উপমহাদেশে 'কিশোর মনস্তত্ব'কে প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ এমনিতেও কম হয়। আবার ছিটেফোঁটা যে কয়টা নির্মাণ হয়, তার অধিকাংশতেই মিশে থাকে প্রণয়-বিচ্ছেদের মকশো। এরকম এক অর্থোডক্স ট্রেডিশনের মধ্য থেকে 'উড়ান' এর এমন ডানা মেলার গল্প, যে গল্প এক যুগ পরে এসে আজও প্রাসঙ্গিক এবং ধরে নেয়াই যায়, যার প্রাসঙ্গিকতা সামনেও কমবে না, সে গল্প ভাবাটাই অন্যরকম এক বৈপরীত্য!
প্রিয় পরিচালক মার্টিন স্করসেজি বলেছিলেন-
ফ্রেমের বাইরে এবং ভেতরে যা আছে, তার সবটুকু নিয়েই সিনেমা।
প্রশ্ন আসে- 'সিনেমা' নামক এই শিল্পরূপটি 'সিনেমা'র সংজ্ঞা ভেদ করে জীবনের খুব ব্যক্তিগত অংশে ঢুকে পড়ে কখন? ক্যামেরার সামনের এই মিথ্যে মিথ্যে সবকিছু কখন হয়ে পড়ে জীবনেরও অংশ? ক্যামেরা আর দর্শকের হৃদয়ের মাঝখানে 'সেতু' হয়ে থাকে যে গল্প, সে গল্প কখন সাদা-কালো অংশ ভেদ করে ঢুকে পড়ে মস্তিষ্কের ধূসর অঞ্চলে?
প্রশ্নগুলো জটিল। এক বাক্যে কিংবা কয়েক বাক্যে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়াও হয়তো সম্ভব না। তবুও কিছু সিনেমা এসব প্রশ্নের মুখোমুখি করে বারবার। বিব্রত করে। খানিকটা বিচলিতও করে। ক্যামেরার ওপার-এপারে এতটাই সামঞ্জস্য, খুব একটা পার্থক্য করা যায় না। এসব সিনেমা গেঁথে বসে মস্তিষ্কে। জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে। ভাবায়। বিস্তর ভাবায়। এবং ক্রমশ সে ভাবনা ক্ষুদ্র এক আলোকবিন্দু হয়ে স্থির হয় হৃদয়ে। সেখান থেকেই আলো ছড়িয়ে যায় চিরকাল।
বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে'র অভিষেক সিনেমা 'উড়ান' সেরকমই এক বিরল বলিউডি সিনেমার উদাহরণ হয়ে সামনে প্রকট হয়, যে সিনেমা শেষ হলেও ভাবনা শেষ হয় না মোটেও। ভাবতে ভাবতে খানিকটা অন্য ভাবনাও চলে আসে- 'উড়ান' এর মত সিনেমা যে ইন্ডাস্ট্রি ২০১০ এ বানাতে পেরেছিলো, সে ইন্ডাস্ট্রির এখন এই নাজেহাল বিম্ব কেন? যদিও এ প্রশ্নের উত্তর খোদ সে ইন্ডাস্ট্রির কাছেও আছে কি না, জানা নেই৷ তবু প্রশ্ন আসেই। আক্ষেপ বাড়ে। বিক্ষোভও।
'উড়ান' এ ফিরি। তুচ্ছ এক ঘটনার জের ধরে বোর্ডিং স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় এক কিশোর ছেলেকে। বোর্ডিং স্কুলের চেনা গণ্ডি আর প্রিয় বন্ধুদের 'স্মৃতি' নামক হাইওয়েতে ফেলে রেখে ছেলেটি ফেরে তার বাবার কাছে। দর্শক ক্রমশ জানতে পারে, এই কিশোরের বাবা, গড়পড়তা আর পাঁচজন বাবার মত না। এই বাবা স্বেচ্ছাচারী, ক্রুর, পাষাণ। বোর্ডিং স্কুল থেকে ফেরার পরেই এই অত্যাচারী বাবার কাছ থেকে যে অপ্রত্যাশিত ব্যবহার পায় ছেলেটি, তা আমাদের চেনা-পরিচিত 'বাবা-ছেলে'র রসায়নকে তীব্রভাবে আঘাত করে। আমরা বুঝতে পারি, গল্প ক্রমশই চেনাপরিচিত গণ্ডি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্যদিকে।
গল্প এগোয়। দর্শকের সামনে ক্রমশ উন্মোচিত হয়, এই কিশোর ছেলেটির লেখালেখির তীব্র ইচ্ছে। সে লিখতে চায়। কিন্তু লেখার কলম আর হাতের মধ্যবর্তী দূরত্বে রাতারাতি গজিয়ে ওঠে প্রাচীর। 'বাবা' নামের এই ভয়ঙ্কর মানুষটি তার লেখালেখির উপর আরোপ করেন অন্তিম নিষেধাজ্ঞা। লেখার খাতার ভস্ম হওয়া ছাই থেকে কারখানায় ভূতের বেগার খাটুনি... উড়তে চাওয়া ছেলের ডানা ছাঁটাইয়ের দক্ষযজ্ঞের পুরোটাই যত্ন নিয়ে করেন তিনি। কিন্তু এভাবে কতদিন? দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ কি ঘুরে দাঁড়ায়? যদি ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে সে গল্পটাও বা কেমন হয়?
'উড়ান' এর প্রাথমিক মুগ্ধতা অবশ্যই গল্পে। গল্প খুব যে অন্যরকম, এমন না মোটেও। কিন্তু শুরু থেকে শেষতক গল্পের বুনোট এবং গল্প শেষের তৃপ্তি এতটাই দুর্দান্ত, গড়পড়তা নির্মাণ থেকে স্বকীয় এক তফাত হয়েই যায়। প্রসঙ্গত জানাই, নির্মাতা বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে যখন 'দেবদাস' এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন, তখন তিনি দেখেছিলেন নির্মাতা কেন লোচ এর বিখ্যাত সিনেমা 'সিক্সটিন।' এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট টিনেজ ছেলেটির গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি লিখতে বসেন 'উড়ান' এর গল্প। গল্প শেষ করেন ২০০৩ এ। এখানে আলাদা নজর রাখতে হবে সালে। কেন? কারণ, সালটা জানা দরকার। ২০০৩ এর সেই সময়ে লেখা এরকম এক গল্প, যে গল্প ২০২২ এ এসেও প্রাসঙ্গিক, গল্প যেন দিগ্বিজয় করে ঠিক এই ছোট্ট তথ্যতেই।
'উড়ান' এর পুরোটাজুড়েই এমন টুকরো টুকরো সব ন্যুয়ান্স, মেটাফোর... লিখতে বসে মাথার আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে সব। 'লেখক' হতে চাওয়া এক কিশোরের গল্প বলার আকুতি, বাবার নিঃসীম ক্রুরতায় হতবিহ্বল বিস্ময়, লোহালক্কড় বনাম গল্প-কবিতার প্রচ্ছন্ন দ্বৈরথ, ভাইয়ের সাথে খুনসুটি-মায়া-স্নেহ, পুরোনো অ্যালবামে নীরবে অশ্রুপাত, অত্যাচারী বাবার সাথে টক্কর... প্রতিটা দৃশ্যই যেন একেকটা চিরকুট, যে চিরকুটের লেখাটুকু হৃদয় শীতল করে দেয়ার মতই স্নিগ্ধ। এমনকি যে গান ও কবিতাগুলো ব্যবহার করা হলো পুরো সিনেমায়, সেগুলোও এতটাই অনবদ্য ও অন্তর্ভেদী... অসাধারণ!
কলকাতার এক বিখ্যাত ভিলেন একবার গিয়েছেন এক অনুষ্ঠানে। হঠাৎ করে তিনি লক্ষ্য করলেন, কিছু মানুষ তাকে মারতে আসছে। জানা যায়- সিনেমায় তার ক্রুর অভিনয় দেখে এই মানুষেরা ভেবে নিয়েছে, তিনি হয়তো বাস্তবেও খারাপ মানুষ। তাই এই আচমকা আক্রমণ। এরপর কোনোরকমে বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণ ঠেকিয়ে ভদ্রলোক গাড়িতে উঠলেন এবং গাড়িতে উঠেই মুচকি হাসতে লাগলেন। তার সহযাত্রী কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো হাসার কারণ। তখন সে অভিনেতা বেশ উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন-
ভিলেনের অভিনয় আমি এতটাই ভালো করেছি, মানুষজন বাস্তব আর পর্দা গুলিয়ে ফেলেছে। এটাই তো আমার বড় প্রাপ্তি।
যদিও নিশ্চিত নই, রনিত রয়ের কপালে এরকম 'অভিনয়'জনিত বিপত্তি ঘটেছিলো কি না। কিন্তু 'উড়ান' এর অত্যাচারী বাবার চরিত্রে যে দুর্ধর্ষ অভিনয় তার, যেভাবে মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছে এই চরিত্র, তা নিঃসন্দেহে খুব কম চরিত্রই পারে। এবং চরিত্রটি ঠিক এখানে এসেই সার্থক। এই 'বাবা' চরিত্র এতটা ডার্ক ও ক্ল্যাস্টোফোবিক না হলে, গল্পের স্বকীয়তা এমনভাবে যে ধরা দিতোনা মোটেও, তা তো নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব। তাই, পার্শ্বচরিত্র হয়েও এই চরিত্র যেন আরো বড় গণ্ডির প্রভাবক হিসেবেই থাকে উপস্থিত। রনিত রায়ের এই সিনেমায় যুক্ত হওয়ার গল্পটাও অন্যরকম। তিনি আর অনুরাগ কাশ্যপ একই ফ্ল্যাটে থাকতেন। সকালে তিনি বের হচ্ছেন, বেসমেন্টে অনুরাগ কাশ্যপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। রনিত রয়কে দেখেই আচমকা অনুরাগ কাশ্যপ বলে উঠলেন-
একটা সিনেমা করবে? মাত্র পাঁচদিনের শ্যুটিং।
রনিত রায় রাজি হলেন। বাকিটা পর্দার গল্প। অত্যাচারী 'বৈভব সিং' হয়ে অভিনয়ের নানা মাত্রা দেখানোর গল্প।
অডিশনের মাধ্যমে এই নির্মাণে যুক্ত হলেন রজত বার্মেচা। যিনি অভিনয় করেছিলেন প্রোটাগনিস্ট কিশোর ছেলেটির চরিত্রে। চরিত্র বুঝে শুরু থেকে শেষতক অভিনয়ে 'অসাধারণত্ব' না এলেও 'দারুণ' করলেন। 'অ্যামেচার'সুলভ কিছু না করে সামলালেন সব ঠিকঠাক। বিশেষ এক চরিত্রে রাম কাপুরের অভিনয়ও মনে লেগে রইলো। গল্প যখনই দমবদ্ধ একেকটা সময় পার করছে, তখনই প্রেক্ষাপটে এলেন এ মানুষটি, এবং গল্পে স্বস্তির জায়গা তৈরী করলেন। যোগ্য সমর্থন দিলেন নির্মাণকে। বাকিরাও অনবদ্য। কেউই গড়পড়তা না। সবাই-ই দারুণ।
'উড়ান' নিয়ে কথা ফুরোবে না। কিছু সিনেমা এমনই হয়, কথা ফুরোয় না। তবুও সাঁঝবাতি জ্বালাতে হয়। সন্ধ্যা হয়। লেখারও সমাপ্তিরেখা টানার দায় থাকে। সেজন্যেই তাই ফেরার পথ ধরা। ফিরতি পথে ভাবছি, 'উড়ান' এর গল্প, অভিনয়, দৃশ্যায়ন, সঙ্গীত... প্রতিটি বিভাগেই তো একের পর এক চমক পেয়েছি। তবুও সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম কোথায়? ভাবতে ভাবতেই পেলাম উত্তর। 'উড়ান' এর সবচেয়ে সৌকর্যের দিক, এর ভাবনাটুকুই। উপমহাদেশে 'কিশোর মনস্তত্ব'কে প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ এমনিতেও কম হয়। আবার ছিটেফোঁটা যে কয়টা নির্মাণ হয়, তার অধিকাংশতেই মিশে থাকে প্রণয়-বিচ্ছেদের মকশো। এরকম এক অর্থোডক্স ট্রেডিশনের মধ্য থেকে 'উড়ান' এর এমন ডানা মেলার গল্প, যে গল্প এক যুগ পরে এসে আজও প্রাসঙ্গিক এবং ধরে নেয়াই যায়, যার প্রাসঙ্গিকতা সামনেও কমবে না, সে গল্প ভাবাটাই অন্যরকম এক বৈপরীত্য। পাশাপাশি, গল্প-বয়ানে এমন সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা, এমন সব বোধের দরজা খুলে দেয়া... এসবের জন্যেই 'উড়ান' অবধারিতভাবে প্রিয় নির্মাণের তালিকার শীর্ষের দিকেই স্থান পায়। হয়তো সমাজ-সংসারের চাপে নিজেদের ডানা ছেঁটেই ফেলেছি আমরা, তবুও, অন্তত, গল্পেও যদি কারো মুক্ত হয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখি, মন ভালো হয়ই। সে কারণেই 'উড়ান' নিয়ে এতটা মুগ্ধতা। এতটা ভালোলাগা। 'সব পেয়েছি'র তৃপ্তি পাওয়া।