'স্টার কিড' তকমাকে স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করে আর পাঁচজন উঠতি অভিনেতার মতন একের পর এক অডিশন দিয়েছেন ভিকি৷ অডিশনের পর কেউ কাজ করতে ডেকেছে। কেউ ডাকেনি। চোখের সামনে ভালো অভিনেতাদের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে নিজের দূর্বলতা নিয়ে শঙ্কিত হয়েছেন৷ অস্তিত্ব-সংকটেও ভুগেছেন৷ কিন্তু থেমে থাকেন নি। নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে সেগুলো নিয়ে বারবার কাজ করেছেন...

'মাসান' এর দীপক কে মনে পড়ে? সদ্য সদ্য প্রেমে পড়া 'দীপক' নামের সেই যে তরুণ, যার চোখ-মুখ জুড়ে প্রথম প্রেমের ডগমগে আনন্দ অথবা প্রেম ক্ষয়ে যাওয়ার পরে চেহারাজুড়ে থমথমে গাঢ় বিষাদ, যে আনন্দ এবং বিষাদের সাক্ষী ছিলাম আমরা অনেকেই, মনে আছে তাকে? অবশ্য মনে থাকবেও না বা কেন? এরকম চরিত্রকে ভুলে যাওয়াও তো বড্ড শক্ত কাজ। যারা 'মাসান' দেখেছেন তাদের অভ্যন্তরীন কলকব্জায় আর কোনো চরিত্র দাগ কাটুক অথবা না কাটুক, 'দীপক' যে সবার হৃদযন্ত্রের ঠিক মধ্যিখানে অদ্ভুত এক ক্ষত তৈরী করেছিলো, তাতে তো সন্দেহও নেই একরত্তি। এই 'দীপক' চরিত্রকে পর্দায় অমরত্ব দিয়েছিলো যে ভিকি কৌশল, তিনি এই সিনেমা দিয়েই প্রথমবার বুঝিয়েছিলেন- কেন তিনি উদীয়মান অনেক অভিনেতার থেকে আলাদা! এই এক সিনেমা দিয়েই যেন তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন- স্রোতে গা ভাসাতে না, বরং ভিন্ন স্রোত তৈরী করতেই এসেছেন তিনি! 

'মাসান' এর দীপক! 

ভিকি কৌশলের অভিনয়শৈলী নিয়ে মুগ্ধতা আরো কয়েকগুন বেড়েছিলো 'সরদার উধম' দেখার পরে। সুজিত সরকারের এ সিনেমা এমনিতেই সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স এর দুর্দান্ত এক উদাহরণ। কনসেপ্ট, স্ক্রিনপ্লে কিংবা টেকনিকাল সাউন্ডনেস... কোনো বিভাগেই খুঁত ধরার জায়গা ছিলো না মোটেও। একটা সিনেমায় এত এত ভালো দিক থাকা সত্বেও তা উপেক্ষা করে শেষমেশ ভিকি কৌশলেই মুগ্ধ হতে হয়েছে আবার। 'উধম সিং' চরিত্রে যেভাবে নিজের জানপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন ভিকি, তা যারা সিনেমাটি দেখেছেন, তারাই বুঝতে পারবেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ এর ম্যাসাকার দেখে বাকরুদ্ধ এক কিশোর থেকে মাইকেল ও ডয়ার'কে খুন করা এক দুর্ধর্ষ বিপ্লবী...চরিত্রের ডাইমেনশন বুঝে যেভাবে বিভিন্ন শেডে সম্পূর্ণ আলাদা অভিনয় করেছে ভিকি... অনবদ্য। স্রেফ অনবদ্য। 

'সরদার উধম'এ মুগ্ধ করেছেন তিনি! 

আশ্চর্যজনক বিষয়, বলিউডের বিখ্যাত স্টান্ট ডিরেক্টর শ্যাম কৌশল হচ্ছেন ভিকি কৌশলের বাবা। ভিকি চাইলে খুব সহজেই বাবার জনপ্রিয়তাকে নিজের ক্যারিয়ার-গ্রাফের উন্নয়নে ব্যবহার করতেই পারতেন। বলিউডের স্টার কিডরা যে পন্থায় বাকিসব অভিনেতাদের চেয়ে ঢের তাড়াতাড়ি সাফল্য-সুনাম-জনপ্রিয়তা পান, তা নিয়ে আবহমান সময় ধরেই বিস্তর হাপিত্যেশ আছে বি-টাউনে। কিন্তু এই হাপিত্যেশ ভিকি কৌশলের কাছে এসে বারবারই গোত্তা খেয়ে পড়েছে। স্টার কিড হওয়া সত্বেও নিজের ক্যারিয়ারের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন৷ একেবারে 'শূন্য' থেকেই শুরু করেছেন সব। 'বাবা'কে সজ্ঞানে আড়াল করেই শুরু করেছেন যাত্রা। 

সিনেমাকে ভালো করে বুঝতে চাইলে ক্যামেরার পেছনের জগৎ বুঝতে হয় আগে। সে কারণেই পর্দার সামনে অভিষেক হওয়ার আগে ভিকি কৌশলের অভিষেক হয় পর্দার পেছনে। অনুরাগ কাশ্যপের কাল্ট ক্ল্যাসিক 'গ্যাংস অব ওয়াসিপুর' এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে থেকে যেন বুঝে নিতে চেয়েছিলেন সিনেমার সাত-সতেরো। সে উদ্দেশ্যেই লেগে থাকা কাশ্যপের সাথে। লেগে থেকে লাভও হলো। ক্যামেরার কাজ শিখে নিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে সফলভাবেই শেষ করলেন দায়িত্ব। ততদিনে অনুরাগ কাশ্যপ হয়ে গিয়েছেন তার মেন্টর। পরবর্তীতে মেন্টর কাশ্যপের দুই নির্মাণ (লাভ সাব দে চিকেন খুরানা, বোম্বে ভেলভেট) এ ছোটখাটো রোলে সাহস করে দাঁড়িয়ে গেলেন ক্যামেরার সামনে। যেন বড়সড় কোনো ধামাকার আগে হাত পাকিয়ে নিলেন খানিকটা। এরপরই মাসান। দীপক হয়ে হৃদয়-কাঁপানো অভিনয়। দর্শকের অন্দরমহলে ঢুকে যাওয়া। যদিও 'দীপক' চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব প্রথমে দেয়া হয়েছিলো রাজকুমার রাও কে। রাজকুমার রাও 'না' করার ফলেই এই চরিত্রটি পায় ভিকি। এবং বাকিটা বলাই বাহুল্য। 

এরপর কাজ করেছেন বহু। 'উরিঃ দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' এ প্রোটাগনিস্ট রোলে দুর্দান্ত অভিনয় করে যেমন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, তেমনি রাজি, সঞ্জু, লাস্ট স্টোরিজ এর মতন নির্মাণে সহশিল্পী হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেছেন৷ ভিকি কৌশলের এ গুণটি বেশ স্বকীয়। তিনি যখন কোনো নির্মাণের লিড রোলে থাকছেন, সেখানে যেমন খুব দারুণ অভিনয় করছেন। তেমনি লিড রোলে না থেকে সাপোর্টিং রোলে থাকলেও দুর্দান্তভাবেই খাপ খেয়ে যাচ্ছেন চরিত্রের সাথে। অভিনয়ের প্রতি একনিষ্ঠ নিষ্ঠা ও চরিত্র নিয়ে গভীর অধ্যবসায় ছাড়া এই অসাধ্যসাধন করা যে মোটেও সম্ভব না, সে নিয়ে সন্দেহ তো নেই মোটেও। তবে আশ্চর্য এটাই, এই দুরুহ কাজটিই দিনের পর দিন অবলীলায় করে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন ভিকি কৌশল। 

'উরিঃ দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' এর মেজর শেরগিল! 

'স্টার কিড' এর তকমা কে স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করে আর পাঁচজন উঠতি অভিনেতার মতন একের পর এক অডিশন দিয়েছেন৷ অডিশনের পর কেউ কাজ করতে ডেকেছে। কেউ ডাকেনি। চোখের সামনে ভালো অভিনেতাদের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে নিজের দূর্বলতা নিয়ে শঙ্কিত হয়েছেন৷ অস্তিত্ব-সংকটেও ভুগেছেন৷ কিন্তু থেমে থাকেন নি। নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে সেগুলো নিয়ে বারবার কাজ করেছেন৷ অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। 'যে সহে, সে রহে' নীতি মেনে সহ্য করেছেন আঘাত। সে আঘাত কখনো পরাজয়ের, কখনো প্রত্যাখানের, কখনো স্বপ্নভঙ্গের। হোঁচট খেয়েছেন৷ উঠে দাঁড়িয়েছেন৷ এসব নিয়ে লুকোছাপা নেই তার। অকপটেই স্বীকার করেন-

আমি যদি ১০ টা অডিশনে সফল হই, মানুষ তা নিয়ে কথা বলে। ঈর্ষা করে। কিন্তু এই ১০টা অডিশনের আগে আমি যে ১০০০ টা অডিশনে ব্যর্থ হয়েছি, তা নিয়ে মানুষ অতটা জানে না। জানার আগ্রহও দেখায় না। অথচ এটাই জানা উচিত। কিভাবে আস্তে আস্তে হোঁচট খেতে খেতে উঠে দাঁড়িয়েছি, সেটাই জানা উচিত আগে। 

এই গুণী অভিনেতার হাতে এখন দারুণ সব কাজ। কমেডি ড্রামা থেকে পিরিয়ড ফিল্ম কিংবা বায়োগ্রাফি... বিভিন্ন জনরার নির্মাণে খ্যাতনামা সব পরিচালকের সাথে সংযুক্ত তিনি। তিনি যেভাবে শুরু করেছেন যাত্রা, তাতে আশা করা যায়, গতানুগতিক গিমিকের পথে তিনি হাঁটবেন না। সমসাময়িক স্রোতে গা ভাসিয়ে রাতারাতি সফল হওয়ার মানসিকতাকে বর্জন করে যেভাবে তিলে তিলে পায়ের নীচের মাটিটুকু শক্ত করেছেন ভিকি কৌশল, তাতে এ বিষয় তো পরিষ্কার- এত সহজে এই মঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছেন না তিনি। তবে গুরুত্বপূর্ণ এটাও, মঞ্চকে কিভাবে ব্যবহার করবেন তিনি। দীপক, উধম কিংবা মেজর শেরগিল এর মতন দাগকাটা চরিত্রের বাহক হয়ে যেভাবে দর্শকের  আস্থা অর্জন করেছেন তিনি, সে আস্থা সামনে আরো বাড়বে নাকি জনপ্রিয়তার মোহে ক্রমশই স্থানু হয়ে যাবেন তিনি, তা সময়ের হাতেই ন্যস্ত। আপাতত শুভকামনা ও গুণমুগ্ধ প্রশংসা জানিয়েই টানা যাক ইতি৷ 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা