এই অভিনেতাদের কারোরই প্রতিভার ঘাটতি নেই মোটেও। ঘাটতি শুধু সুযোগে। আশা করি, স্ট্রিমিং সাইট কিংবা বিনোদন-মাধ্যমের পালটে যাওয়া সময়ের কল্যানে যোগ্য সব চরিত্রে কাজ করার সুযোগ তারাও পাবেন। নির্মাণের প্রোটাগনিস্টদের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন তারাও...

সিনেমা টিমওয়ার্ক। কিন্তু এখানে বরাবরই প্রাধান্য পায় গুটিকয়েক মানুষ। পোস্টারে যাদের ক্লোজআপ শট, তারাই সর্বেসর্বা। ওপেনিং ব্যাটসম্যান। একেবারে শেষের দিকে যারা, তাদের আলাদাভাবে মনে রাখে না কেউ। অথচ ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, তারাই উপস্থিত দুর্দান্ত সব পারফরম্যান্স নিয়ে। কিন্তু যোগ্য সম্মান? সেখানেই যত গাইগুই। 'ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো'র মতন দরকারে ডাক পড়ে তাদের। কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলেই উপেক্ষা।

যদিও ওটিটি'র কল্যানে কিছু অভিনেতা তাও খানিকটা হলেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। 'স্ক্যাম ১৯৯২' এর কল্যানে প্রতীক গান্ধী কিংবা 'পাতাললোক' এর কল্যানে জয়দীপ আহলিয়াত পেয়েছেন খানিকটা হলেও পরিচিতি। কিন্তু 'ওটিটি' নামক এই আশ্চর্য প্রদীপ না থাকলে এই মানুষগুলো কতদিনে পেতেন প্রাপ্য সম্মান ও গ্রহনযোগ্যতা, বা, আদৌ পেতেন কী না, তা ভীষণ বিতর্কের বিষয়। তবে সে বিতর্ক উহ্য রেখে আজ বরং কথা বলি এমন সব অভিনেতাকে নিয়ে, ওটিটির এ বাড়বাড়ন্ত সময়ে এসেও যারা সেভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন নি। অথচ, যাদের নিয়ে পুরোদস্তুর আলোচনা হওয়া দরকার। 

১. সঞ্জয় মিশ্র

গুণী এ অভিনেতার সিনেমা-ক্যারিয়ার ২৫ বছরের। অভিনয় করেছেন ধামাল, মাসান, অফিস অফিস, গোলমাল অ্যাগেইন, কামিয়াব এর মতন জনপ্রিয় নির্মানগুলোতে। অথচ এমনও সময় গিয়েছে টাকার অভাবে বলিউড ছেড়ে ধাবায় রুটি-অমলেট বানানোর কাজও করতে হয়েছে তাকে। যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেসব চরিত্রের অধিকাংশই জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু সাফল্য বা খ্যাতিই কেন যেন সঞ্জয় মিশ্র'র বরাতে সেভাবে জোটেনি কোনোদিন।

সঞ্জয় মিশ্র

২. সৌরভ শুক্লা

এই অভিনেতার দুর্দান্ত অভিনয়-দক্ষতার সপক্ষে  একমত হবেন সমস্ত দর্শকই। ভালো অভিনয় তো তিনি করেনই, আবার মাঝেমধ্যে এতটাই অনবদ্য অভিনয় করে ফেলেন তিনি, প্রোটাগনিস্টকেও ম্লান করে ফেলেন। তুখোড় এই অভিনেতা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বলিউডে রয়েছেন, করেছেন অজস্র সব মনে রাখার মত কাজ। 'সত্য'র কাল্লু মামা থেকে 'জলি এলএলবি'র জাস্টিস ত্রিপাঠী...অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন বরাবর। জনপ্রিয়ও হয়েছেন। কিন্তু ততটা  না, যতটা জনপ্রিয়তা প্রাপ্য ছিলো তার। 

সৌরভ শুক্লা

৩. মোহাম্মদ জিশান আইয়ুব

অভিনয়ের দৈর্ঘ্য দিয়ে অভিনয়ের দোষ-গুণ বিচার হয় না মোটেও। অভিনয়ের বিচার হয় গভীরতা দিয়ে। সে গভীরতার বিচারে জিশান আইয়ুবের অভিনয় গুণগতমানে উপরের দিকেই থাকবে। রানঝানা'র 'মুরারি' কিংবা 'তানু ওয়েডস মানু রিটার্নস' এর 'চিন্টু' কিংবা 'আর্টিকেল ১৫' এর নিশাদ...চরিত্র যেরকমই হোক, জিশান আইয়ুব ঠিকই অভিনয় দিয়ে সে চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। তবে আক্ষেপ একটাই, এসব সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয় করার পরেও পরিচালকেরা বড় কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে কোনোদিনই দেননি তাকে। 

মোহাম্মদ জিসান আইয়ুব

৪. আরশাদ ওয়ারসি

'মুন্না ভাই এমবিবিএস' এর 'সার্কিট' চরিত্র দিয়েই সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর সময়ের ফেরে অভিনয় করেছেন বলিউডের মূলধারার অজস্র সিনেমায়। ইশকিয়া, জলি এলএলবি কিংবা সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়া টিভি সিরিজ 'অসুর'এও ছিলেন তিনি সপ্রতিভ। কিন্তু জনপ্রিয়তার বিচারে তিনি কেন যেন পিছিয়েই আছেন খানিকটা। 'ফেমাস ফেস' না হওয়ায় 'জলি এলএলবি'র সিক্যুয়েল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তাকে। নেয়া হয়েছে অক্ষয় কুমারকে। অথচ 'জলি এলএলবি'তে তার অভিনয় কতটা অনবদ্য ছিলো, তা সব দর্শকই জানেন। 

আরশাদ ওয়ারসি

৫. জিমি শেরগিল

এই অভিনেতার অভিনয়-ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে খুব কম মানুষই পারবেন। যখনই যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, ছোট কিংবা বড়, নিজের সেরাটাই দিয়েছেন বরাবর। এ ওয়েডনেসডে, মোহাব্বতে, হাসি, তানু ওয়েডস মানু কিংবা হ্যাপি ভাগ জায়েগি...প্রত্যেক সিনেমাতেই আলাদা করে নজর কেড়েছেন তিনি। কিন্তু দারুণ অভিনয়-ক্ষমতা এবং দুর্দান্ত পারফরম্যান্স থাকা সত্বেও কেন যেন দর্শকের ভালোবাসা ঠিক সেভাবে পাওয়া হয়নি তার। বলিউডে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে তার লড়াই চলছে এখনও। 

জিমি শেরগিল

৬. বিজয় রাজ

'বিজয় রাজ'কে যদিও 'কমেডি'রোলেই আটকে রাখার চেষ্টা করেছেন বহু পরিচালক, কিন্তু তিনি যে সিরিয়াস রোলেও অনবদ্য, তার প্রমাণও তিনি দিয়েছেন বহুবার। সাম্প্রতিক 'শেরনি' সিনেমাতে তিনি 'হাসান নুরানি' চরিত্রে সিরিয়াস অভিনয় করে প্রোটাগনিস্ট বিদ্যা বালানের সাথে সমানতালে পাল্লা দিয়েছেন। এছাড়াও মনসুন ওয়েডিং রান কিংবা দিওয়ানা হুয়ে পাগল, ওয়েলকাম, ধামাল...এই সিনেমাগুলোতেও বিজয় রাজ উজ্বল ছিলেন বরাবর। 

বিজয় রাজ

৭. রজত কাপুর

রজত কাপুর বলিউডে জনপ্রিয় নাম। দিল চাহতা হ্যায়, মনসুন ওয়েডিং, কাপুর অ্যান্ড সনস, ভেজা ফ্রাই, শব্দজব্দ...অজস্র নির্মাণে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনয়শৈলীও বরাবরই নির্দিষ্ট এক মান ধরে রেখেছে। কখনোই কোনো নির্মাণে 'তথৈবচ' অভিনয় করেননি, করার চেষ্টাও করেন নি। এখন অভিনয় ছেড়েছেন। পরিচালনায় মনোযোগী হয়েছেন। তবে অভিনয় ছাড়লেও ক্যামেরার পেছনে থেকে দারুণ সক্রিয়ভাবে তিনি এখনও অভিনয় নিয়ে গাইড করে যাচ্ছেন কুশীলবদের। নিয়মিত। 

রজত কাপুর

৮. পবন মালহোত্রা

সাতাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছেন বলিউডে, অথচ পবন মালহোত্রার সেরকম আলাদা কোনো পরিচয় তৈরী হয়নি এখনও। মনে রাখার মত পারফরম্যান্স কী কম তার? 'ভাগ মিলখা ভাগ' এ ফারহান আখতারের কোচ কিংবা 'জাব উই মেট' এর সেই পাঞ্জাবি আঙ্কেল অথবা 'রুস্তম' এর সেই রাগী অফিসার...যেসব নির্মাণের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, সেসব নির্মাণে পবন মালহোত্রা দুর্দান্ত অভিনয়ই করেছেন নিয়মিত। কিন্তু তবুও এখনও প্রাপ্য জনপ্রিয়তা পাওয়া হয়নি তার। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই তাই এখনও লড়ছেন তিনি। 

পবন মালহোত্রা

৯. পীযূষ মিশ্র

গ্যাংস অব ওয়াসিপুর, রকস্টার কিংবা গুলাল... সিনেমাগুলোতে তিনি যে অভিনয় করেছেন, তা চোখে লেগে থাকবে অনেকেরই। কিন্তু এত এত দারুণ অভিনয়ের ভীড়েও খুব কম মানুষের কাছে পরিচিত তিনি। সালমান খানের অভিষেক সিনেমা 'ম্যায়নে পেয়ার কিয়া'র অফারও প্রথমবার দেয়া হয়েছিলো পীযূষ মিশ্রকে। কিন্তু তিনি সে অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। অভিনয়ে হতাশ হয়ে পীযূষ মিশ্র এখন অভিনয়ের পাশাপাশি স্ক্রিনরাইটিং এবং লিরিসিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। দারুণ কাজই করছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অভিনেতা' হিসেবে জনপ্রিয় না হওয়ার আক্ষেপ এখনও পোড়ায় তাকে। 

পীযূষ মিশ্র

১০. বিনয় পাঠক

গুণী অভিনেতা বিনয় পাঠকের অভিনয়-ক্যারিয়ার বহু দিনের। কাজ করেছেন দারুণ দারুণ সব নির্মাণে। ভেজা ফ্রাই, রাব নে বানা দে জোড়ি, মাই নেম ইজ খান...এসব সিনেমায় যেসব চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, সেসব চরিত্র খুব গভীরভাবেই মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কিন্তু তবুও বেলাশেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, বিনয় পাঠক  তার প্রাপ্য জনপ্রিয়তাটুকুর পুরোপুরি কী পেয়েছেন? নাকি আরেকটু পাওয়া বাকি ছিলো তার? 

বিনয় পাঠক

আশার ব্যাপার হচ্ছে এটাই, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর কল্যানে বলিউডের অনেক আন্ডাররেটেড অভিনেতাই ইদানীং বড় বড় নির্মাণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। বলা বাহুল্য, এই অভিনেতাদের কারোরই প্রতিভার ঘাটতি নেই মোটেও। ঘাটতি শুধু সুযোগে। আশা করি, স্ট্রিমিং সাইট কিংবা বিনোদন-মাধ্যমের পালটে যাওয়া সময়ের কল্যানে যোগ্য সব চরিত্রে কাজ করার সুযোগ তারাও পাবেন। নির্মাণের প্রোটাগনিস্টদের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন তারাও। তাহলেই সর্বাঙ্গসুন্দর। 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা