কোনো কিছু নিয়ে ট্রল করতে হলেও আগে সে বিষয়ে সম্যক পড়াশোনা থাকা উচিত। নাহলে পুরো বিষয়টিই খুব অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। যেটা হচ্ছে এখন। কুরুচিপূর্ণ ছবি, কথাবার্তা আর মিথ্যাচার জড়িয়ে কদর্য সব অপপ্রচারই যেন চলছে প্রাক্তন সালমান-ক্যাট জুটি নিয়ে। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তো এটাই, কে কার সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে কিংবা কার সাথে কার সম্পর্ক ভাঙ্গছে, সেসব বিষয়ের মধ্যিখানে আমরা কেন আমাদের নাক ঢুকিয়ে দিচ্ছি বারবার?
জীবন অদ্ভুত এক মঞ্চ। এ মঞ্চের প্রত্যেকটা নতুন দিনই বইয়ের আনকোরা পৃষ্ঠা। নিয়মিত সময় পালটায় এখানে। সম্পর্ক পালটায়। বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা...পালটায় সবই। দায়িত্ব, দায়িত্বহীনতা, প্রণয়ের উচ্ছ্বাস, প্রণয়ঘটিত বিষাদ, আস্থা কিংবা আস্থাহীনতা... গড়পড়তা প্রত্যেক মানুষ এসব নিয়ে নিয়মিত লড়াই করে। লড়াই করা স্বাভাবিকও। তবে পাশাপাশি সভ্যতা এটাই, মানুষের এসব লড়াইকে সম্মান করা। এসব বিষয় নিয়ে কড়চা না করা। অথচ আমাদের চারপাশে সে জিনিসটিই হয় বেশি। মানুষজন কেন যেন অন্যকে নিয়ে যাপিত নিন্দা ও চর্চায় অমোঘ সুখ পান। বিশেষ করে সে মানুষেরা যদি পাবলিক ফিগার হয়, তাহলে তো কথাই নেই! জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! অথচ আমাদের চারপাশে এমন সব মানুষকেই আমরা নিয়মিত দেখি, যারা অন্যের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে তীব্র হর্ষবোধ করেন, বিমলানন্দ পান। হৃদযন্ত্র-খোঁড়াখুঁড়ি নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন পুরোটা সময়।
বাংলায় একটা কথা বোধকরি সবাই শুনেছি আমরা- যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই। সেটাই যেন সম্প্রতি বেশ ভয়ঙ্করভাবে উপলব্ধি করলাম বলিউডের ক্যাটরিনা কাইফ ও ভিকি কৌশলের বিয়েকে কেন্দ্র করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র যারা আছে, তারা মাঝেমধ্যেই সামাজিক নানা সমস্যার খবর তাদের পত্রিকায় ছাপাতে ভুলে গেলেও ছাপাতে ভোলেননি ক্যাট-ভিকির বিয়ের মেন্যুকার্ডের ছবি। এ দম্পতি বিয়ের দিন কী পরবেন, কী খাবেন, কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, বিয়ে কখন হবে, কিভাবে হবে...হেন কোনো বিষয় নেই যা এসব সংবাদপত্রে দোর্দণ্ডপ্রতাপে লিপিবদ্ধ হয়নি। সংবাদপত্রের এ আদেখলেপনা দেখে মাঝে মাঝে মনেই হচ্ছিলো, এ কমলালেবু গোলকে বোধহয় প্রথমবারের মতন কোনো বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেটার কোনো আপডেট মিস দেয়া যাবেনা একতিলও।
আসি সামাজিক মাধ্যমে। সামাজিক মাধ্যম এমনিতেও বর্তমানে ক্রমবর্ধমান এক ভাগাড়। সে ভাগাড় যেভাবে সয়লাব হয়েছে দুই তারকার এ বিয়েকে কেন্দ্র করে, তাতে রীতিমতো চমকে উঠেছি ক্ষণে ক্ষণে। কেউ ক্যাটরিনাকে নিয়ে, কেউ ভিকিকে নিয়ে আবেগঘন লেখা লিখছেন। কেউ আবার এই দম্পতির শয্যাদৃশ্য কল্পনা করে যৌনকাতর হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার এসবের উর্ধ্বে৷ তারা যাপিত সবকিছু বাদ দিয়ে কথা বলছেন সালমান খান কে নিয়ে। সালমান-ক্যাটের প্রাক্তন সম্পর্ককে উসকে দিয়ে হাসিঠাট্টার মোচ্ছবে ফেটে পড়ছেন তারা। খুব অসুস্থভাবেই আক্রমণ করা হচ্ছে সালমান খানকে, পুরোনো সে সময়কে!
অথচ, ভিকি-ক্যাটের বিয়েতে সালমান খান কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় হওয়ার কথা ছিলো না মোটেও। হ্যাঁ, তাদের সম্পর্ক নিয়ে একসময়ে নিয়মিত কড়চা হয়েছে বলিউডে। সে তো দীপিকার সাথে রনবীর কাপুরের প্রণয় নিয়েও হয়েছে। মনীষা কৈরালার সাথে নানা পাটেকরের সম্পর্ক ছিলো সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এক বিষয়। রেখার সাথে অমিতাভ বচ্চনের সম্পর্ক নিয়ে আজও কথা হয়। একজনের সাথে সম্পর্ক হওয়া, সে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া, পরবর্তীতে অন্য কারো সাথে গাঁটছড়া বাঁধা...এসব নতুন কিছু না। অস্বাভাবিকও না৷ কিন্তু ক্যাটরিনার সাথে সালমানের পুরোনো সম্পর্ক নিয়ে যেভাবে জলঘোলা করেছে বিশেষ এ প্রাণীরা, যেভাবে অসুস্থ রুচির ট্রল হচ্ছে এ সম্পর্ককে জড়িয়ে, আপত্তি সেখানেই। হালকা হাসিঠাট্টা সবকিছু নিয়েই করা যায়। কিন্তু সবকিছুরই এক সীমা থাকে। সে সীমা অতিক্রম করলেই সভ্যতা। এক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে বহুদূরে গিয়ে চলছে একের পর এক খিস্তিখেউড়!
এটা সত্যি, বলিউডের এই জুটিকে নিয়ে সময়ের নানা প্রকোষ্ঠে নানারকম কথাবার্তাই হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই, তাদের মধ্যে যখন সম্পর্ক ছিলো, তখনও তারা একজন অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যখন সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে, তখনও সেই পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা বজায় ছিলো পুরোপুরি। গুজব রটেছিলো, 'ম্যায়নে পেয়ার কিউ কিয়া'র সেট থেকেই সালমান ও ক্যাটরিনার মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হয়৷ এরপর প্রণয়। ক্যাটরিনার সমস্ত উত্থানপতনেই তার সাথে ছিলেন সালমান। সালমান খান দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্যাটরিনার ক্যারিয়ারেরও। সঞ্জয় লীলা বানসালিই বলি কিংবা সাজিদ নাদিরওয়ালা...তাদের সাথে ক্যাটরিনার প্রথম পরিচয় সালমান খানের সূত্রেই।
এখানেই শেষ না। সালমান খানের হোম প্রজেক্ট 'ভারত' কিংবা 'এক থা টাইগার ফ্রাঞ্চাইজি'তে বরাবরই ছিলেন ক্যাটরিনা৷ এবং ক্যাটরিনার ক্যারিয়ারে এই সিনেমাগুলোর প্রভাব কতটা বেশি, তা কমবেশি সবাই-ই জানেন৷ সালমান খানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পরে রনবীর কাপুরের সাথে যখন মন দেয়া-নেয়া চলছিলো ক্যাটরিনার, সে সময়ে সালমান বেশ ভেঙ্গে পড়লেও, পরবর্তীতে যখন রনবীরের সাথে ক্যাটরিনার ব্রেকআপ হয়েছে, সালমান খানই সবার আগে ছুটে গিয়েছিলেন। সাহস দিয়েছিলেন। মেন্টর হয়ে গাইড করেছিলেন। এভাবেই ক্রমশ সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে তাদের সম্পর্ক 'প্রেমিক-প্রেমিকা'র গণ্ডি থেকে বের হয়ে রূপান্তরিত হয়েছিলো জমাট ও নিখাদ বন্ধুত্বে। যে বন্ধুত্ব নিয়ে দুইজনই খুশি, সন্তুষ্ট।
সত্যভাষণ এটাই। কোনো কিছু নিয়ে ট্রল করতে হলেও আগে সে বিষয়ে সম্যক পড়াশোনা থাকা উচিত। নাহলে পুরো বিষয়টিই খুব অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। যেটা হচ্ছে এখন। কুরুচিপূর্ণ ছবি, কথাবার্তা আর মিথ্যাচার জড়িয়ে কদর্য সব অপপ্রচারই যেন চলছে প্রাক্তন এ জুটি নিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা তো এটাই, কে কার সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে কিংবা কার সাথে কার সম্পর্ক ভাঙ্গছে, সেসব বিষয়ের মধ্যিখানে আমরা কেন আমাদের নাক ঢুকিয়ে দিচ্ছি বারবার? কেন উঁকি দিয়ে অন্যের ঘর দেখে বিস্তর সমালোচনায় আমরা যারপরনাই প্রশান্তি পাচ্ছি? কেন আমরা এত নিন্দামুখর হয়ে পড়েছি? কেন আমরা মানুষকে খুঁচিয়ে সুখের সাগরে ভাসি? নিজেদের জীবনে কিছু নেই বলেই কী এভাবে অন্যের জীবনের পরজীবী হয়ে আমরা বেঁচে থাকি?