যুদ্ধকেন্দ্রিক সিনেমা আছে অজস্র, অগনিত। যদিও সেসব থাকাই সার। কারণ, সেসব সিনেমায় আর যাই হোক, কর্তৃপক্ষের হৃদয় যে বিচলিত হয়না মোটেও, তাও পরীক্ষিত সত্য। তবুও নির্মাতারা ক্যামেরার হাতিয়ারেই করে যান প্রতিবাদ। দিয়ে যান যুদ্ধবিরোধী বার্তাও। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ীই তারা চালান আপ্রাণ চেষ্টা। কারণ, শেষে এসে এই চেষ্টাটুকুই হয়ে দাঁড়ায় তাদের সান্ত্বনার বড়সড় ক্ষেত্র।

যুদ্ধ ক্ষত কিংবা ক্ষতির। যুদ্ধ শত্রু নিয়ে খেলার। যুদ্ধ অবহেলারও। যুদ্ধ সামগ্রিক। পাশাপাশি যুদ্ধ ভীষণ ব্যক্তিগতও। বিশ্বযুদ্ধই বলি কিংবা মুক্তিযুদ্ধ, শোণিত উপাখ্যানে কেউই কাউকে ছাড় দেয়না একরত্তি। যদিও আমরা মাঝেমধ্যেই এই বলে প্রবোধ দিই, যুদ্ধের সেসব থমথমে দিন হয়তো আর দেখতে হবেনা এ গ্রহবাসীকে। পাশাপাশি, কমলালেবু পৃথিবীর বয়সও তো বেড়ে চলেছে ক্রমশ। সভ্যতা এগোচ্ছে হু হু করে। কেনই বা হবে যুদ্ধ? কিন্তু, তবুও প্রশ্ন ওঠে, যুদ্ধের রোষানল স্তিমিত হলো কি মোটেও? বা, আদৌ হবে কোনোদিন? জানা নেই। অবশ্য আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নিয়ে আমাদের খুব একটা মাথাব্যথাও নেই। ঠিক সে কারণেই, ভারী আলাপ বরং তুলে রাখি শিকেয়, কথা বলি এমন কিছু সিনেমা নিয়ে, যেসব সিনেমা যুদ্ধের বিভীষিকাকে নগ্ন করে কালে কালে তুলে এনেছে সামনে। যদিও যুদ্ধের সুবিশাল ক্যানভাস সাপেক্ষে এ সিনেমাগুলো হয়তো এনেছে ছিঁটেফোঁটাই, তবুও আনাটাই গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক। সেসব সিনেমার কিয়দংশ নিয়েই আজকের নৈবেদ্য।

১. শিন্ডলার’স লিস্ট

যুদ্ধকেন্দ্রিক সিনেমাগুলো নিয়ে লিখতে গেলে যে সিনেমাগুলো প্রাথমিকভাবেই চলে আসে কলমের অগ্রভাগে, তাদের মধ্যে অন্যতম স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার’স লিস্ট। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় ক্রমশ উঠে আসে অস্কার শিন্ডলার’ নামের এক ব্যবসায়ীর আখ্যান, যুদ্ধের টালমাটাল সময়েও  যিনি অসহায়, ত্রস্ত ইহুদিদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে নিজের ব্যবসাকে ক্রমশ করেছিলেন চাঙ্গা। কিন্তু আচমকাই টনক নড়ে তার। যুদ্ধের ভয়াবহতা ছুঁয়ে যায় তাকে। নিজের অধীনস্থ ইহুদীদের বাঁচানোর জন্যে তিনি শুরু করেন মরনপণ লড়াই। সে লড়াইয়ের গল্পই ‘শিন্ডলার’স লিস্ট।‘

শিন্ডলার'স লিস্ট

২. কাসাব্লাঙ্কা

যদিও এ সিনেমাকে ‘রোমান্টিক’ জঁরার সিনেমা হিসেবেই আখ্যায়িত করেন অধিকাংশ মানুষ। এবং এ কথা সত্যিও, রোমান্টিসিজম এ সিনেমার বেশ বড় এক অংশ জুড়েই ভাস্বর। তবু এসবের পাশাপাশি, এ সিনেমায় যুদ্ধকালীন এক অন্যরকম দৃশ্যপটেরও খোঁজ পাওয়া যায়। গল্প, রোমান্টিসিজম, যুদ্ধকালীন আবহ কিংবা অভিনয়... সব মিলিয়ে এ সিনেমা বরাবরই অনবদ্য।

কাসাব্ল্যাঙ্কা

৩. কাম অ্যান্ড সি

যুদ্ধ নিয়ে যে কয়টি সিনেমাকে ‘রোমহর্ষক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম- কাম অ্যান্ড সি। রাশিয়ান এ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন অ্যালেস আদামোভিচ। এবং এই সিনেমাটিও তার যুদ্ধকালীন বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই নির্মিত। চৌদ্দ বছরের এক নির্ভার বেলারুশ কিশোর কিভাবে সময়ের ফেরে রূপান্তরিত হয় ভয়ঙ্কর এক যোদ্ধায়, এ সিনেমায় ক্রমশ ফুটে ওঠে সে আখ্যান। পাশাপাশি, কদাকার যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বর্ণনা তো রইলোই।

কাম অ্যান্ড সি


৪. সেভিং প্রাইভেট রায়ান

যুদ্ধ নিয়ে স্পিলবার্গের বানানো সিনেমাগুলোর মধ্যে এ সিনেমাটি একটু বেশি আলোচিত। অবশ্য হবে নাও বা কেন, সিনেমার ওপেনিং সিনেই ওমাহা বীচে দীর্ঘকালব্যাপী যে রগরগে যুদ্ধদৃশ্য মঞ্চস্থ হয়, সিনেমার সাথে মুগ্ধ হয়ে আটকে থাকা ঠিক তখন থেকেই হয় শুরু। এই নৃশংস দৃশ্যাবলী দিয়ে শুরু করে স্পিলবার্গ যেন প্রচ্ছন্নে থেকে এটাই বলতে চান- যুদ্ধের সিনেমায় ভয়াবহতাই প্রাসঙ্গিক। যদিও সিনেমা যত সামনে যায়, আমরা বুঝতে পারি- বিভীষিকা কিংবা ঘৃণা নয়, সিনেমার শেষটা হবে ভালোবাসা দিয়েই। এবং শেষে এসে সে কারণেই সমাপ্তি হয় দুর্দান্ত। মনে রাখার মতন। 

সেভিং প্রাইভেট রায়ান

৫. ডানকার্ক

নোলানের ‘ডানকার্ক’ দেখে মুগ্ধ হওয়ার কারণ বহুবিধ। প্রথমত- ডানকার্ক দ্বীপে আটকে পড়া সৈন্যদের মুক্ত হওয়ার রুদ্ধশ্বাস সত্যগল্প। দ্বিতীয়ত- গল্পবয়ান। তিনটি ন্যারেশনের তিনটি ভিন্ন গল্প, স্থল-জল ও অন্তরীক্ষের গল্প... সে গল্পগুলো যখন একসূত্রে গেঁথে যায় শেষে এসে, গল্প জমাটি হয় ঠিক তখনই। স্ক্রিপ্ট, সিনেম্যাটোগ্রাফী কিংবা সাউন্ড ডিজাইন...  এ সিনেমার সব ডিপার্টমেন্টই থাকে চমক, হয় দুর্দান্ত কাজ।

ডানকার্ক

৬. গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজ

‘স্টুডিও গিবলি’র সিনেমা বরাবরই দুর্দান্ত গল্পের সাথে গভীর ভাবনাচিন্তার সম্মিলন ঘটায়। ব্যতিক্রম না এই সিনেমাও। অনেকের মতে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নির্মাণ এটিই, যে নির্মাণের উপজীব্য দুই ভাইবোন। যুদ্ধের বিক্ষুব্ধ কালস্রোতে তাদের বেঁচে থাকা কিংবা তাদের সংগ্রামের গল্পই ‘গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজ।‘ যে সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলেননি, এরকম মানুষ আছে খুব কমই। 

গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজ 

৭. দাস বুট

জলপথের যুদ্ধের ভীষণ পুঞ্জীভূত অমানবিকতাই এ সিনেমার উপজীব্য। আটলান্টিকের যুদ্ধাবস্থায় জার্মান একটি জাহাজ, সে জাহাজে অবস্থানরত মানুষদের দুর্দশা, যুদ্ধকালের উচ্চপদস্থ মানুষদের বিলাসী জীবনযাপন, পাশাপাশি তৃণমূল মানুষদের প্রতি তাদের বৈষম্য, যুদ্ধের মোড়কে উঠে এসেছে এসবের অনেকটাই, নির্মেদ গল্পবয়ানে।

দাস বুট

৮ রোম, ওপেন সিটি

নাজিরা যখন আক্রমণ করেছে ইতালি, ইতালি তখন যেভাবে প্রতিরোধ করেছে, সে প্রতিরোধে যেভাবে মিশেছে যুদ্ধকালীন ভয়াবহতা ও থমথমে অস্বস্তি... সেসবেরই টুকরো টুকরো চিত্র- রোম, ওপেন সিটি। সবচেয়ে মুগ্ধ করার বিষয়, সিনেমার ন্যারেশন স্টাইল। ইতালিয়ান নিওরিয়্যালিজমের সাথে খন্ডচিত্রে যুদ্ধের হিমশীতল অবয়ব... অনবদ্য।

রোম, ওপেন সিটি 

৯. দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই

জাপানের দখলীকৃত অঞ্চল বার্মায় আটককৃত একদল যুদ্ধবন্দী এবং সেখানকার প্রশাসনের মধ্যবর্তী টানাপোড়েনের গল্পই এ নির্মাণের উপজীব্য। যেখানে কর্নেল নিকলসনের নেতৃত্বে গড়া হয় একটি ব্রীজ, এবং যত সময় গড়ায়, যে বিশেষ ব্রীজকে ঘিরেই আবর্তিত হয় একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ। এবং শেষের ক্লাইম্যাক্সে এসে এই ব্রিজই সবাইকে উপেক্ষা করে হয়ে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিভাবে? সেজন্যেই দেখতে হবে বিশেষ এ নির্মাণ।

দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই

১০. লেটারস ফ্রম উও জিমা

উও জিমার দ্বীপকে ঘিরে জাপান ও আমেরিকার দড়ি টানাটানি, বিশেষ এ দ্বীপে আটকে পড়া দুই পক্ষের অগুনতি সৈন্য, তাদের মধ্যবর্তী দ্বৈরথ, শেষে এসে অন্তিম পরিণতি...এসব নিয়েই নির্মাণ ‘লেটারস ফ্রম উও জিমা।‘ যে নির্মাণের শেষে যুদ্ধের অসারতা এবং মানবিক কোমল অনুভূতিতে হৃদয় ক্রমশই ভারী হয়ে ওঠে, নিস্ফল আক্রোশে খানিকটা যেন তড়পাতেও হয়। এবং এ সিনেমার সার্থকতাও ঠিক সেখানেই। 

লেটারস ফ্রম উও জিমা

১১. দ্য পিয়ানিস্ট

পোলিশ একজন মিউজিশিয়ান, যুদ্ধকালীন তার সংকট, ইঁদুরের মত বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা, চারপাশে যুদ্ধের, ধ্বংসের, মৃতের মহাশ্মশান... এ সিনেমা নানা আঙ্গিকের মিলিত ব্যঞ্জনায় এমনই রূঢ়ভাবে আঘাত করেছিলো ভেতরে, সিনেমা শেষে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম বহুক্ষণ। রোমান পোলনস্কির এ সিনেমাকে অনেকেই বলেন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমা। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কি না জানিনা, তবে যুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে প্রিয় সিনেমার নাম বললে, আমি যে বেছে নেবো 'দ্য পিয়ানিস্ট'কেই, তাতেও নেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা।

দ্য পিয়ানিস্ট 

এ নির্মাণগুলোর বাইরেও যুদ্ধকেন্দ্রিক সিনেমা আছে অজস্র, অগনিত। যদিও সেসব থাকাই সার। কারণ,সেসব সিনেমায় আর যাই হোক, কর্তৃপক্ষের হৃদয় যে বিচলিত হয়না মোটেও, তাও পরীক্ষিত সত্য। তবুও নির্মাতারা ক্যামেরার চোখেই করে যান প্রতিবাদ। দিয়ে যান যুদ্ধবিরোধী বার্তাও। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ীই তারা চালান আপ্রাণ চেষ্টা,যদিও সে চেষ্টা ধ্বংসযজ্ঞে কতটুকু রাখে প্রভাব, সেও প্রশ্নবিদ্ধ। তবুও, শেষে এসে এই চেষ্টাটুকুই হয়ে দাঁড়ায় তাদের সান্ত্বনার ছোটখাটো ক্ষেত্র। হয়তো, বেলাশেষে, প্রাপ্তিও এটুকুই!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা