আসেন ভারতে, আসেন নাড়ির সন্ধানে। এবং ঠিক এভাবেই 'লায়ন' এর পুরো গল্পজুড়ে মূর্ত হয় এক মানুষের শেকড় অনুসন্ধানের সংগ্রাম। এ গল্পের সাথে আশ্চর্য সঙ্গত দেয় প্রকৃতির রকমফেরও।
৪. গ্রিন বুক
'ট্রাভেল ফিল্ম' এ সামষ্টিক বিষয়আশয় কিংবা সামাজিক বৈষম্য নিয়ে কথাবার্তা হয় খুব কম। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন- 'গ্রিন বুক।' এ সিনেমায় ভ্রমণগাঁথার ক্যানভাসে খুব স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয় বর্ণবৈষম্যের বিষবৃক্ষ। ষাটের দশকের আমেরিকা, যে আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য ছিলো এখনের চেয়েও তীব্র, সে সময়ে হোয়াইট ম্যান টনি ভ্যালেলঙ্গার গাড়িতে চেপে 'কান্ট্রি ট্যুর' এ বেড়িয়ে পড়েন আফ্রিকান আমেরিকান সিঙ্গার ডন শিরলি। ডন শিরলি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় যাত্রাপথে যেভাবে নানা বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয় তাকে, এবং এ বৈষম্যের সাথে যেভাবে চলে তার লড়াই, সেসবের বয়ানই 'গ্রিন বুক'কে করে অন্যান্য সিনেমা থেকে স্বকীয়, পৃথক।
৫. জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা
বেশ কিছুদিন আগে দশ বছর অতিক্রম করা 'জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা' এমনই এক বলিউডি সিনেমা, যে সিনেমার মত নির্মাণ বলিউডেই হয়তো আর আসবে না কখনো৷ সম্পর্কের জটিলতা, জীবনের উদ্দেশ্য, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা ষাঁড়ের চোখে লাল রুমাল... সব লেয়ার মিলেমিশে অনবদ্য যে মিশ্রণ, তা কোথাও গিয়ে যেন জীবনের গূঢ় অর্থকেই নির্দেশ করে। কবির, অর্জুন, ইমরান... তিন বন্ধুর রোডট্রিপে বেরিয়ে পড়া, বার্সেলোনার প্রশস্ত রাস্তা থেকে কস্টা ব্রাভার নীল জলের গ্রহ, স্কাইডাইভিং থেকে বুল রানিং... এ সিনেমার পরতে পরতে যেভাবে মিশে থাকে জীবনকে খানিকটা উল্টেপাল্টে দেখার আকাঙ্ক্ষা, সেটা দেখেছি খুব কম সিনেমাতেই।
৬. ওয়াইল্ড
আমরা যে শুধু অ্যাডভেঞ্চার কিংবা জীবনের মোক্ষ খুঁজতেই প্রকৃতিদেবীর কাছে নিজেদের সঁপে দেই, বিষয়টা এরকম না মোটেও। অনেকসময়, পূর্বস্মৃতির বিষাদ ভুলতেও আমরা নেমে পড়ি প্রকৃতি অনুসন্ধানে। ঠিক যেমনটা নেমে পড়ে 'ওয়াইল্ড' সিনেমার 'শেরিল'ও। পূর্বস্মৃতির ক্ষত শুকোতে যে ক্রমশই অন্তর্লীন হয় প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে৷ গল্প যতই এগোয়, শেরিলের পূর্বস্মৃতিও ততই খোলাসা হতে থাকে। পাশাপাশি, স্পষ্ট হতে থাকে, প্রকৃতির মোহময়তাও। এভাবে এগোতে এগোতে হুট করেই একীভূত হয়ে যেতে হয় 'শেরিল' এর সাথে। এবং নির্মাণও অর্থবহ হয়ে ওঠে ঠিক সে মুহুর্তেই।
৭. কারওয়ান
'রোড ট্রিপ' সিনেমা তো বরাবরই বেশ প্রিয়। আর সেরকম এক সিনেমায় যদি থাকে ইরফান খানের মত শিল্পী, তাহলে আর কথাই নেই যেন। 'কারওয়ান'ও ঠিক সেরকম। স্যাটায়ার, হিউমার, ন্যাচার কিংবা ইমোশনাল রোলারকোস্টার তো আছেই, পাশাপাশি, এ গল্পে স্পষ্ট হয় সম্পর্কের নানামাত্রিক জটিলতাও। যে জটিলতার সরল আখ্যানই এ সিনেমাকে করে অন্যদের চেয়ে পৃথক। কোচিতে যাত্রারত ইরফান খানের সাথে দেখা হয় দুলকার ও মিথিলার। এই তিনজন মিলে সময়ের যত গভীরে যেতে থাকে, তাদের সাথে ক্রমশই পরিচয় হয় নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির, নানা ঘটনা-দূর্ঘটনার। মৃদুলয়ে এভাবেই প্রকাশিত হতে থাকে গল্প। পাশাপাশি, এই তিন প্রাণীর জীবন আখ্যানও।
৮. বিফোর সানরাইজ
ট্রাভেল ফিল্মের মধ্যে রোমান্টিক আখ্যান... নিঃসন্দেহে মণিকাঞ্চনযোগ। এবং ঠিক সে কারণেই খুব প্রিয় এক সিনেমার নাম- বিফোর সানরাইজ। যে সিনেমায় প্রেম ও প্রকৃতি, আছে দুটোই। এবং এ সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ দিক এটাই, আরোপিত মনে হয়না এখানের কোনোকিছুই। ট্রেনের যাত্রাপথে দুই তরুণ-তরুণীর আচমকা ভিয়েনায় নেমে পড়া, অচেনা সম্পর্কের খোলসে জড়িয়ে অচেনা শহর দেখা, সময় বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্ক ক্রমশ গভীরতর প্রকোষ্ঠে যাত্রা করা, এরপর বিচ্ছেদের সময় এলে হারিয়ে যাওয়া গভীর কোনো ভাবনায়... 'বিফোর সানরাইজ' বুঁদ করে রাখে বহুকিছুতেই। যদিও পুরো ট্রিলোজিটাই অনবদ্য। কিন্তু 'বিফোর সানরাইজ' যেন সবাইকে ছাপিয়ে বিশেষভাবে হয়ে থাকে প্রিয়।
৯. সিক্রেট লাইফ অব ওয়াল্টার মিটি
ভ্রমণে গিয়ে তুখোড় অ্যাডভেঞ্চার করার শখ তো আমাদের প্রায় সবারই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ভ্রমণগুলো হয় পানসে, ম্যাড়মেড়ে, একঘেয়ে। এবং ঠিক এই পর্যায়ে এসেই ভিন্ন সুরের সন্ধান দেয় 'সিক্রেট লাইফ অব ওয়াল্টার মিটি৷' যে ওয়াল্টার মিটি আচমকাই একদিন নেমে পড়েন অ্যাডভেঞ্চারে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় শুরু হয় যাত্রা। প্রতিকূল পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে শুরু হওয়া যাত্রা ক্রমশই ওয়াল্টার মিটির প্রকৃত সত্তা উন্মোচিত করে। পরিস্থিতি যতই বিক্ষুব্ধ হোক, মিটি পরোয়া করে না। আঁশ মিটিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে আর সে অ্যাডভেঞ্চারের ফাঁকে ফাঁকে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা... 'সিক্রেট লাইফ ওব ওয়াল্টার মিটি' যেন আমাদের অনেকেরই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিনিধি।
১০. দ্য ওয়ে ব্যাক
যুদ্ধের ক্ষত, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, এসবের পাশাপাশি প্রকৃতির বয়ান... সব মিলেমিশে যে মিশ্রণ, সে মিশ্রণের নামই 'দ্য ওয়ে ব্যাক।' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ঙ্কর 'গুলাগ প্রিজন ক্যাম্প' থেকে পালিয়ে আসা কিছু যুদ্ধবন্দী নেমে পড়ে সাইবেরিয়ার মৃত্যুশীতল পথে। সাইবেরিয়ার শীতলতা থেকে আচমকাই আসে রুক্ষ গোবি মরুভূমি। সময় যতই গড়ায়, বেঁচে থাকা হতে থাকে কঠিন। কিন্তু মুক্তির লোভে মরিয়া মানুষগুলো তাও এগোতে থাকে ক্রমশ। প্রকৃতির বয়ানে যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনের জন্যে এ সিনেমা এমনিতেও বিশেষভাবে প্রিয়। পাশাপাশি, 'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' বাক্যটিও যেন আলাদা পূর্ণতা পায় এ সিনেমার কল্যানে।
১১. নীলাকাশাম পাচাকাধাল চাভান্না ভূমি
অনেকটা আর্নেস্তো ও গ্রানাদার মতই দুই বন্ধু- কাশী ও সুনি মোটরসাইকেলে চেপে একদিন বেরিয়ে পড়ে বাইরে। ব্যাঙ্গালোর ও ভাইজাগ হয়ে উড়িষ্যা, ডাকাতদলের খপ্পড়, পুরীর সমুদ্রে সার্ফিং কম্পিটিশন, নাগাল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা... আসে বহুকিছুই। এসবের মাঝখানে দক্ষিন ভারতের অদ্ভুত স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই। দুই বন্ধুর এই 'রোড ট্রিপ' যেমন প্রাকৃতিকভাবে মুগ্ধ করে, তেমনি দেয় কিছু গভীর জীবনবোধেরও সন্ধান৷ বহু বছর পার হলেও তাই এ সিনেমা নিয়ে আলোচনা কমেনা। কমেনা বিস্ময়ের মাত্রাও।