যে 'উস্তাদ হোটেল' আক্ষেপে পোড়ায়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'উস্তাদ হোটেল' সিনেমায় কী আছে? কেন এই সিনেমা হাসায়, কাঁদায়, বিভ্রান্ত করে? কেন এই সিনেমা শেষ হলেও বুক খচখচানির দীর্ঘশ্বাস থাকে বহুক্ষণ? এসব প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর দেয়া খানিকটা দুরূহ হলেও এটা বলাই যায়, 'উস্তাদ হোটেল' এর পুরোটা জুড়ে কালিকটের সমুদ্র-উপকূলের এক রঙিন আস্তানা। যে আস্তানার নাম- 'উস্তাদ হোটেল।'
জীবন এক অদ্ভুত সরাইখানা। মানুষ ক্ষনিকের মুসাফির। কিছু সময়ের জন্যে আসা। সুখ-দুঃখ-বিষাদে মাখামাখি হওয়া। নিরন্তর চড়াই-উৎরাই এর সাথে মোকাবেলা করতে করতে আচমকা শোনা- যাত্রার সময় শেষ। উঠতে হবে বাহনে। ফিরতে হবে সে গন্তব্যে, যেখান থেকেই আগমন। অগত্যা, রঙ-ঝলমলে সরাইখানা থেকে বিদায়। ক্রমশই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। পেছনে পড়ে থাকা কিছু টুকরো চিরকুট, যেগুলোকে সবাই 'স্মৃতি' বলেই জানি।
যদিও সবারই জানা, জীবন খুব সীমাবদ্ধ এক সময়কাল, তবুও কেন যেন গোটা জীবনজুড়ে খোদ জীবনকেই জানা হয়না কারো। জীবনের মানে কী, এই কমলালেবু গোলকে ঠিক কী কারনে আবির্ভাব, এসব নিয়ে ভাবনার আগেই ক্রমশ সবাই হারিয়ে যাই যাপিত সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, বর্বরতার ভয়ঙ্কর সব ঘূর্ণিতে। ক্ষমতার আকাঙ্খা, অর্থের মোহ কিংবা ভোগের লোভে আমরা ক্রমশই সীমাবদ্ধ করি আমাদের। কোনঠাসা করি জীবনের সংজ্ঞাকেও। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন-
জীবনে এমন কিছু করো, যাতে পৃথিবীর বুকে সামান্য হলেও একটা আঁচড় পড়ে।
পৃথিবীর বুকে আঁচড় কাটা দূরে থাকুক, আমরা কী দিয়ে আঁচড় কাটবো, সে উপাদানই খুঁজে পাইনা কখনো। অথবা, আঁচড় কাটার অনুষঙ্গ হয়তো নিকটেই ছিলো। আমরা খোঁজার মত খুঁজিইনি কোনোকালে।
সিনেমার চেয়ে প্রোলোগ বড় হয়ে যাচ্ছে। মূল প্রসঙ্গে ফিরি। মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে আমার বরাবর মনে হয়, রত্নের এক অমূল্য ভাণ্ডার! এখানের নির্মাতারা এবং অভিনেতারা একত্রে যুক্ত হয়ে স্বল্প পুঁজিতে এবং সীমাবদ্ধ উপকরণে সময়ের নানা বাঁকে অনন্যসাধারণ গল্পের যেসব নির্মাণ বানিয়েছেন, সেসব নির্মাণে ভাবার উপকরণ যেমন আছে বিস্তর, মুগ্ধতার উপকরণেরও শেষ নেই মোটেও। এরকম দুর্দান্ত সব গল্পের মোহে পড়ে ঠিক যে সময়ে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়েছিলাম, সে সময়ের এক সিনেমা উস্তাদ হোটেল। যে সিনেমা আসলে সিনেমা না৷ বরং জীবনবোধের কিংবা জীবন-ঘনিষ্ঠ দার্শনিকতার টুকরো এক স্থাপত্য। যে সিনেমা বহু বছর আগে দেখে চোখের কোনে চিকচিক করেছিলো জল। যে সিনেমা এতবছর পর দেখতে বসে শেষদিকে এসে আবারও হয়েছি সেই একই অনুভূতির মুখোমুখি! বুঝেছি, এ সিনেমার শেষাংশে চোখে জল আসাই নিয়তি। এবং চোখ ভিজলেই হয়তো বোঝা যায় 'উস্তাদ হোটেল' এর মাহাত্ম্য!
'উস্তাদ হোটেল' এ কী আছে? কেন এ সিনেমা হাসায়, কাঁদায়, বিভ্রান্ত করে? কেন এ সিনেমা শেষ হলেও বুক খচখচানির দীর্ঘশ্বাস থাকে বহুক্ষণ? এসব প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর দেয়া খানিকটা দুরূহ হলেও এটা বলাই যায়, 'উস্তাদ হোটেল' এর পুরোটা জুড়ে কালিকটের সমুদ্র-উপকূলের এক রঙিন আস্তানা। যে আস্তানার নাম- 'উস্তাদ হোটেল।' এই দোকানের যিনি মালিক, তিনি করিম ক্কা। করিম ক্কা অদ্ভুত একজন মানুষ। জীবনের অধিকাংশ সময়েই ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে। একাধিক ভাষা শিখেছেন। নানা রকম কাজ করেছেন। টাকাপয়সা জমাতে চাইলে হয়তো জমাতে পারতেন। কিন্তু টাকার দিকে মন ছিলোনা মোটেও। সারাজীবন দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল রুমাল বাঁধার প্রচেষ্টায় শেষে এসে থিতু হয়েছেন কালিকটের সমুদ্র তীরবর্তী এই অপরিসর দোকানে। এই দোকানই তার ধ্যান-জ্ঞান-সংসার।
তবে তিনি থিতু হলেও তার ভেতরের 'বুড়ো খোকা' এখনও থিতু হয়নি। ভেতরের সে দুরন্ত শিশু স্বপ্ন দেখে, একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবার নেমে সে নেমে পড়বে পথেপ্রান্তরে। যত যা দ্রষ্টব্য আছে আশেপাশে, সব দেখবে। মরভূমিতে বৃষ্টি দেখবে। পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে দুরন্ত অন্তিমকাল কাটাবে। কিন্তু 'বুড়ো খোকা'র সে স্বপ্ন সত্যি কবে হবে, করিম ক্কা নিজেও তা জানেন না। তবুও স্বপ্নকে আস্তিনে গুঁজে প্রতিদিন সকালে উঠেই তিনি ঢুকে পড়েন হেঁশেলে। মশলাপাতি, মাংস, দুধ, চাল আর নাম না জানা উপকরণ মিলিয়ে-মিশিয়ে 'বিরিয়ানি' নামের এক অমৃত তিনি তৈরী করেন। যে অমৃত'র জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকে কাছে-দূরের সবাই। এদের নিয়েই লতায়-পাতায়, আনন্দ-বিষাদে মিলেমিশে কাটে করিম ক্কা'র যাপিত জীবন।
করিম ক্কা'র কাছে একদিন আসে তার নাতি ফাইজি। ফাইজি, উচ্চাকাঙ্খী যুবক। সুইজারল্যান্ড থেকে 'শেফ' এর ডিগ্রি নিয়ে এসেছে সে। সুযোগ পেলেই বিদেশের কোনো রেস্তোরাঁয় যুক্ত হবে। কিন্তু তার বাবা চান না, ছেলে বাবুর্চি হোক। ফাইজির বাবা আবদুল রাজ্জাক বিত্তবান হওয়া সত্বেও সবাই তাকে 'বাবুর্চির ছেলে' বলে আড়ালে-আবডালে কটাক্ষ করে। তিনি চান না, তার ছেলের জীবনটাও এরকম হোক। তিনি ছেলেকে আটকাতে ছেলের পাসপোর্ট, টাকাপয়সা সব জিম্মি করেন। ফলাফলে ছেলেও বিদ্রোহী হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। চলে আসে তার দাদার কাছে। করিম ক্কা'র কাছে। উদ্দেশ্য- এখানে কিছুদিন থেকে, টাকাপয়সা জমিয়ে ও নতুন আরেকটি পাসপোর্ট বানিয়ে সে চলে যাবে বিদেশে। কিন্তু 'উস্তাদ হোটেল' এ এসে এবং 'মুসাফির' করিম ক্কা'র সংস্পর্শে থেকে ক্রমশই পালটে যায় ফাইজির জীবনের সমীকরণ। কিভাবে কি পালটায়, 'উস্তাদ হোটেল' এর ঝাল-ঝোল-অম্বলের অন্তরালে কিভাবে ফাইজির জীবন-স্রোত ক্রমাগত বইতে থাকে উল্টোদিকে, সেটাই খোলাসা হয় ধাপে ধাপে।

'উস্তাদ হোটেল' নিয়ে মুগ্ধতার অনেক উপকরণ আছে। কিন্তু প্রাথমিক মুগ্ধতা থিতু হয় গল্প বয়ানেই। গল্পের অনেকগুলো ধাপ। খানিকটা বিরিয়ানি রান্নার মতই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম একাধিক ধাপ। এখানে প্রেম আছে, বিচ্ছেদ আছে, হাসি আছে, বিষাদ আছে, জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি আবার জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণাও আছে। প্রশাসনের ষড়যন্ত্র আছে। প্রশাসনের ষড়যন্ত্র ভেস্তে দেয়াও আছে। অজস্র চলক। কিন্তু মুগ্ধতা এটাই, নির্মাত আনোয়ার রশীদ দারুণভাবেই সব উপাদান আনেন পরতে পরতে। সর্বোচ্চ সতর্কতায়। কোনোকিছু আরোপিত তো নয়ই, বরং ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এই উপকরণগুলোর মিশেল এতটা অনবদ্য, বিস্ময়াহত হওয়া ছাড়া নতুন কিছু বলার থাকেও না। পাশাপাশি চলে আসে গল্পের লেখিকা অঞ্জলি মেননের প্রসঙ্গও। বেঙ্গালোর ডেজ, কুডে, মাঞ্জাদিকুরুর মত দুর্দান্ত নির্মাণের সাথে যুক্ত এ মানুষটি 'উস্তাদ হোটেল'এও নিয়ে এসেছিলেন কী দুর্দান্ত এক গল্প, ভাবলে চমকে যেতে হয় ক্রমশ।
গল্পজনিত মুগ্ধতা কাটলেই সামনে প্রকট হয় ফাইজি ও করিম ক্কা'র রসায়ন। 'ফাইজি' চরিত্রে নবাগত দুলকার সালমান কিরকম অভিনয় করবেন, জানা ছিলো না। তবে ধারণা ছিলো, হয়তো ভালোই করবেন। কিন্তু বর্ষীয়ান অভিনেতা তিলাকান এর সাথে জীবনের দ্বিতীয় সিনেমাতেই তার যে এমন উপভোগ্য রসায়ন হবে, সেটা বোধহয় ছিলো ভাবনারও অতীত। অন্যদিকে, 'করিম ক্কা'রূপী তিলাকান তার মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ সিনেমায় যতক্ষণ পর্দায় রইলেন, সব আলো কেড়ে নিলেন একাই। মুগ্ধ হয়েই তার দিকে তাকিয়ে রইলাম পুরোটা সময়! একজন ক্যারিয়ার সবেমাত্র শুরু করেছেন, আরেকজন সমাপ্তিবিন্দুতে দাঁড়িয়ে, এই দুই মানু্ষ মিলে যে চমৎকারিত্বের মুখোমুখি করলেন, তা এত সহজে ভোলা কি সম্ভব হতো মোটেও? অবধারিতভাবেই উত্তরটি, না। পাশাপাশি বাকিরাও কী খারাপ অভিনয় করলেন? শাহানা-ফাইজির খুনসুটিতে নিথিয়া মেননের চরিত্র যেমন উপভোগ করলাম, 'উমর' চরিত্রে মামুকোয়াও কী কম হাসালেন? একদমই না।

'উস্তাদ হোটেল' এর সর্বেসর্বা যে মানুষটি, অর্থাৎ করিম ক্কা,তিনি বলতেন-
খাবার খাইয়ে পেট ভরাতে যে কেউই পারে। কিন্তু মন ভরানোর মত খাবার রান্না করতে সবাই পারে না। কিন্তু এটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
করিম ক্কা'র কথাকে আরেকটু ঘুরিয়ে বলাই যায়- সিনেমা তো সবাই বানাতে পারে, কিন্তু হৃদয় জয় করার মত সিনেমা কয়জন বানাতে পারে? যে সিনেমা শেষে এসে চোখে জল আনে, বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা তৈরি করে, সে সিনেমাকে শুধু 'সিনেমা' বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় অনেককিছুই। হালকা চালে জীবনের গূঢ় সত্য বলার যে কাজটি করে 'উস্তাদ হোটেল', ঠিক সেখানে এসেই এই চলচ্চিত্র 'কালোত্তীর্ণ নির্মাণ' এর খেতাব পেয়ে যায়। পাশাপাশি আক্ষেপও হয়। ব্যস্ততার ইঁদুর-দৌড়ে ছুটতে ছুটতে আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের অস্তিত্বও তো ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। অস্তিত্ব-সংকটের এই সময়ে আত্মশুদ্ধির জন্যে এক চিলতে 'উস্তাদ হোটেল' এর জন্যে আক্ষেপ তো হয়ই। পাশাপাশি জীবনে 'করিম ক্কা'র মতন একজন মুসাফির না থাকারও আক্ষেপও হয়। দীর্ঘশ্বাসে ক্লান্ত হই, এরকম কেউ কেন জীবনে এলো না! 'উস্তাদ হোটেল' এভাবেই চলতিপথে কিছু আক্ষেপ, কিছু বার্তা, কিছু দীর্ঘশ্বাস উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। হঠাৎই মন খারাপের সমুদ্রে টুপ করে ডুবিয়ে দেয়। আচমকা কবিয়াল নিতাইয়ের মত আক্ষেপে পুড়ি। যে আক্ষেপে মিশে থাকে ফিসফিস- হায়! জীবন এত ছোট কেনে!