নিজের সহ তিন ভাইবোনের খরচ চালাতে বিজয় কাজ করেছেন খুচরো দোকানে, রেস্তোরাঁয়, সিমেন্ট কোম্পানিতে। জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশেও। এরপর আচমকাই সব ছেড়েছুড়ে ফিরলেন দেশে। ফিরলেন অভিনয়ের কাছে। যে অভিনয় ক্রমশই তাকে রূপান্তরিত করলো প্যান-ইন্ডিয়ান সুপারস্টারে!

'নায়ক' বলতে যেরকম বোঝায়, তিনি মোটেও সেরকম না৷ গায়ের রঙ কালো, স্বাস্থ্যের গড়নও গড়পড়তা সাধারণ মানুষের মতন। কন্ঠেও যে মায়াজাল আছে, এমন না। তবুও তিনি নায়ক। 'নায়ক' হওয়ার জন্যে যেসব জিনিস থাকা উচিত বলে মনে করে সাধারণ মানুষজন, সেসব বস্তুকে প্রাথমিক অবস্থাতে নাকচ করেই তিনি নায়ক! চেহারা-স্বাস্থ্যে বলিহারি কিছুই নেই তার, কিন্তু এটাও ঠিক, তার আসল সৌকর্য এসবে না৷ তার ইন্দ্রজাল অভিনয়ে। হ্যাঁ, অভিনয়টাই তার হাতের তালুর এলাকা। চোখ-মুখ-পুরো শরীর দিয়ে অভিনয়ের যে অসাধ্য সমীকরণ, সে সমীকরণের সিদ্ধহস্ত কারিগর এই মানুষ। যার পুরো নাম- বিজয় গুরুনাথ সেথুপতি কালিমুথু। যিনি আমাদের কাছে 'বিজয় সেথুপতি' কিংবা আদরের 'মাক্কাল সেলভান' নামেই পরিচিত। 

'উস্তাদ হোটেল' এর বিখ্যাত করিম ক্কা'কে মনে আছে নিশ্চয়ই, যিনি  হাসতে হাসতে তার নাতিকে বলছিলেন- 

কেউই নিজের ভাগ্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। যার যা নিয়তি, নানা চড়াই-উতরাইয়ের পরে সে সেই নিয়তির কাছেই ফিরবে। ফিরতে তাকে হবেই। 

করিম ক্কা'র উচ্চারিত নিয়তি কিংবা ললাট কিংবা অদৃষ্ট-জনিত এই বাক্যের সার্থক প্রয়োগই যেন দেখি বিজয়ের ক্ষেত্রে। রূপোলী পর্দায় বহু-বিচিত্র রঙিন গল্পে অভিনয় করা এ মানুষটির জীবনগল্প যে যেকোনো গড়পড়তা সিনেমার চেয়ে বহুগুণে নাটকীয়, সেটাই ক্রমশ উপলব্ধি হয় তার জীবনের বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালে। কিভাবে? সে গল্পই বলছি। 

এ গল্প শুরু হবে সেই সময় থেকে, যখন বিজয় হাইস্কুলের ছাত্র। পড়াশোনাকে খানিকটা সমঝে চলা বিজয়ের খেলাধুলাতেও ছিলোনা সেরকম কোনো আগ্রহ। বাদবাকি যা সব সহশিক্ষা কাজকর্ম, সেগুলোতেও যে খুব একটা কৌতূহল তার, তেমনটাও জোর গলায় বলা যায় না। তবে যাপিত সব বিষয়ে উদাসীন থাকলেও অভিনয় খানিকটা টানতো তাকে। সেই টান থেকে ষোল বছর বয়সে একটা সিনেমার জন্যেও অডিশন দেয় সে। কিন্তু বিধিবাম! ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হন না৷ উচ্চতাজনিত কারণে বিজয় বাদ পড়ে অডিশন থেকে। অভিনয়ের পথে যাবার সাহস আর হয়না তার৷ বিশেষ এ স্বপ্নকে বয়ামভর্তি করে আটকে রেখে সে ক্রমশ চলে আসে মূদ্রার উল্টোপাশে। নেমে পড়ে জীবনযুদ্ধের অসম লড়াইয়ে। 

নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে হতো তাকে। বাড়ি থেকে যে টাকা আসতো, তাতে কুলোতো না। খুব অল্পবয়সেই তাই বিজয় নেমে পড়ে জীবিকার তাগিদে। বহু-বিচিত্র চাকরীর সাথে দেখা হয় তার। খুচরা দোকানের সেলসম্যান থেকে খাবারের রেস্তোরাঁর ক্যাশিয়ার কিংবা ফোন বুথ অপারেটর...নানা চলকের কাজ। এভাবে বিচিত্র সব চাকরীর বহুমুখী স্রোতে ভাসতে ভাসতে একসময়ে পড়াশোনা শেষ হয়।  অ্যাকাউন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বিজয় যোগ দেন সিমেন্ট কোম্পানির পাইকারি দোকানে। কোনো চাকরীকেই তখন নাক সিঁটিয়ে উপেক্ষা করার মতন বিলাসিতা করার অবস্থায় ছিলেন না মানুষটি। ঘরে তিন ভাই-বোন, সবাই তার উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু সিমেন্টের এই চাকরী থেকেও খুব যে আয় হচ্ছিলো, তেমনও না। বিজয় তখন নিলেন জীবনের বেশ বড়সড় এক সিদ্ধান্ত। চলে গেলেন দুবাই। সেখানে চাকরী শুরু করলেন আবার। কাজে দিলেন অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ। 

সুপার ডিলাক্স! 

কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে খুব একটা মন টিকছিলো না৷ সবকিছু ছেড়েছুড়ে একসময় চলে এলেন দেশে। ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের বিজনেস শুরু করলেন৷ বলাই বাহুল্য, মন উঠে গেলো অল্পদিনেই৷ এরপর রেডিমেড কিচেন ম্যাটেরিয়ালস এর ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসা চলছে, এরকম এক সময়ে আচমকা একদিন বিজয়ের চোখ পড়লো 'কুথুপাত্তারাই' সিনেমার অডিশনের পোস্টারের দিকে। ষোল বছরে অডিশন দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো যে ছেলেটি, বহু বছর পরে দুরুদুরু বক্ষে সেই ছেলেটি আবারও দাঁড়ালো পরীক্ষকদের সামনে। ভাগ্যদেবীও মুখ তুললেন। তথাকচিত 'অ-নায়কোচিত' চেহারা নিয়ে ছেলেটি ঢুকে পড়লো সিনেমার নন্দনকাননে। বলা ভালো, ছেলেটি ফিরে এলো ললাটের লিখনের কাছেও।

যদিও অভিনয়ের এই বিস্তীর্ণ মঞ্চে ঢুকে প্রথম প্রথম বেশ নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে তাকে। প্রথম পাঁচ বছর পর্দার পেছনের কাজ আর ছোটখাটো সাইড-ক্যারেক্টার হিসেবে কেটেছে। তবে তিনিও হাল ছাড়েননি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন সব। আস্তে আস্তে ভাগ্য ফিরেছে, বিজয়ও যুক্ত হয়েছেন মূলস্রোতের অভিনয়ে। তেনমেরকু পারুভাকাতরু, পিজ্জা, সুন্দরাপান্ডিয়ান থেকে ক্রমশ এসেছে নাইন্টি সিক্স, বিক্রম বেদ, সুপার ডিলাক্স...!  

নাইন্টি সিক্স! 

বিজয় সেথুপাতির ফিল্মোগ্রাফি নিয়ে চাইলে এ লেখা আরো অনেকটুকু টানা যেতো৷ একেকটা সিনেমায় তার যে অভিনয়ের শেড, তা নিয়ে বিস্তর শব্দব্যয় করলেও বাহুল্য মনে হতোনা হয়তো। তবুও মনে হলো, এ লেখায় রূপোলী পর্দার 'সুপারস্টার মাক্কাল সেলভান' গুরুত্ব না পাক। বরং এ লেখায় ক্রমশ ফুটে উঠুক সেই ছিপছিপে কিশোর, যে ষোল বছর বয়সেই আসতে চেয়েছিলো অভিনয়ের এই অনিশ্চিত জলরাশির মাঝখানে। আসুক সে মানুষটি, একা হাতে সংসারের ভার টানতে গিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে সিমেন্টের দোকান... বিচিত্র এক নাগরদোলার চড়াই-উতরাই যাকে ক্রমশই রূপান্তরিত করেছে পোড়খাওয়া অবয়বে। পর্দার সামনের যে মানুষটিকে আমরা 'তারকা' হিসেবে চিনি, তার গল্প কতটা সংগ্রামমুখর, এ লেখা ঠিক সে প্রসঙ্গে নৈবেদ্য টেনেই ইতি টানুক, সেটাই থাকুক সর্বাগ্রে। সে সাথে গুণী এ মানুষটির জন্মদিনের শুভেচ্ছাও থাকুক। অভিনয়ের আকুতি ঠিকরে বেরোয় যার চোখমুখ দিয়ে, সে মানুষটি শতায়ু হোক, বহু বিচিত্র চরিত্রে নিয়মিত মুগ্ধ করুক দর্শককে, শেষে এসে এটাও থাকুক কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা