এক্স ইকুয়ালস টু প্রেম: পুরোনো সৃজিত কি ফিরলেন?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সৃজিত জানতেন, তিনি কি বলতে চাচ্ছেন, কিভাবে বলতে চাচ্ছেন। মূলত, সে কারণেই, এই সিনেমায় প্রাপ্তির দিক বেশি। 'কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' করতে গিয়ে আফ্রিকান ট্রাভেল ভ্লগ কিংবা 'ভিঞ্চি দা'র শেষের মতন 'যাচ্ছেতাই' ক্লাইম্যাক্স না, মনোক্রোমিক টেমপ্লেটে একটা ফিউচারিস্টিক লাভ স্টোরিই তিনি বলতে চেয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি সফলও...
সৃজিত মুখার্জি'র সিনেমা দেখতে বসলে আজকাল খানিকটা তটস্থই থাকতে হয়। এমনিতেও, কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটিকে প্রাধান্য দিতে দিতে পুরোনো সে 'সৃজিত মুখার্জি' এ সময়ে এসে অনেকটাই অদৃশ্য। পাশাপাশি, ওভারলোডেড এলিটিসিজম, চারপাশের টক্সিক ফেক বাবল আর অ্যাকিউট রাশনেস... সৃজিত মুখার্জির সিনেমা; বাংলা-হিন্দি, অথবা, গুচ্ছের টিভি সিরিজ... কোনোকিছুই ঠিকঠাক জমেনা আজকাল। যদিও, ব্যতিক্রমও আছে। 'ফেলুদা'র যে অ্যাডাপ্টেশন করেছেন, সেটা আবার 'মন্দের ভালো' হিসেবে উতরেছে। কিন্তু, সেটুকু সামান্যই। সেই সৃজিত মুখার্জি, যে সৃজিত মুখার্জিকে 'জাতিস্মর-বাইশে শ্রাবণ-চতুষ্কোণ' এর বরাতে চেনা, যে সৃজিত মুখার্জি আর্ট আর কমার্শিয়াল জনরাকে জল খাইয়েছিলেন এক ঘাটে, সেই পরিচালকই কিভাবে ভোগবাদের এই ময়দানে আচমকা হয়ে পড়লেন অদৃশ্য, শিল্পী থেকে তিনি কিভাবে আচমকাই হয়ে পড়লেন ছাপোষা কর্মী... তা যতই দেখি, বিস্মিত হই। হতে হয়।
তবুও, সৃজিত মুখার্জির সিনেমা এলে এখনও ম্যাটিনি শো'তে দর্শকের হিড়িক পড়ে। কারণ, যে বেঞ্চমার্ক তিনি এককালে সেট করেছিলেন, পুরোনো দর্শকেরা এখনও ভাবে, সেই পুরোনো সৃজিত বোধহয় আবার কোনোদিন ফিরে এসে সেই বেঞ্চমার্ক টপকাবেন। যদিও দর্শকদের সে আশার গুড়ে প্রতিবারই বালি, তবুও নবায়নযোগ্য আশার মানসিক ভরসাতেই দেখতে বসেছিলাম ''X=Prem." যে সিনেমা হয়তো পুরোনো সৃজিতকে ফেরালোনা, তবুও মনোক্রোমে ভালোবাসার গল্প, আর, সে গল্পে খানিকটা সায়েন্স-ফিকশন আর বিশ্বসাহিত্যের ক্রাশ-কোর্স মিশিয়ে ভিন্ন দ্যোতনাই এলো। যে কারণেই, বিগত কিছু দায়সারা কাজের সাথে একই ক্যাটাগরিতে রাখা গেলোনা এই সিনেমাকে। খানিকটা ভিন্ন জায়গা দিতেই হলো।
'খিলাত' আর 'জয়ী'র উদ্দাম প্রেমের বর্ণনায় শুরু হয় গল্প। যদিও, টিপিক্যাল প্রেমের গল্প না এটা। ডিরেক্টর যেখানে সৃজিত মুখার্জি, সেখানে খানিকটা অক্সিমোরোন থাকবেনা, আন-অর্থোডক্স ন্যারেশন থাকবেনা, তাও বা কি করে হয়? সেই বৈপরীত্য মেনেই, খিলাত (নামটা অনেকটা 'চতুষ্কোণ' এর 'বেদশ্রুতি দে'র মতন। সেকেলে। জবরজঙ) ধুতি পরে ট্যাঙ্গো নাচলেন জয়ীর সাথে৷ তাও প্রথম দেখাতেই। ভরা ক্লাসরুমে। সেই থেকে শুরু রসায়ন। হাওড়া ব্রীজের নীচে চুমু, আদিম গুহায় রাত্রিবাস, অজ্ঞাতনামা জলাশয়ে উদোম হয়ে স্নান, কবীর সুমনের ছবির সামনে চূড়ান্ত আতলামো... হলো সবই৷ এরই মাঝখানে হলো অঘটন৷ এক সড়ক দুর্ঘটনায় 'খিলাত' হারালেন তার বিগত দশ বছরের স্মৃতি৷ একাডেমিক ক্যারিয়ারের পড়াশোনা ভুললেন, ভুললেন জয়ীর সাথে তার প্রেমের পেলব গল্পটুকুও।
এক ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো, যিনি বাতলালেন অদ্ভুত সমাধান। বললেন- মেমোরি ট্রান্সপ্লান্ট করে বিগত পড়াশোনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু, প্রেমের স্মৃতি? ব্যক্তিগত স্মৃতি? সেটা নিয়ে ডাক্তারও সন্দিহান৷ গল্পের এই পর্যায়, যে পর্যায়ে বেশ টানাপোড়েনের এক দ্বন্দ্বমুখর সমীক্ষা চলছে, তখন আবির্ভাব 'অর্ণব' নামের একজনের। নামের মতই যিনি বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন বিশাল বড় সমুদ্র। যে সমুদ্রে একজনেরই অবগাহনের অধিকার। যার নাম জয়ী। হ্যাঁ, খিলাতের প্রেমিকা জয়ী। অর্থাৎ, বোঝা গেলো- অর্ণবের এ ভালোবাসা একপাক্ষিক। একতরফা। সেই ভালোবাসাই দরকার হলো এবার খিলাতের। জয়ীরও। কেন দরকার, কিভাবে দরকার... মূলত সেটাই শেষাংশের সমাপয়েৎ। মধুরেণু কিনা, সেটা বলা যাচ্ছেনা।
'X=Prem' এর শুরুটা ঢিমেতালের হলেও ক্রমশ তাপ চড়েছে। স্ক্রিনপ্লে'র গতি বেড়েছে। এক্ষেত্রে, সৃজিত মুখার্জি খানিকটা ধন্যবাদই পাবেন৷ কারণ, যদিও তিনি ভেবেছেন প্রেমের আখ্যান, কিন্তু সে আখ্যানে তিনি থ্রিলারের একটা চাপা উত্তেজনাও রেখেছেন এবং সেটাকে খুব ভালোভাবে বিল্ডআপও করতে পেরেছেন। গল্পের দড়ি শক্তহাতে সামলেছেন৷ পাশাপাশি, যদিও এখানে তিনি নন-লিনিয়ার স্টাইলে হেঁটেছেন, কিন্তু, সে হাঁটাতেও ছিলো যথেষ্ট পরিমিতিবোধ ও গতি। তবে, পাশাপাশি এও বলে রাখি, গল্প-শেষের টুইস্ট জমেনি, এবং, অন্তিমাংশের এ চমক ছিলো বেশ গড়পড়তাও। এটুকু যদি পালটানো যেতো, তাহলে হয়তো শেষে এসে তৃপ্তি অনেকটুকুই বাড়তো। যেহেতু সেটা হয়নি, সেহেতু আক্ষেপ আছে। থাকবেও।
পাশাপাশি, আক্ষেপ থাকবে আরো বেশ কিছু প্রসঙ্গে। প্রথমত, যে 'মেমোরি ট্রান্সপ্লান্ট' নিয়ে এতকিছু, সেটা আরো ভালোভাবে স্টাবলিশ করার একটা বার্ডেন ছিলো নির্মাতার। ভিএফএক্স হোক কিংবা অ্যানিমেশন... এই প্রক্রিয়াটার সুলুকসন্ধান স্পষ্ট করার দায় ছিলো তার। কিন্তু, সেটা ঠিকঠাকভাবে তিনি করেননি। অনেকটা গা বাঁচিয়ে চলে গিয়েছেন দূরে। তাছাড়া, ডাক্তারের যে সেট দেখানো হয়েছে, সে সেটটাও প্রচণ্ড খেলো লেগেছে। হয়তো বাজেটের ঘাটতি ছিলো। কিন্তু, সে ঘাটতিকেও স্মার্টলি ডিল করা যেতো। তা হয়নি৷ পাশাপাশি, আক্ষেপ হয়েছে 'অর্ণব', যে চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন, এ চরিত্রটি নিয়েও।
'ওয়ান সাইডেড লাভ' এর প্রতিনিধি হিসেবেই পর্দায় হাজির হন 'অর্ণব' কিংবা অর্জুন চক্রবর্তী। এবং, আশ্চর্যজনকভাবেই করেন দুর্দান্ত অভিনয়। গল্পের গণ্ডি বুঝে এগোনো তো ছিলোই, সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডায়লগও আসে তার কাছ থেকে। 'ও স্পেশাল ছিলো কি না জানিনা, কিন্তু, সময়টা খুব স্পেশাল ছিলো' অথবা 'প্রিয় ঝড়' কবিতার চমৎকারিত্ব... যতটুকুই সময় পেয়েছেন, খুব ভালোভাবেই যে পারফর্ম করেছেন অর্জুন, এতে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ বোধহয় কারোরই নেই। কিন্তু, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ চরিত্রকে যতটুকু সময় দেয়া হয়েছে, সেটা আসলে খুবই কম৷ যে কারণেই আক্ষেপ হয়েছে। বিশেষ এ চরিত্রের সাথে পুরোপুরি জাস্টিস করা হলো কি না, সে প্রশ্নও এসেছে।
'অর্ণব'জনিত এই 'যদি-কিন্তু' বাদ দেয়া হলে, বাদবাকিদের অভিনয় ভালো। নবাগত অনিন্দ্য ও শ্রুতি'র অভিনয় ভালো। মধুরিমাও নাতিদীর্ঘ স্পেসে ভালো করেছেন। ভালো করেছে সিনেমার গানগুলোও। 'ভালোবাসার মরসুম' থেকে 'বায়নাবিলাসী', লিরিক্স থেকে সুর, শ্রেয়া-অরিজিৎ থেকে সপ্তক... গানের এক্সপেরিমেন্ট যে বেশ বড় ক্যানভাসেই হয়েছে, তা সিনেমাতেই দ্রষ্টব্য। যেসব কবিতা, টুকরো মেমোয়ার আর অল্পবিস্তর হোমাজ দেয়া হয়েছে নামজাদা সব আর্টিস্টকে, চোখে পড়েছে সেগুলোও। যদিও এগুলোর প্রভাব মূল গল্পে ততটা নেই। তবে, চোখের শান্তি দিয়েছে এইসব টুকরো উপকরণ।
এসবের মিলিত আঁতাতে, এই সিনেমা শেষে তাই এটাই হয়েছে স্পষ্ট, সৃজিত জানতেন, তিনি কি বলতে চাচ্ছেন, কিভাবে বলতে চাচ্ছেন। মূলত, সে কারণেই, এই সিনেমায় প্রাপ্তির দিক বেশি। 'কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' করতে গিয়ে আফ্রিকান ট্রাভেল ভ্লগ কিংবা 'ভিঞ্চি দা'র শেষের মতন 'যাচ্ছেতাই' ক্লাইম্যাক্স না, মনোক্রোমিক টেমপ্লেটে একটা ফিউচারিস্টিক লাভ স্টোরিই তিনি বলতে চেয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি সফলও। যদিও, চাইলে 'এটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড' এর সাথে এই সিনেমার চিন্তাগত মিল কেউ খুঁজে পাবেন। মিল যে আছে, সেটা নির্মাতা নিজেও স্বীকার করেন। তবে, সেটুকু বাদ দিলে, এই সিনেমা বেশ ভালো একটা অভিজ্ঞতা। ডিসেন্ট অ্যাম্বিভ্যালেন্স।