'চরকি'র 'ঊনলৌকিক অ্যান্থোলজি' শেষ হলো গতকাল। শেষ পর্ব দেখা শেষে একটা কথাই মনে হচ্ছে বারবার, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকের মুগ্ধতার প্যারামিটার একবিন্দুতে স্থির রেখে ইতি টানা এই অ্যান্থোলজি সিরিজের মতন কাজ বাংলাদেশে খুব কম হয়েছে...

অনেক সময় এমন হয় না, কোনো একটা নাটক অথবা সিনেমা অথবা বই শেষ হয়ে গেলে আক্ষেপ হয়; ইশ! আরেকটু যদি থাকতো। অনেকদিন পরে সেই আক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিলাম আবার। 'চরকি'র 'ঊনলৌকিক অ্যান্থোলজি' শেষ হলো গতকাল। শেষ পর্ব দেখা শেষে একটা কথাই মনে হচ্ছে বারবার, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকের মুগ্ধতার প্যারামিটার একবিন্দুতে স্থির রেখে ইতি টানা এই অ্যান্থোলজি সিরিজের মতন কাজ বাংলাদেশে খুব কম হয়েছে। 

সিরিজের শেষ গল্প 'দ্বিখণ্ডিত' নিয়ে প্রত্যাশার পারদ অবশ্যই বেশি ছিলো। এমনিতেই শেষ গল্প। তাছাড়া 'শেষ ভালো যার, সব ভালো তার' নামক ক্লিশে এক প্রবাদের সত্যতা যাচাইয়েরও এক বিষয় সেখানে উপস্থিত ছিলো পুরোদমে। সেগুলো মাথায় রেখেই নির্মাণের শুরুটা হয় বেশ দারুণ। এক গাড়ির দৃশ্য দিয়ে গল্পের শুরু। যে গাড়িতে করে কয়েকজন লোক যাচ্ছেন কোনো এক গন্তব্যে। ক্যামেরা সবার পেছনে থাকায় কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে শোনা যাচ্ছে তাদের কথাবার্তা। সে কথাবার্তাও বিস্তর লাগামবিহীন। সুকুমার রায়ের 'ননসেন্স রাইম' এর মতন বলা যেতে পারে- ননসেন্স টক। তাদের কথাবার্তা কুকুরের মাংস থেকে শুরু হয়ে ঘুরে আসে টাট্টিঘরের চৌহদ্দি পর্যন্ত। গাড়ির ভেতরের এই মানুষগুলোর কথোপকথন বিস্তর আগ্রহোদ্দীপকও।  খানিকটা হুমায়ূন আহমেদের ফ্লেভারও ঘুরপাক খায় তাদের কথায়। 

শুরুর দৃশ্যে কারোরই মুখাবয়ব পরিষ্কার না! 

গল্পের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখতে পাই, মোস্তাক আহমেদ নামের এক ভদ্রলোক কে, যিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের কেরানি। ফুলশার্ট, জাম্পার এবং মাফলার গলায় জড়িয়ে যিনি এসেছেন থানায়। পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে বসে তিনি শোনাচ্ছেন অদ্ভুত কিছু গল্প। সে গল্পের কোনো কাঁটাতার নেই। গল্প এই থাকছে হিমালয়-চূড়ার একেবারে কাছে, সেখান থেকে সাঁই করে চলে আসছে উত্তর ভারতে, সেখান থেকে দুম করে উপস্থিত হচ্ছে বাংলাদেশের খুলনায়। তবে এই যে গল্পগুলো তিনি বলছেন, সেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন মনে হলেও গল্পগুলোর একটির সাথে আরেকটির এক বিশেষ জায়গায় সম্পর্ক আছে। যিনি গল্প বলেছেন, তার নিজের জীবনের সাথেও সম্পর্ক আছে গল্পগুলোর। কী সেই সম্পর্ক? 'দ্বিখণ্ডিত'র ক্লাইম্যাক্স বলবে তা।

দ্বিখণ্ডিত'র সবচেয়ে মুগ্ধকর দিক, ইন্তেখাব দিনার এবং তার দুর্দান্ত অভিনয়। এই অভিনয়কে তার ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স বললেও অত্যুক্তি হবে না। আঠারো পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক স্ক্রিপ্ট পুরোটাই ডেলিভারি করার দায়িত্ব ছিলো তার। ক্যামেরাও ঠাঁয় বসে ছিলো তার মুখের সামনে। অথচ কী সাবলীল অভিনয়ই না করলেন। কোনো আড়ষ্টতা নেই, একজন কেরানির 'ধূর্ত অথচ অতি-বিনয়' হাবভাব তার চোখেমুখে স্পষ্ট। এবং তিনি যে গল্পগুলো বলছেন, সেগুলো আপাদমস্তক চুম্বকের মত আকর্ষণ করে রাখছে। নড়াচড়ার সুযোগ দিচ্ছে না। 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' এর গুপি গান গাইলে যেমন কেউ নড়তে-চড়তে পারতো না, এখানেও সেই অবস্থা। নটনড়নচড়ন।  

ইন্তেখাব দিনার; একাই টেনে নিয়েছেন পুরো গল্পকে! 

পাঁচটি গল্পের মধ্যে হয়তো 'দ্বিখণ্ডিত' কারো একটু বেশিই ভালো লাগবে। কারো একটু কম ভালো। তবে এটা ঠিক, 'ঊনলৌকিক' এর আগের চারটি পর্বের ক্লাইম্যাক্সে যে চমক, যে চমকে মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়, সে চমক এই গল্পে খানিকটা কম ছিলো। সে আক্ষেপ পুষিয়ে দিয়েছেন ইন্তেখাব দিনার এবং খুবই ইন্টারেস্টিং এই গল্প। 

শেষ করার আগে আমিও একটা গল্প বলি। একবার আমি গিয়েছিলাম এক রেস্টুরেন্টে। বেশ দামী রেস্টুরেন্ট। কেতাদুরস্ত চেয়ারে জুত করে বসেছি। সাউন্ডবক্সে মৃদু আঁচে বাজছে জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতা। শুনছি। হঠাৎ করেই টেবিলে ঠুক করে শব্দ। কিছু অর্ডার করার আগেই এক ওয়েটার আমার সামনে হাজির করেছে- পাফার ফিশ বা পটকা মাছের এক বিশেষ রেসিপি। আমি ওয়েটারের দিকে সপ্রশ্ন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখি, ওয়েটার কিছু না বলে ফ্যাকাশে এক হাসি দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উপক্রম করছে। আমি বুঝলাম, সমস্যা আছে এই রেস্তোরাঁয়। এখান থেকে পড়িমরি করে উঠে রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বের হবো, ধাক্কা খেলাম এক মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া ভদ্রলোকের সাথে। তিনিও হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছেন কোথাও। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-

সিনেমাহল কোনদিকে বলতে পারেন? আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে সিনেমা হলের সামনে। হাতে দুটি টিকেট৷ দুজনে 'দেবী' সিনেমা দেখতে যাবো। 

আমি জানতাম না সিনেমাহলের ঠিকানা। না সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে আসবো, খেয়াল করলাম আমি মাঝরাস্তায়। রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে একটা টিভি চলছে। বিদ্যুৎ নেই। সংযোগ নেই। ড্যাবড্যাব করে তবু টিভি চলছে। প্রবল বিস্ময়ে দেখলাম, সে টিভিতে দেখানো হচ্ছে আমাকে! আমি একটা লালরঙা বাসে উঠেছি। আমার পিছনে চারজন সশস্ত্র মানুষ, আমাকে খুন করতে উদ্যত। ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি আমার ঘরে, আমি ঘুমোচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি। সে স্বপ্নে এলো জাম্পার, মাফলার পেঁচানো একজন মানুষ, যিনি হাসতে হাসতে বললেন-

আপনি এখন মারা গিয়েছেন। কিন্তু একটু পরে বেঁচে উঠবেন আবার। এরপর আবার মারা যাবেন। একটা মানুষ দুইবার মরতে পারে? বলেন?

আচমকা ঘুম ভাঙ্গলো আমার। পুরো শরীর ঘামে চিটচিটে, গলা শুকিয়ে কাঠ। বেডসাইড টেবিল থেকে পানি খেতে যাবো, দেখি সেখানে দুই পৃষ্ঠার এক গল্প। আগ্রহী হয়ে গল্প পড়তে গেলাম, দেখি এ গল্পটা আমারই। তবে শেষটা ভয়ের। যেখানে বলা হয়েছে-

ছেলেটি ঘুম থেকে ভীষণ বিশ্রী এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠবে। এরপর বেডসাইড টেবিলে একটা গল্প পাবে। সেটা পড়ার মাঝখানেই দরজায় ধাক্কা দেবে কেউ একজন। যিনি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, তার হাতেই মৃত্যু হবে ছেলেটির।

আচমকা দরজায় ভারী হাতের দুমদাম শব্দ শুরু হলো। কী করবো আমি? দরজা কী খুলবো? আচ্ছা, আমি কী এখনো স্বপ্ন দেখছি? 

'ঊনলৌকিক অ্যান্থোলজি'র জন্যে শেষ গল্পটা নৈবেদ্য হিসেবে থাকুক। নির্মাতা রবিউল আলম রবি, প্রোডাকশন ডিজাইনার সৈয়দ আহমেদ শাওকী সহ পর্দার সামনের ও পেছনের প্রত্যেক কলাকুশলীর জন্যে বিনম্র সম্মান রইলো। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা