যে অভিনেতাকে মানুষ শুধুমাত্র ভালোবেসেই  দিয়েছিলো গুরুভার, সে মানুষটিই এখন সবার ভালোবাসার প্রতিদান দিচ্ছে সর্বস্ব বাজি রেখে। এ যুদ্ধে কে জিতবে, তা অনিশ্চিত। তা জানা নেই কারোরই। কিন্তু, মানুষের হৃদয় জয় করার এ যুদ্ধে ভলোদিমির জেলেনস্কি যে এরইমধ্যে জিতে গিয়েছে বিশাল ব্যবধানে, তাতে কি সন্দেহ রয়েছে তিলমাত্রও? 

কিছু বছর আগের ঘটনা। আইসল্যান্ডের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর রেইকিয়াভিক এর মেয়র হয়ে গেলেন এক কমেডিয়ান। ‘জন নার’ নামের এ কমেডিয়ান ক্ষমতাসীন দলের অন্যায়-অবিচার নিয়ে বেশ আগে থেকেই ছিলেন সরব। খানিকটা ঠাট্টাচ্ছলে খুলেছিলেন এক রাজনৈতিক দলও। ‘দ্য বেস্ট পার্টি’ নামের এ দল নির্বাচনের আগ দিয়ে খানিকটা প্রচারণাও চালিয়েছিলো। সিরিয়াস প্রচারণা না মোটেও। নির্বাচনের ডামাডোলে খানিকটা কমিক রিলিফ দেয়াই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু আইসল্যান্ডের মানুষজন যে বিষয়টিকে সিরিয়াস ভাবেই নিয়ে নেবে এবং জন নারকে রেইকিয়াকিভের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করবে, তা বোধহয় স্বয়ং জন নারও দূরতম কল্পনাতে ভাবেননি। কিন্তু, পরিস্থিতি সে বিষয়টিকেই করেছিলো বাস্তব।

ঠিক এমনটিই ঘটেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির ওলেক্সান্দ্রোভিচ জেলেনস্কির ক্ষেত্রে। রাশিয়া-ইউক্রেনের সাম্প্রতিক থমথমে যুদ্ধাবস্থার মাঝখানে পুতিনের পাশাপাশি যে মানুষটিকে নিয়ে সম্ভবত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কড়চাও। রাশিয়ার সাথে সম্মুখ সমরে যে মানুষটি ফ্রন্টলাইনে থেকে দিয়ে যাচ্ছেন সময়োচিত নেতৃত্বও। যে মানুষটিও জন নারের মতই কমেডিয়ান। পেশাদার রাজনীতিবিদদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে মানুষটিকেও একদিন ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দিয়েছিলো ইউক্রেনের মানুষজন। 

ইউক্রেনের রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগে জেলেনস্কি জনপ্রিয় ছিলেন একজন দক্ষ কৌতুকাভিনেতা হিসেবে। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠাও ইউক্রেনে। এখানেই আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষে যুক্ত হন অভিনয়ের সাথে। তিনি বেশ কিছু জনপ্রিয় টিভি শো এবং রিয়েলিটি শো’তেও অংশ নেন ক্রমশ। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামের এক শো’তে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এই শো’তে জেলনস্কি একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে আচমকাই এক ভাইরাল ভিডিও’র কল্যানে হয়ে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি। এই শো’র জনপ্রিয়তা দেখে তিনি ‘শো’ এর নামেই এক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ললাটের লিখন এমনই বিচিত্র, নির্বাচনে সে রাজনৈতিক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিনিময়ে শেষমেশ তাকে বাস্তবেও পালন করতে হয় ‘রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা’ হবার সে দায়িত্ব। এই 'শো' এর পাশাপাশি জে্লেনস্কি যে 'শো’গুলো করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো- দ্য রিকাউন্ট। যেখানে তিনি রাজনীতিবিদদের নিতেন এক হাত। এছাড়াও ‘ড্যান্সিং উইথ দ্য স্টারস’ এর ইউক্রেন ভার্সনেও তিনি করেছিলেন বাজিমাত। অভিষেক সিজনেই হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি, তিনি বেশ কিছু সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাগুলোও হয়েছিলো জনপ্রিয়। 

কমেডিয়ান জেলেনস্কি! 


শিল্পসংস্কৃতির সাথে যুক্ত এ মানুষটির ইউক্রেনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যেমন এক চমক, তেমনি চমক- থমথমে রণাঙ্গনে তার দারুণ ভূমিকা। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আক্রমণের মাঝামাঝি এক পর্যায়ে কিছু সময়ের জন্যে জেলেনস্কির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো বিশ্ব-মিডিয়ার। তখন শুরু হয়েছিলো কানাঘুষো। ফিসফিস। রাশিয়ান মিডিয়া এও রটিয়েছিলো- জেলেনস্কি নাকি ইউক্রেন থেকে পালিয়ে গিয়েছে। আবার এরকম গুজবও রটেছিলো- জেলেনস্কির নেতৃত্বে নাকি রাশিয়ান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ইউক্রেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় জেলেনস্কির পলিটিক্যাল আইডিওলজি কিংবা ক্যাপাবিলিটি নিয়েও উঠেছিলো প্রশ্ন। কিন্তু যাপিত সব বিতর্ক, প্রশ্ন কিংবা সংশয়ের জবাব দিয়েছেন জেলেনস্কি নিজেই। এক ভিডিওবার্তায় হাজির হয়েছেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে। জানিয়েছেন- তিনি সাথেই আছেন দেশবাসীর। আর সাথেই থাকবেন দেশবাসীর। এবং এই এক ঘটনাই তাকে জনতার চোখে আবার পরিনত করেছে নায়কে। আস্থার প্রতীকে। যে আস্থার প্রতীক বেশ দৃঢ়কন্ঠেই জানিয়েছেন-

আত্মসমর্পণ কিংবা হার মানার প্রশ্নই ওঠেনা। যতক্ষণ বেঁচে আছি, প্রতিরোধ চলবে।

যে জেলেনস্কি সম্মুখ সারির যোদ্ধা!

নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- 

যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা

যুদ্ধ মানেই

আমার প্রতি তোমার অবহেলা। 

এ তো ধ্রুবসত্যি, যুদ্ধ কিংবা সংকটে অবহেলা, অনিশ্চয়তা, ঘৃণা কিংবা দ্বেষ চলে পাশাপাশি, সাম্যাবস্থানে। তবে, এসবের পাশাপাশি, সংকট মানুষ চিনতেও শেখায়। যেমনটা চেনাচ্ছে এখন। যে অভিনেতাকে মানুষ শুধুমাত্র ভালোবেসেই  দিয়েছিলো গুরুভার, সে মানুষটিই এখন সবার ভালোবাসার প্রতিদান দিচ্ছে সর্বস্ব বাজি রেখে। এ যুদ্ধে কে জিতবে, তা অনিশ্চিত। তা জানা নেই কারোরই। কিন্তু, মানুষের হৃদয় জয় করার এ যুদ্ধে ভলোদিমির জেলেনস্কি যে এরইমধ্যে জিতে গিয়েছে বিশাল ব্যবধানে, তাতে কি সন্দেহ রয়েছে তিলমাত্রও? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা