
তাঁকে নিয়ে সৌমিত্র্য চট্টোপাধ্যায় বলতেন, 'ও যদি বিশাল কোন ক্রাইম করে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা হাসি দেয়, আমি ওকে ইনোসেন্ট ভাবতে বাধ্য হবো।'
মানুষটাকে বলা হয় দুই বাংলার চলচ্চিত্রজগতের সর্বকালের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। তিনি শুধু নায়ক নন, নায়কদেরও নায়ক, আর তাই তাঁর উপাধি 'মহানায়ক'। এ যাবত ইন্ডাস্ট্রিতে যত নায়ক এসেছেন, অভিনেতা জন্মেছেন, সবাই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে তাঁর মতো হতে চেয়েছেন, তাঁকে অনুসরণ করতে চেয়েছেন। মহানায়ক শব্দটার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো অনেকে বুঝে গিয়েছেন, কাকে নিয়ে কথা বলছি। হ্যাঁ, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রজগতে এসে যিনি হয়ে গিয়েছিলেন উত্তম কুমার, তাঁকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম হয়েছিল শতাব্দীর সেরা হবার জন্যে, তিনি এসেছিলেন ইতিহাস রচনা করতে, স্রষ্টা তাঁকে পাঠিয়েছিলেন অভিনয়ের জগতে অন্যরকম একটা যুগের সৃষ্টি করার জন্যে। তাঁর তো মঞ্চে থেমে থাকার কথা ছিল না। দিনে চাকরী করতেন, আর রাতে থিয়েটার। সিনেমায় নামার ইচ্ছেটা মাথায় ভর করছিল অনেকদিন ধরেই, স্বপ্নের পরিধিটা বাড়ছিল কেবল। কিন্ত সিনেমায় অভিনয় করার মতো কিছুই তো নেই অরুণের। না কোন অভিজ্ঞতা, না বাবা-চাচাদের আশীর্বাদ, ছিল না আহামরি কোন পারদর্শীতাও, সম্বল শুধু ঈশ্বরপ্রদত্ত সুন্দর চেহারাটুকু। সেকালে সিনেমায় অভিনয় করতে হলে গান জানাটা ছিল আবশ্যিক কাজ। তিনি তাই কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীতশিক্ষক নিদান ব্যানার্জীর কাছে যাওয়া শুরু করলেন, গ্রহণ করলেন তাঁর শিষ্যত্ব।
ভারতলক্ষী স্টুডিওতে গিয়েছিলেন একদিন, সেখানে 'মায়াডোর' নামের এক হিন্দি সিনেমার শুটিং চলছিল তখন। দারোয়ান ঢুকতে দিলো না তাঁকে! পরে পরিচিত এক নাট্যকারের পরিচয় দিয়ে ঢোকার সুযোগ হলো। ছোট্ট একটা চরিত্র, নতুন বর হয়ে মার খাবার দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলো, সেই বছরই অরুণকুমার নাম লেখালেন সিনেমায়। কিন্ত সেই সিনেমা আর আলোর মুখ দেখেনি কখনও। 'মায়াডোরে' কাজ করে দৈনিক একটাকা চার আনা পারিশ্রমিক পেতেন তিনি। এক্সট্রা হিসেবেই ফিল্মি দুনিয়ায় যাত্রা শুরু হলো তাঁর।

পরের বছর দৃষ্টিদান সিনেমায় অভিনয় করলেন তিনি, কিন্ত এবারও নায়ক নয়, নায়কের কিশোর বয়সের চরিত্রে অভিনয় করতে হয় তাঁকে। ১৯৪৯ সালে নায়ক হলেন তিনি, সিনেমার নাম 'কামনা'। সেই ছবি ফ্লপ। সেটি নিয়ে মোট আট বছরে আটটা সিনেমায় দেখা গেল তাঁকে, সবগুলোই ব্যাবসায়িকভাবে ব্যর্থ। সিনেমাপাড়ায় তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ফ্লপমাস্টার! নিজেও আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু করতে পারবেন, এমন ভরসাটা মন থেকে উবে যাচ্ছিল দ্রুত।
সিনেমা করে পোষাচ্ছিল না, চাকুরীও করতেন সংসার চালানোর জন্যে। ততোদিনে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন গৌরী গাঙ্গুলীকে। নিজেই ঠিক করলেন, সব ছেড়েছুড়ে অভিনয়ে মন দেবেন, দুই নৌকায় পা দিয়ে কোনদিকেই সাফল্য পাবেন না, এটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। 'বসু পরিবার' সিনেমা দিয়ে সাফল্যের মুখ দেখলেন, এরপরে এলো 'সাড়ে চুয়াত্তর'। সেই সিনেমা দিয়েই ইতিহাস রচনার শুরুটা হলো, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর কিংবদন্তী জুটির পথচলা সেই সাড়ে চুয়াত্তর দিয়েই। সিনেমায় নেমে নিজের নাম বদলে উত্তমকুমার রেখেছিলেন অরুণ, সবার চাইতে অনন্য, সবার চেয়ে 'উত্তম' হবার জন্যেই ইন্ডাস্ট্রীতে তাঁর আগমন, নামকরণেও কি কাকতালীয় এক মিল!
ষাটের দশকটা পুরোপুরিই উত্তম-সুচিত্রার। একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়ে গিয়েছে এই জুটি, হারানো সুর, অগ্নিপরীক্ষা, পথে হলো দেরী, সপ্তপদী, বিপাশা, চাওয়াপাওয়া, জীবনতৃষ্ণা, সাগরিকা- প্রত্যেকটি সিনেমা জয় করেছে দর্শকের মন, হাসি ফুটিয়েছে হল মালিকের মুখে, একাউন্ট ভারী করেছে প্রযোজকের। হারানো সুরের প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই। প্রতিটা সিনেমার ভিন্নরকম গল্প, ভিন্নধর্মী উপস্থাপন আর দুজনের রসায়ন এইসব সিনেমাকে দিয়েছিল অন্যরকম একটা মাত্রা।

ষাট বছর পরে এসেও এই জুটির সিনেমাগুলোর আবেদন কমেনি এতটুকুও, এখনও রোমান্টিক জুটির কথা এলেই প্রথমে উচ্চারিত হয় উত্তম-সুচিত্রার নাম, বাকীদের সিরিয়াল শুরু হয় দুই থেকে।
সপ্তপদী সিনেমার 'এই পথ যদি না শেষ হয়' গানটা হৃদয়ে আলোড়ন তোলেনি, এমন প্রেমিক এই দ্বাবিংশ শতাব্দীতেও পাওয়া যাবে না। অন্যান্য নায়িকাদের সঙ্গেও সিনেমা করেছেন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের চেয়েও বেশী সিনেমায় জুটিবদ্ধ হয়েছেন অন্য কোন নায়িকার সঙ্গে। কিন্ত উত্তম-সুচিত্রা জুটির কাছাকাছিও যেতে পারেনি সেসব, পারেনি দর্শকমনে আলোড়ন তুলতে।
তবে পর্দার রোমান্টিক নায়কের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কগুলো খুব একটা সুখের ছিল না, ১৯৬২ সালে বিবাহবিচ্ছেদ করেন স্ত্রীর সঙ্গে, অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের সম্পর্ক তখন টালিগঞ্জের হট টপিক, মিডিয়ার কাছে আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। জীবনের বাকী সময়টা সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই কাটিয়েছিলেন মহানায়ক।
বঙ্গ ছেড়ে বোম্বেতেও পাড়ি জমিয়েছিলেন মহানায়ক, অভিনয় করেছিলেন কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও, এদের মধ্যে 'ছোটি সি মুলাকাত', 'অমানুষ' এবং 'আনন্দ আশ্রম' অন্যতম। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র 'ব্যোমকেশ বক্সী' সেজে হাজির হয়েছিলেন সেলুলয়েডের পর্দায়। নিজের অভিনয়প্রতিভা নিয়ে পরীক্ষানীরিক্ষা করেছেন, রোমান্টিক ইমেজ ভাঙার জন্যে কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে, মিউজিক্যাল জার্নি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ব্যবসায়িকভাবে সফল হবে না জেনেও নাম লিখিয়েছিলেন এই প্রোজেক্টে, কারণ তিনি নিজের ভেতর থেকে সুপারস্টার উত্তমকুমারকে ভেঙে অভিনেতা উত্তম কুমারকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন, আর সেই পরীক্ষায় তিনি শতভাগ সফল।
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর অভিনীত 'হারানো সুর' সিনেমাটি প্রশংসিত হয়েছিল পুরো ভারতজুড়ে, পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির 'সার্টিফিকেট অব মেরিটে'র সম্মান!
বাংলা সিনেমার আরেক কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘নায়ক’ ও ' চিড়িয়াখানা' ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন এই সুঅভিনেতা। ডিটেকটিভ চরিত্রে শক্তপোক্ত টাইপের অভিনেতাই নেয়া হয়, কিন্ত চিড়িয়াখানায় রোমান্টিক ইমেজের উত্তমকে কেন নিয়েছিলেন সত্যজিৎ? খুঁজলে একটাই জবাব পাওয়া যায়, উত্তমের 'উত্তম' অভিনয়ের কারণে। এছাড়াও 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' সিনেমায় অভিনয়ের জন্যও জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন উত্তম। নিউইয়র্ক, বার্লিন চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবের অতিথির সম্মানও অর্জন করেছিলেন তিনি।

পুরষ্কার অনেক পেয়েছেন উত্তম কুমার, কিন্ত সমসাময়িক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের দর্শকের মনে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি নিজের অভিনয় নিয়ে, সেটা আর কোন বাঙালী অভিনেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর হাসি, তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গি, তাঁর বুকচাপা ভালোবাসা দর্শকমনে আলোড়ন তুলেছে বারবার, তাঁর অসাধারণ পুরুষালী সৌন্দর্য্যে ডুবেছেন তরুণী থেকে মধ্যবয়স্কা, ঈর্ষায় পুড়েছেন সমসাময়িক অভিনেতা থেকে সেসময়ের তাবত পুরুষ সমাজ!
টালিগঞ্জে উত্তমের চেয়ে ভালো অনেক অভিনেতা এসেছেন, হারিয়েও গিয়েছেন। উত্তম হারাননি, ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস থেকে তো নয়ই, দর্শকমন থেকেও নয়। কাজ করে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি বলতেন- "আমার কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে যদি কখনও কোনো মৃত্যু সংবাদ আসে, আমি কিছুটা থমকে যাই। আবার আমি আমাকে বোঝাই- মৃত্যুই তো একমাত্র সত্য।" নিজের জীবনেও সেটাই ঘটলো।
'ওগো বধু সুন্দরী' সিনেমার কাজ চলছিল তখন, শেষ লটের শুটিং, সেদিনই শেষ হবার কথা। সিনেমার সেটেই শুটিংরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর, সবকিছু ছেড়ে যে অভিনয়কে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলেন তিনি, সেই অভিনয় করতে করতেই জীবন নামের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে গেলেন এই অভিনেতা। মহানায়কের প্রয়াণ হলো, দিনটা ছিল চব্বিশে জুলাই, সাল ১৯৮০। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে নিভে গিয়েছিল এই গুণী অভিনেতার জীবনপ্রদীপ!
প্রশংসায় লজ্জা পেতেন খুব, বিশেষ করে তাঁর সামনে কেউ তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করলে একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে যেতেন তিনি। বলতেন- "প্রশংসা করলে আমি কাঁচুমাচু হয়ে যাই। কারণ আমি ভাবি, এ প্রশংসা টিকে থাকবে তো? আর তাই প্রশংসাবাক্য শুনলে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমি ওটা চাই না, আমি শুধু কাজটাই বুঝি।"
কাজটাই সবচেয়ে ভালো বুঝতেন, সেটে দেরী করে আসার দুর্নাম ছিল না খুব একটা, কোন পরিচালককে কথা দিয়ে শিডিউল ফাঁসিয়েছেন, এমন অভিযোগও ওঠেনি তাঁর বিরুদ্ধে। অথচ প্রায় আড়াই যুগ ধরে তিনিই ছিলেন নিজের ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় সুপারস্টার।
যে অভিনয় তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, পরিচয় দিয়েছে, সেই অভিনয় ব্যপারটাকে ভীষণ সম্মান করতেন তিনি। একটানা অভিনয় করতে কোন আপত্তি ছিল না উত্তমের, তাঁর ভাষায়- "কাজকে আমি কখনও ভয় করি না। বরং আমি কাজ থেকে আনন্দ খুঁজে নিই।" চলচ্চিত্রের এই জগতটা তাঁকে মধ্যবিত্ত ঘরের ছাপোষা এক চাকুরে থেকে উত্তম কুমার বানিয়েছে, তিনিও নিজের জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলেন অভিনয়কেই। বলতেন- "চলচ্চিত্র আমার নিজস্ব জগৎ, আমার ব্যক্তিগত বলে কিছু ছিল না। যেন আমার প্রতিটি মুহূর্ত বিক্রি হয়ে গেছে।"
উত্তম কুমার আসলে লিখে শেষ করার মতো কোন মানুষ নন। একটা আর্টিকেল, আটশো-এক হাজার শব্দে আর যাই হোক, উত্তম কুমার মানুষটাকে ধারণ করা যায় না, সেটা সম্ভবও নয়। উত্তম কুমার বিশাল ক্যানভাসের মানুষ, আমাদের মতো চুনোপুটিরা তাঁকে নিয়ে দু-চার শব্দ লিখতে পারে বড়জোর, এর বেশী কিছু নয়।
দুই বাংলা মিলিয়ে লাখো মানুষের কাছে নায়ক শব্দটার মানেই উত্তম কুমার, সিনেমার পর্দায় হিরো বলতে তারা এই হ্যান্ডসাম মানুষটাকেই বোঝেন। টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সেই জন্মলগ্ন থেকে অনেক নায়ক পেয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ দারুণ অভিনেতাও ছিলেন, অনেকেই ছিলেন দারুণ স্মার্টও। কিন্ত উত্তম কুমারের মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য্য আর প্রতিভার এমন অসাধারণ সমন্বয় টালিগঞ্জে দ্বিতীয় কেউ আসেননি, আর কেউ আসবেনও না।
চল্লিশ বছরে একটা উত্তম কুমারের জন্ম হলো না, একশো বছরেও হবে না হয়তো। উত্তম কুমারেরা এক ও অদ্বিতীয়, তাঁরা একবারই আসেন, সেই একটা জন্মের কীর্তিতেই অমর হয়ে থাকেন শত শত বছর।