ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'তে স্পিলবার্গ নিজের মতই তৈরী করেছেন এক ঘোরগ্রস্ত জগৎ। রিয়েলিজম এর সাথে এক ঘাটে জল খাইয়েছেন রোমান্টিসিজমকে, ঘৃণা ও ভালোবাসাকে হাঁটিয়েছেন গলা ধরাধরি করে, বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার মাঝখানে বসিয়েছেন অন্ধকার উপত্যকাও। নানামুখী অনুষঙ্গের আশ্চর্য মেদহীন সমতাবিধানে এভাবেই যে নির্মাণ হয়েছে- সেটিই পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের গল্প। কিংবা, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি।

বহুকাল আগের কথা। শেক্সপীয়ারের 'রোমিও ও জুলিয়েট' থেকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে থিয়েটারে এলো একটি মঞ্চনাটক। সে মঞ্চনাটক থেকে পরবর্তীতে রবার্ট ওয়াইস এবং জেরোমি রবিনস নির্মাণ করলেন এক সিনেমা। যে সিনেমা অস্কারে এগারোটি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে পুরস্কার জিতলো দশটিতেই৷ যারা সিনেমা-টিনেমা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তারা প্রায় সবাই-ই একবাক্যে সিনেমাটিকে 'ক্ল্যাসিক' হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিলেন। এরকম এক সিনেমা, যে সিনেমা যুগের পর যুগ ধরে 'কাল্ট ক্ল্যাসিক' এর মর্যাদায় ভাস্বর, সে সিনেমার রিমেক করা হলো বেশ কিছুদিন আগে। যিনি রিমেক করলেন, তিনি এর আগে কোনোদিন মিউজিক্যাল ফিল্ম করেননি। এ জঁরায় এটাই তার প্রথম কাজ। প্রশ্ন উঠলো, কেমন হবে এ নির্মাণ? আগের সিনেমার বিস্ময়কর সাফল্য ঠিক কতটুকু সামলানোরও বা যোগ্যতা রাখবে এ নির্মাণ? প্রশ্ন অজস্র। বিচিত্র। সেসব প্রশ্ন নিয়েই কথাবার্তা। প্রসঙ্গত জানাই, যে সাম্প্রতিক সিনেমা আজকের উপজীব্য, সে সিনেমার নাম- ওয়েস্ট সাইড স্টোরি। নির্মাতা- স্টিভেন স্পিলবার্গ।

'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'র গল্প শুরু হয় নিউইয়র্কের পশ্চিম প্রান্তের কিছু তৃণমূল মানুষের মধ্যবর্তী দ্বৈরথ দিয়ে। নগরায়নের গুঁতোয় ভেঙ্গে যাচ্ছে বস্তি। বস্তির বদলে ঝা-চকচকে বিলাসবহুল ঘরবাড়ি তৈরী হবে। যারা বিত্তবান, তাদেরই স্থান হবে সেখানে। তারাই করবেন রাজত্ব। এরকম এক টালমাটাল কাল, যখন উদ্বাস্তু কিছু মানুষের মাথাগোঁজার জায়গাটুকু উবে যাচ্ছে নিমেষেই, ধ্বংসযজ্ঞের এমন এক প্রকোষ্ঠেই শুরু হয় সময়ের আখ্যান৷ ক্রমশ দেখা যায়- এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও দুই দল বিপরীতমুখী মানুষ আশ্চর্য পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উপস্থিত। এদের মধ্যে একদলের পরিচয়- জেটস। আরেক দলের পরিচয়- শার্কস। 'জেটস'রা সাদা চামড়ার। তারা এখানের স্থানীয়। তারা আমেরিকান। অন্যদিকে, 'শার্কস'রা পুয়ের্তোরিকো থেকে এসেছে। তারা কৃষ্ণবর্ণের। তাদের ভাষা স্প্যানিশ। এই যে প্রতিদ্বন্দ্বী যুগল দল, এদের মধ্যে এক দল মনে করে, জন্মগতভাবেই নিউইয়র্কের পশ্চিম খণ্ডের অধিকার তাদের। ওদিকে আরেক দলের বিশ্বাস, তারা এখানে যেহেতু বহুবছর ধরে আছে, সুতরাং, এই স্থানের হক তাদের ছাড়া আর কারো হতেই পারে না। বলা বাহুল্য, শুরু হয়- কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। শুরু হয় দ্বৈরথ। যে দ্বৈরথে মিশে থাকে জাত-পাত-বর্ণ-গোত্র, জাতীয়তা-ভালোবাসা-ঘৃণার বিচিত্র সব রসদ। 

এই নির্মাণের গল্প যদি দ্বন্দ্ব-রেষারেষির চিরায়ত আখ্যানে থাকতো, তাহলেও চলতো। কিন্তু তা থাকেনা। এ গল্পে সবকিছু ছাপিয়ে প্রকট হয় দুই মানব-মানবীর প্রণয়। টনি ও মারিয়ার প্রণয়-আখ্যানে যুক্ত হয় খানিকটা জটিলতাও। কারণ- 'টনি' জেটস দলভুক্ত। 'মারিয়া' ঠিক বিপরীত। তার স্থান 'শার্কস'দের করতলে। বিপরীত স্রোতের এ সম্পর্ককে ঘিরে ক্রমশ জোরালো হয় পরিস্থিতি। আসে ঘৃণা। হত্যা। বীভৎসতা। শেষে এসে পরিণতি। সুখের, না, অসুখের? নিজে দেখাই সমীচীন।

স্পিলবার্গ 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'র গল্পবয়ানে বজায় রাখলেন নিজের স্বকীয়তাই। প্রচণ্ড বর্ণিল সেট, নানা রঙের পারস্পরিক সহাবস্থান, দারুণ মেটাফোরিক্যাল একেকটা ফ্রেম... মুগ্ধ হলাম ক্রমশ। তিনি যে বেশ আটঘাঁট বেধেই নেমেছিলেন, তার প্রমাণ পেলাম তার সহযোদ্ধাদের বর্ণনাতেও। এ সিনেমার স্ক্রিনপ্লে করলেন টনি কুশনার, যাকে ধরা হয় 'আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লেরাইট' হিসেবে। রইলেন অস্কার উইনিং সিনেম্যাটোগ্রাফার জানুস কামিনিস্কিও। এদেরকে সাথে নিয়ে চুয়াত্তর বছর বয়সী মাস্টার ফিল্মমেকার স্টিভেন স্পিলবার্গ যে চমক দেখালেন, তা দেখানোটা দায়িত্বও ছিলো তার। কারণ, ষাট বছর আগের সে কাল্ট ক্ল্যাসিকের সমকক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে গেলে মুগ্ধ করতে হতো নির্মাণের সব বিভাগেই। এবং সেটিই দারুণভাবে করলেন স্পিলবার্গ।

শুরুর সে ধ্বংসস্তুপে শুরু হওয়া দৃশ্য থেকে ক্রমশ মিউজিক্যাল এক ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে যেভাবে গল্প এগোলো, তাতে চমক রইলো ক্ষণে ক্ষণেই। যৌবনের প্রেম, বিক্ষোভ, আক্ষেপ, উন্মাদনা, গান কিংবা নাচকে যেভাবে ক্রমশ একের পর এক চমকপ্রদ অবতারে আনা হলো, তাতে চিত্রনাট্যের সাথে একরকম বুঁদ হওয়াই হলো নিয়তি। পপ কালচারকে যেমন ট্রিবিউট দেয়া হলো এ স্ক্রিনপ্লে'তে, তেমনি ইমিগ্রেশন, রেসিজম, লাভ-হেট প্যারাডক্স নিয়েও করা হলো প্রহসন। যে যুবকেরা ক্ষমতার জন্যে এতকিছু করছে, তাদের সে ক্ষমতাটাও যে কতটা মূল্যহীন, এবং, ক্ষমতার এই লোভ যে কতটা সর্বগ্রাসী, স্পিলবার্গের ন্যারেশন ছাড়লোনা সেসবকেও। শার্প লাইট কিংবা রেড লাইটে মেটাফোরিক্যাল একেকটা বার্তা দেওয়া, লেন্স ফ্লেয়ারে পরাবাস্তব আবহ তৈরী করা, সিনেমার পরিস্থিতি অনুযায়ী কালার প্যালেট পালটানো... স্পিলবার্গ নির্মাণের আড়াই ঘন্টার পুরোটা সময়েই রইলেন সতর্ক। সতর্ক। এবং সতর্ক। 

নাচে-গানে বজায় রইলো চোখ ধাঁধানো আলোর উপস্থিতি! 

নির্মাণ-জনিত এই অভিনবত্ব খুব দারুণভাবেই বজায় রইলো অভিনয়েও। মারিয়া, টনি, বার্নার্ডো, রিফ, আনিতা... প্রধান নজর ছিলো এই চরিত্রগুলোর দিকে। এবং এই চরিত্রের কুশীলবেরা করলেনও খুব দারুণ। নবাগত 'মারিয়া'রূপী র‍্যাচেল খুব স্নিগ্ধ এক মায়া ছড়ালেন পুরো সিনেমায়। 'টনি'রূপী আনসেল এলগর্টের কাছ থেকে যদিও প্রত্যাশা ছিলো আরেকটু বেশি। সে হিসেবে, খানিকটা হতাশ করলেন তিনি। ওদিকে, 'বার্নার্ডো কিংবা 'রিফ' গল্পে সঙ্গত দিলেন দারুণভাবেই। কিন্তু এদের সবাইকেই ছাপিয়ে গেলেন একজন। তিনি আনিতা। 'আনিতা'রূপী আরিয়ানা ডিবোস মুগ্ধ করলেন নানাভাবে। নানা প্রকোষ্ঠে। নৃত্যশৈলী, দেহসৌষ্ঠব, রক্তঝরা চাহনি থেকে প্রিয়জন হারানো  শোক, হতাশা থেকে ঘৃণা, আক্ষেপ থেকে বিদ্বেষ... নানামুখী অনুভূতিকে খুব দারুণভাবে ফুটিয়ে 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'তে আলাদাভাবে চোখে লেগে রইলেন এই অভিনেত্রীই। স্বল্পসময়ের জন্যে এসে মুগ্ধ করলেন রিটা মোরেনোও। মজার বিষয়, 'ভ্যালেন্টিনা' চরিত্রে অভিনয় করা এ বর্ষীয়ান অভিনেত্রী ছিলেন ১৯৬১ এর 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'তেও। সেখানে তিনি অভিনয় করেছিলেন 'আনিতা' চরিত্রে! সে সিনেমার পাশাপাশি এ সিনেমায় অল্পসময়ের জন্যে থেকে দুই সিনেমার মধ্যে মেলবন্ধনের দারুণ এক কাজই যেন করলেন তিনি।

মারিয়া-টনির স্নিগ্ধ আখ্যান! 

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিলো এ লেখা, সে প্রশ্নে ফেরা যাক। একই ঘটনা নিয়ে নির্মিত যে সিনেমা ষাট বছর আগেই পেয়েছিলো কাল্ট ক্ল্যাসিকের মর্যাদা, ষাট বছর পরে এসে সে সিনেমার রিমেকে নতুনত্ব ঠিক কোথায়? এর উত্তর বহুবিধ। প্রথমত- রবার্ট ও জেরোমির নির্মিত সিনেমার চেয়ে স্পিলবার্গের সিনেমা অনেক বেশি সমসাময়িক এবং প্রাসঙ্গিক। ইমিগ্রেশন, রেসিজম নিয়ে এ সিনেমা যেমন তীব্র আলোচনা করেছে, তেমনি প্রাসঙ্গিক আলোচনা হয়েছে এলজিবিটিকিউ নিয়েও। যেখানে, আগের 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'র 'পুয়ের্তোরিকোন নাগরিক' চরিত্রে মুখে কালি ঘষে অভিনয় করেছিলেন সাদা চামড়ার মানুষেরাই, সেখানে, এই 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'তে কালো মানুষদের চরিত্রে নেয়া হয়েছে তাদেরই। সিনেমার গানগুলো যদিও অবিকৃতই রাখা হয়েছে অনেকটা, তবুও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে সেখানেও। একই বিষয় ঘটেছে নাচের ক্ষেত্রেও। অনেক বেশি কালারফুল ও প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে নাচ। কালার প্যালেটেও এসেছে পার্থক্য। প্রোটাগনিস্ট চরিত্রগুলোর ব্যাকস্টোরি ডেভেলপে মনোযোগ দেয়া হয়েছে গভীরভাবে। এবং শুরু থেকে শেষতক পুরো নির্মাণেই বজায় থেকেছে স্পিলবার্গের অর্থবহ বর্ণময় নির্মাণ-শৈলী। বলা যেতে পারে, 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি'তে স্পিলবার্গ নিজের মতই তৈরী করেছেন এক ঘোরগ্রস্ত জগৎ। রিয়েলিজম এর সাথে এক ঘাটে জল খাইয়েছেন রোমান্টিসিজমকে, ঘৃণা ও ভালোবাসাকে হাঁটিয়েছেন গলা ধরাধরি করে, বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার মাঝখানে বসিয়েছেন অন্ধকার উপত্যকাও। নানামুখী অনুষঙ্গের আশ্চর্য মেদহীন সমতাবিধানে এভাবেই যে নির্মাণ হয়েছে- সেটিই নিউইয়র্কের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের গল্প। কিংবা, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি। যে গল্পে শেষে এসে মূর্ত হয়েছে স্পিলবার্গীয় সে বার্তাই-

ঘৃণার বদলা অবশ্যই হোক। কিন্তু সে বদলা হোক ভালোবাসায়। 

এবং এভাবেই স্পিলবার্গের 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি' রূপান্তরিত হয়েছে খুব অনবদ্য এক নির্মাণে। রূপান্তরিত হয়েছে স্বকীয় দ্যোতনার ভিন্ন এক প্রণয়-আখ্যানেও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা