
সম্প্রতি যেমন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার জীবনগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র 'শেরশাহ' খুব জনপ্রিয় হলো, তেমনি নাম কুড়োলো সত্য ঘটনা-আশ্রয়ী 'জয় ভীম'ও। বাস্তব জীবনে এত এত বিচিত্র সব ঘটনা আশেপাশে, সেগুলোর পর্দায় রূপান্তর অধিকাংশক্ষেত্রেই বেশ উপভোগ্য এক ঘটনা। পাশাপাশি এসব নির্মাণ দেয় বিস্তর অনুপ্রেরণাও...
যেকোনো সিনেমার শেষে 'সত্যঘটনা অবলম্বনে' কথা যুক্ত থাকলে, সে সিনেমার আবেদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। উদাহরণ হিসেবে খুব জ্বাজ্জল্যমান অবস্থানে থাকবে স্ট্রিমিং সাইট অ্যামাজন প্রাইমের সাম্প্রতিক নির্মাণ 'জয় ভীম।' সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমা সাধারণ দর্শকের প্রশংসার তোড়ে রীতিমতো ভেসে যাচ্ছে। কুড়োচ্ছে অকৃত্রিম প্রশংসা। সাম্প্রতিক আরেক অনবদ্য নির্মাণ 'সরদার উধম' এর কথাও বলা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। কিংবা কালজয়ী নির্মাণ 'আ বিউটিফুল মাইন্ড' কিংবা 'ইনটু দ্য ওয়াইল্ড' এর উদাহরণও দেয়া যায় ঘুরেফিরে। এ নির্মাণগুলো যুগে যুগে কালে কালে একটি বিষয়ই বুঝিয়েছে, সত্যঘটনা অবলম্বনে কোনো কিছু নির্মিত হলে তা যেন রূপান্তরিত হয় বিশেষ কিছুতে। সেরকমই সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত বেশ কিছু সিনেমা নিয়েই বিক্ষিপ্ত ভাব-বুদ্বুদ আজ। যেসব সিনেমা গুণগতমানে অসাধারণ, কিন্তু সেভাবে পায়নি পাদপ্রদীপ। হয়তো আরেকটু আলোচনা হতে পারতো যেসব নির্মাণ নিয়ে, সেসব আন্ডাররেটেড কিন্তু দুর্দান্ত কিছু নির্মাণ নিয়েই আজকের আঁকিবুঁকি।
১. শহীদ
হানসাল মেহতা বরাবরই সত্যঘটনা-আশ্রয়ী নির্মাণে সিদ্ধহস্ত। তার প্রমাণ আমরা বেশ ভালোভাবে পেয়েছিলাম 'শহীদ' সিনেমাটিতে৷ মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী শহীদ আজমীর জীবনী অবলম্বনে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে রাজকুমার রাওয়ের অনবদ্য অভিনয় যেমন সবার মনে থাকবে অনেকদিন, তেমনি ভোলা যাবেনা পুরো সিনেমার দুর্দান্ত বিন্যাসকেও। প্রচণ্ড অনুপ্রেরণার এ গল্পে বাকি সবকিছুর পাশাপাশি ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠেন আততায়ীদের গুলিতে নিহত একজন সৎ আইনজীবীও। মৃত্যুর পরেও যাকে ভুলে যায়নি কেউ। মৃত্যুর পরেই যিনি হয়েছিলেন অমর৷

২. ফিরাক
২০০২ সালে গুজরাটে হয়ে যাওয়া নারকীয় বিশৃঙ্খলা কিভাবে সেখানের স্থানীয় মানুষদের জীবনকে প্রভাবিত করেছিলো, তা নিয়েই এ সিনেমা। নির্মাতা নন্দিতা দাসের 'নির্মাতা' হিসেবে অভিষেকও হয় এই নির্মাণের মাধ্যমে। নাসিরুদ্দিন শাহ, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, পরেশ রাওয়াল, রঘুবীর যাদব...অনসম্বল কাস্টের এ পলিটিক্যাল থ্রিলারের মূল গল্প যে গভীর ভাবনায় ফেলবে বহু সাধারণ দর্শককে, তা হলফ করে বলাই যায়। পাশাপাশি এ সিনেমা মানুষের পশুবৃত্তির মোড়কও উন্মোচন করে জনসম্মুখে।

৩. দ্য গাজি অ্যাটাক
একাত্তরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও আলাদা এক যুদ্ধ হয়েছিলো। সে যুদ্ধ স্থলপথ, আকাশপথের পাশাপাশি ছিলো জলপথেও। জলপথে দুই দেশের সে সমরে ডুবে যায় পাকিস্তানের শক্তিশালী সাবমেরিন 'পিএনএস গাজি।' এই পাকিস্তানি সাবমেরিনের সাথে ভারতীয় সাবমেরিন এর দ্বৈরথ, বিশাখাপত্তনম এ ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা...সবকিছুই ক্রমশ উঠে আসে এ সিনেমায়৷ কে কে মেনন, রানা দাজ্ঞুবতি, তাপসী পান্নু, অতুল কুলকার্নির দারুণ অভিনয়ের পাশাপাশি গল্পের টানটান বিন্যাসে এই সিনেমার শুরু থেকে শেষ...পুরোটাই উপভোগ্য।

৪. পিহু
যাদের ঘরে দেড়-দুই বছরের শিশু আছে, তারা নির্ঘাতভাবেই এ সিনেমা দেখলে শিউরে উঠবেন৷ দুই বছরের এক শিশু যেভাবে আটপৌরে ঘরের সাধারণ এক সময়কে থমথমে অস্বস্তিতে রূপান্তরিত করে ক্রমশ, তা দেখে যে কেউই আচমকা পড়ে যাবেন বিস্তর অশান্তিতে। এই সিনেমাতে যা দেখানো হয়েছিলো, হুবহু সেই একই ঘটনা ঘটে দিল্লীতে, কয়েক বছর আগে। সেখান থেকেই নির্মাতা বিনোদ কাপড়ি পান এই সিনেমার অনুপ্রেরণা। এই সিনেমা যেমন থমথমে সাসপেন্সে রেখেছিলো শেষতক, তেমনি দিয়েছিলো শক্তিশালী এক বার্তাও। কী সেই বার্তা, তা জানার জন্যে দেখতে হবে 'পিহু।'

৫. শেরনি
ফরেস্ট অফিসারদের চাকরীর বৈচিত্র্যময়তা, রূঢ়তা কিংবা অনিশ্চয়তা নিয়ে নির্মিত 'শেরনি'তে উঠে আসে বনের পশু নিয়ে নানাবিধ রাজনীতি, দুর্নীতির উপাখ্যানও। প্রোটাগনিস্ট বিদ্যা বালান 'বিদ্যা ভিনসেন্ট' চরিত্রের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্রে যেমন স্পষ্ট করেছে সরকারি চাকুরেদের নানাবিধ নৈতিক অবক্ষয়কে, তেমনি খুব দারুণভাবে কটাক্ষ করেছে স্থানীয় ক্লেদাক্ত রাজনীতিকেও। সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমা বুঝিয়েছে মানুষের মানসিক বৈকল্যের সাত-সতেরোও।

৬. নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা
১৯৯৯ সালে খুন হন জেসিকা লাল নামের এক মডেল। জানা যায় এ খুনের পেছনে জড়িত প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার সন্তান। এই খুনের পরবর্তীতে শুরু হয় সিস্টেমের বিরুদ্ধে এক পরিবারের সংগ্রাম। শুরু হয় বিশাল প্রতিবাদও। কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়, সে গল্পই বলে 'নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা।' রানী মূখার্জী এবং বিদ্যা বালানে সওয়ার হয়ে এ গল্প চলে যায় বহুদূর।

৭. ব্ল্যাক ফ্রাইডে
তিরানব্বইয়ে মুম্বাইয়ে হয়ে যাওয়া সিরিজ বোম্বিং এ প্রাণ হারায় ২৫৭ জন মানুষ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' সিনেমাকে ধরা যেতে পারে নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপের ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে। এ সিনেমায় এক্সট্রিম ফ্যানাটিসিজম এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া যেমন দেখানো হয়েছে, তেমনি সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির বাতাবরণও খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। কে কে মেনন, আদিত্য শ্রীবাস্তব, পবন মালহোত্রার মতন দুঁদে অভিনেতারা একত্র হয়ে এই সিনেমাকে দিয়েছে শক্তপোক্ত এক ভিত্তিও।

৮. পূর্ণা
তেলেঙ্গানার এক আদিবাসী মেয়ে পূর্ণা, যে কিনা মাত্র তেরো বছর বয়সেই পার হয়েছিলো মাউন্ট এভারেস্ট, তার জীবনের ভীষণ অনুপ্রেরণামূলক গল্পকে অবলম্বন করে তৈরী হওয়া এ সিনেমা প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেবে, আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার শিক্ষা দেবে। এই সিনেমার শুটিং হয়েছিলো পাকালা গ্রামে, যে গ্রামেই সত্যিকারের পূর্ণার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দারুণ অনুপ্রেরণার এ সিনেমা সবার জন্যেই রেকোমেন্ডেড।

৯. বুধিয়া সিং
ভারতের বুধিয়া সিং, যে কিনা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ম্যারাথন রানার, সে পাঁচ বছর বয়সে পুরী থেকে ভুবনেশ্বরের চল্লিশ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেছিলো মাত্র সাত ঘন্টায়। লিমকা বুক অব রেকর্ডস এর ২০০৬ সালের এডিশন তাকে 'বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ম্যারাথন দৌড়বিদ' হিসেবে আখ্যায়িত করে। সেই বুধিয়া সিং এর জীবনগল্প অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় বুধিয়া ও তার কোচের গল্পই দেখানো হয় একাগ্রচিত্তে৷ দুর্দান্ত এ সিনেমা 'বেস্ট চিলড্রেন'স ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড' ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও জেতে পরবর্তীতে।

১০. মুম্বাই মেরি জান
মুম্বাইবাসীদের ব্যক্তিগত ক্যালেন্ডারের কিছু তারিখে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ অক্ষয় হয়ে থেকে যাবে আমৃত্যু। সেরকমই এক তারিখ- ১১ জুলাই, ২০০৬। এ দিন মুম্বাইয়ের ট্রেন বোম্বিং এ মারা যায় ২০৯ জন মানুষ। আহত হয় সাতশোরও বেশি। মাধবন, ইরফান খান, সোহা আলী খান, পরেশ রাওয়াল, কে কে মেনন... তুখোড় সব অভিনেতায় ভরা এ নির্মাণে খুব দারুণভাবেই উঠে আসে সেদিনের সে ভয়াবহতা, নৃশংসতা। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! বেদনা জাগানোর সে কাজটিই করে 'মুম্বাই মেরি জান' নামের এ নির্মাণ।

সম্প্রতি যেমন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার জীবনগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র 'শেরশাহ' খুব জনপ্রিয় হলো, তেমনি নাম কুড়োলো সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত 'কাগজ'ও। বাস্তব জীবনে এত এত বিচিত্র সব ঘটনা আশেপাশে, সেগুলোর পর্দায় রূপান্তর অধিকাংশক্ষেত্রেই বেশ উপভোগ্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মাণের দৃষ্টান্ত বেশ উর্ধ্বমুখী। এ সূচক সামনের দিকে আরো শীর্ষস্থান পাক, এটাই প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিয়ান টাইমস