তিনি সময়মত সেটে আসেন, কাজ শেষেই উধাও। থাকেন না কোনো প্রমোশনে, কারণ সিনেমা বেচা তার কাজ নয়। তার ভালো একটা ইন্টারভিউ পাওয়া যায় না ইউটিউবে, এমনকি উইকিপিডিয়া পেজটাও অসম্পূর্ণ!

আন্ডাররেটেড এবং ওভাররেটেড- এই শব্দ দুটো অভিনেতাদের বেলায় ব্যবহার হয় খুব। ভালো অভিনেতা, কিন্ত তার মেধা অনুযায়ী চরিত্র পাচ্ছেন না, একটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নির্দিষ্ট কারো প্রতিভাকে ব্যবহার করতে পারছে না ঠিকভাবে- এরকম অভিনেতা বিশ্বের অনেক দেশে আছেন, সংখ্যায় তারা কম হলেও, একেবারে হাতেগোনা নন। তবে 'ক্রিমিনালি আন্ডাররেটেড' টার্মটা খুব বেশি অভিনেতার ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে দেখবেন না। বিজয় রাজ সেই দুর্লভ ক্যাটাগরির সামান্য কিছু অভিনেতার মধ্যে একজন। 

অভিনেতার পরীক্ষা নাকি হয় ছোট আর অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সামান্য স্ক্রিনটাইমের মধ্যে কতটা দাগ কেটে যেতে পারলেন, মনে রাখার মতো কতখানি স্মৃতি তৈরী করতে পারলেন- সেটা ভীষণ ইম্পর্টেন্ট একটা প্যারামিটার। বিজয় রাজ এই জায়গায় চ্যাম্পিয়ন। ধামাল সিনেমায় তার রোলের স্ক্রিনটাইম হবে বড়জোর ৫-৬ মিনিট। এরইমধ্যে পর্দায় তিনি তুফান এনে দিয়েছেন। যেটুকু সময় তিনি স্ক্রিনে ছিলেন, হাসির বন্যা বয়ে গেছে। তার একেকটা সংলাপ, এক্সপ্রেশন, লুফে নিয়েছে দর্শক। অসাধারণ কমিক টাইমিংয়ে বাজীমাত করেছেন তিনি। ধামাল মুক্তি পেয়েছিল তেরো বছর আগে, এখনও সিনেমাটার কথা ভাবলে সবার আগে বিজয় রাজের ওই কন্ট্রোলরুম থেকে দেয়া সংলাপ আর সিকোয়েন্সগুলোর কথাই মনে পড়ে।

শখের বশে অভিনেতা হতে চেয়েছিলে। সেটাই যে নেশায় পরিণত হবে, পেশাও হয়ে যাবে, তা জানা ছিল না। জন্ম উত্তরপ্রদেশের এলাহবাদে, বাবার চাকরিসূত্রে বড় হয়েছেন দিল্লিতে। অভিনয়ের হাতেখড়ি দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায়। দশ বছর থিয়েটার করেছেন। পরিবারের কোথাও অভিনয়ের আবহটা ছিল না, সিনেমাপ্রেমী কেউ ছিল বলেও জানা নেই কারো। তবু বিজয় রাজ অভিনয়ের প্রেমে পড়লেন। মঞ্চে উঠলে আরেকটা চরিত্রের ভেতর ঢুকে যেতেন পুরোপুরি। হয়তো নিজের তখনকার স্বত্বাটাকে পছন্দ হতো না তার, অন্য একটা স্বত্বা হয়ে বাঁচার ইচ্ছেটাই অভিনয়ের সঙ্গে তার প্রেমের কারণ ছিল। 

অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহও দিল্লি এনএসডির গ্র‍্যাজুয়েট ছিলেন। একটা নাটক দেখার জন্যে সেখানে উড়ে এসেছেন তিনি। সেই নাটকে বিজয় রাজের অভিনয় দেখে ভীষণ মনে ধরলো তার, নিজেই এসে কথা বললেন এই তরুণের সঙ্গে। নিজের কার্ড দিলেন। শুধু তাই নয়, মুম্বাইয়ে গিয়ে কয়েকজন পরিচালককে বললেন বিজয়ের কথা, জানালেন, দিল্লিতে কি দুর্দান্ত এক অভিনেতা লুকিয়ে আছে। সেই পরিচালকদের একজনের নাম ছিল মহেশ মাথাই, আরেকজন ছিলেন মীরা নায়ার। 

নাসিরউদ্দিন শাহ'র রিকমেন্ডেশন বলে কথা, সেটা তো ফেলে দেয়া যায় না। মহেশ মাথাই ডাকলেন তাকে। তার পরিচালিত 'ভোপাল এক্সপ্রেস' সিনেমা দিয়ে বলিউডে অভিষেক হয়ে গেল বিজয় রাজের। মীরা মায়ার বানালেন মনসুন ওয়েডিং, সেখানেও ডাক পড়লো তার। নাসিরউদ্দিন শাহ, শেফালি শাহ, রনদীপ হুদা, রজত কাপুরদের মতো দারুণ অভিনেতাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের সহজাত প্রতিভার বিচ্ছুরণটা ঘটিয়ে গেলেন বিজয় রাজ। 

রান সিনেমায় বিজয় রাজ

তবে লোকে তাকে চিনেছে মূলত 'রান' সিনেমার পরে। অ্যাভারেজ একটা সিনেমা, প্রচুর প্লটহোল, বক্স অফিসেও ভালো করতে পারেনি, কিন্ত সেই সিনেনাটাকে লোকে মনে রেখেছে কেবল বিজয় রাজের দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে। 'কাউয়া বিরিয়ানি', 'মোরগি কা পোলিও হুয়া থা ক্যায়া' বা 'কিডনি নিকাল লিয়া বে' সংলাপগুলো আজও ভীষণ জনপ্রিয়। ইউটিউবে শুধু এই সিনেমায় বিজয় রাজের সিকোয়েন্সগুলো নিয়ে একটা ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যায়, কয়েক মিলিয়ন ভিউ হয়েছে সেটার, হাজার হাজার কমেন্ট সেই ভিডিওর নিচে। মানুষজন লিখেছে, বিষণ্ণ মন নিয়ে ভিডিওটা দেখতে বসে কিভাবে তাদের মন ভালো হয়ে গেছে, কিংবা হাসতে ভুলে যাওয়া কেউ প্রাণ খুলে হেসেছে বিজয় রাজের অভিনয় দেখে- এটাই তো একজন অভিনেতার স্বার্থকতা! 

লিড রোলে অভিনয় করেছিলেন রঘু রোমিও সিনেমায়। দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল সেটা। জাতীয় পুরস্কারও জিতেছিল। যখন যে সিনেমায় ডাক পেয়েছেন, ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন, তার অভিনয়প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ দেননি কাউকে। পুলিশের রোল হোক, গাড়িচোর বা মাফিয়ার রোল হোক, অথবা হোক নায়কের বন্ধু, কমডিয়ান, বা অন্য কিছু- নিজের সেরাটা তিনি ঢেলে দিয়েছেন। সিনেমা খারাপ হয়েছে, বক্স অফিসে ফ্লপ এসেছে, কিন্ত তার অভিনয় নিয়ে কোন কমপ্লেন ছিল না কখনও। ক্যারিয়ারে সত্তরটার বেশি সিনেমায় কাজ করেছেন, কেউ বলতে পারবে না যে অমুক সিনেমায় বিজয় রাজের রোলটা ঝুলে গিয়েছিল, বা অমুক জায়গায় ওভারঅ্যাক্টিং করেছেন তিনি। 

অভিনয়ের বাইরে অভিনেতারা কি করছেন না করছেন, সবকিছুই এখন মিডিয়ার নখদপর্ণে থাকে। বলিউডে বিজয় রাজ সম্ভবত একমাত্র অভিনেতা, যিনি মিডিয়ার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই পছন্দ করেন। 'পিআর' বলে কোন শব্দ তার ডিকশনারিতে নেই। সিনেমায় নাম লেখানোর সময়ই বলে দেন, প্রমোশনে আমাকে পাবে না বাপু, যদি পোষায় তাহলে আমাকে নাও, নইলে নিও না। শুধুমাত্র এই কারনে অনেক সিনেমা থেকেই বাদ পড়েছেন তিনি, তার সম্পর্কে একটা বাজে ধারণা জন্মেছে প্রযোজক-পরিচালকদের মধ্যে। 

তবে এসব নিয়ে বিজয় রাজের মাথাব্যথা নেই। তার কথা হচ্ছে, 'আমার কাজ অভিনয় করা, সেটা আমি পারি। সিনেমা বেচাটা আমার কাজ না, সুতরাং ট্রাকের ওপরে উঠে আমার সিনেমাটা দেখুন টাইপের বোর্ড নিয়ে আমি দাঁড়াতে পারব না।' ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রচণ্ড লাজুক স্বভাবের, একটা ইন্টারভিউর জন্যে তাকে ডেকে তার সাড়া পাওয়া যায় না। ইউটিউবে অন্যান্য তারকা-অভিনেতাদের ইন্টারভিউতে সয়লাব, সেখানে বিজয় রাজের ইন্টারভিউ নেই বললেই চলে! এমনকি তার উইকিপিডিয়ার পেজটাও অসম্পূর্ণ, যেখানে সি-গ্রেডের অভিনেতাদের উইলিপিডিয়া পেজও দৈর্ঘ্যে নীলনদের সমান হয়। এই লোককে 'ক্রিমিনালি আন্ডাররেটেড' অ্যাক্টর না বললে আর কাকে বলবেন, বলুন? 

বিজয় রাজ, গাল্লি বয় সিনেমায়

তাকে যে সময় দেয়া থাকে, ঠিক সেই সময়েই তিনি সেটে আসেন। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। শেষ হলে পরিচালককে জিজ্ঞেস করেন আর কিছু করার আছে কিনা। উত্তরটা যদি 'না' হয়, তাহলে পাঁচ মিনিট পরে তাকে আর শুটিং সেটে খুঁজে পাবে না কেউ। নিজের চারপাশে রহস্যের একটা জাল বিছিয়ে রাখেন তিনি। সেই জাল ভেদ করে কেউ তার কাছে পৌঁছে যাক, এটা তার পছন্দ নয় মোটেও। মুম্বাইয়ের মালাবার হিলে তার ফ্ল্যাটের ঠিকানাও খুব বেশি মানুষ জানেন না। ক্যামেরার বাইরে তার জীবনটা কেমন, সেটা কাউকে জানতে দেয়ার আগ্রহ নেই বিজয় রাজের। 

অভিনেতাদের অনেকেই স্ট্রাগল করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। কঠিন সময়ের সেসব গল্প তারা বলেন। বিজয় রাজ এখানেও ব্যতিক্রম। নওয়াজউদ্দিন একবার বলছিলেন, এনএসডিতে থাকার সময়ে বিজয় ছিলেন তার রুমমেট। দুজনের পকেটের অবস্থা তখন ভীষণ খারাপ। দুইবেলা পেট ভরে খাওয়ার অবস্থাও নেই। তখন তারা পার্লে জি বিস্কুট খেয়ে খিদে মেটাতেন। এই গল্প বিজয় রাজের মুখ থেকে কেউ শুনবে না কখনও। স্ট্রাগলের গল্প বলাটা অপরাধ নয়, তবে গল্পগুলো শুনিয়ে তিনি হাততালি পেতে চান না হয়তো। অভিনয়ের জন্যে যেটুকু তালি পান, সেটাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। 

অভিনেতাদের মধ্যে কেউ থাকেন ডিরেক্টর্স আর্টিস্ট, পরিচালক যেভাবে বলেন, ঠিক সেভাবেই কাজটা করে দেন তারা। আরেকদল নিজের থেকে ইম্প্রোভাইজ করেন। বিজয় রাজ দ্বিতীয় দলের। 'দিল্লি বেলি' সিনেমায় ঠান্ডা মাথার এক ভিলেনের রোল প্লে করছিলেন তিনি, হারিয়ে যাওয়া হীরার খোঁজে দউনিয়া তছনছ করে ফেলতে যার দ্বিধা নেই। সেখানে একটা দৃশ্যে তার হাতে হীরাভর্তি কৌটাটা আসে। সেই কৌটার ভেতরে যে স্যাম্পলের জন্যে হাসপাতালে পাঠানো।পায়খানা ভর্তি- সেটা তারা জানে না। দৃশ্যটা ছিল এমন- কৌটার মুখ খুলে হীরাগুলো হাতে নেবেন বিজয় রাজ, তার হাতে হলুদ তরলে মাখামাখি হয়ে যাবে। অথচ ক্যামেরা ওপেন হতেই বিজয় রাজ পকেট থেকে একটা লাল কাপড় বের করলেন, সেটা বিছিয়ে দিলেন টেবিলের ওপর, তারপর কৌটাটাকে উপুড় করলেন কাপড়ের ওপর। পরিচালক অভিনব দেও 'কাট' বলতে ভুলে গিয়েছিলেন পুরো ব্যাপারটা দেখে! 

এই মানুষটাকে বলিউড শুধু কমেডিয়ান বানিয়ে রেখেছে অনেকগুলো বছর ধরে। অথচ গালি বয়ের মতো সিনেমায় অল্প সময়ে সিরিয়াস রোলে কি দুর্দান্ত অভিনয়টাই না করেছেন তিনি! বিজয় রাজ অনেক আগেই প্রমাণ করেছেন, তিনি মেথড অ্যাক্টর, কোন নির্দিষ্ট ধারা বা জনরা তাকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। হয়তো তারও কিছু ভুল আছে। রঙ্গমঞ্চের দুনিয়ায় 'প্রচারেই প্রসার' থিওরিতে না চললে পিছিয়ে পড়তে হয়। তবে সেই পিছিয়ে থাকায় বিজয় রাজের আপত্তি নেই। কাজের সময়টা বাদ দিয়ে তিনি এই রঙিন আলোর চাকচিক্যময় দুনিয়া থেকে দূরেই থাকতে চান। নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চান। এটুকুই বা ক'জনে পারে? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা